০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:০২

ঢাবিতে রাজনীতি নিয়ে দুই মেরুতে ছাত্র সংগঠন ও শিক্ষার্থীরা, নেপথ্যে কী

ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ  © ফাইল ছবি

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় রাজনীতি থাকবে কিনা, তা নিয়ে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধও করা হয়েছে। সম্প্রতি ছাত্রদলের পোস্টার সাঁটানো কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছাত্র রাজনীতি। শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ রাজনীতি নিষিদ্ধ চাইলেও ছাত্র সংগঠনগুলো এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েনের পাশাপাশি পাল্টাপাল্টি অভিযোগও করছেন।

গত বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের পোস্টার সাঁটানো কর্মসূচির পর রাতেই এর প্রতিবাদে এবং ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেন। পরে এর প্রতিবাদে সরব হন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কড়া প্রতিক্রিয়া জানান। এর পেছনে অন্য কারও ইন্ধন আছে বলেও অভিযোগ তোলেন। তবে শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতে ছাত্র রাজনীতি ছিল নির্যাতন-নিপীড়নের। এ কারণে তারা এর বিরোধীতা করছেন।

দুই রাতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের পর ছাত্র রাজনীতি নিয়ে তাদের অনীহা এবং সংগঠনগুলোর অবস্থান নিয়ে নানান ধরনের প্রশ্ন আলোচনায় আসছে। কেউ কেউ বলছেন, এর পেছনে নিষিদ্ধ গোষ্ঠী চক্রান্ত করছে। তারা ছাত্র রাজনীতিকে বিরাজনীতিকরণের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করতে চায়। আরেকটি অংশ বলছেন, ছাত্রলীগের রাজনীতি দেখে ভীত সন্ত্রস্ত হয়েই শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করছেন। ডাকসু নির্বাচনের দাবিও তুলেছেন। তবে সংস্কার করে সুস্থ ধারার রাজনীতি চালু রাখার মতও এসেছে।

ছাত্র রাজনীতি প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী আল আমিন বলেন, শুধু ছাত্রদল না, হলগুলোয় কোনো দলেরই রাজনীতি করার প্রয়োজন নেই। কেউ যদি ভাবে যে, ছাত্রদলকে মাইনাস করে তারা হলে রাজত্ব করবে, সেটাও তাদের ভুল ধারণা। এ বিক্ষোভ শিক্ষার্থীরা ছাত্র রাজনীতির প্রতি অনীহা থেকে করেছে। তবে সেখানে অন্য সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর উপস্থিতিও থাকতে পারে।

ভবিষ্যতে পোস্টার লাগানোর মতো কর্মসূচির বিষয়ে আরও সচেতন হওয়ার কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি গণেশচন্দ্র রায় সাহস। তিনি বলেন, ‘আমরা আগে ছাত্রলীগের জন্য পোস্টার লাগাতে পারতাম না, তারা ছিঁড়ে ফেলতো। এখনও পারি না। আমাদের কার্যক্রমে ভুল থাকতে পারে। আমরা কাওকে দোষারোপ করব না। তবে পোস্টার লাগানো যদি অপরাধ হয়, ছেঁড়া আরও বড় অপরাধ।’

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র শিবিরের ছাত্র আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘গতকাল রাতের ঘটনার জন্য যদি কেউ ছাত্রশিবিরকে দায়ী করতে চায়, তবে সেটা ভুল হবে। এসব অভিযোগ সম্পুর্ণ অসত্য।’

দুই রাতে শিক্ষার্থীদের এমন বিক্ষোভের পর ছাত্র রাজনীতি নিয়ে তাদের অনীহা এবং সংগঠনগুলোর অবস্থান নিয়ে নানান ধরনের প্রশ্ন আলোচনায় আসছে। কেউ কেউ বলছেন, এর পেছনে একটি নিষিদ্ধ গোষ্ঠী চক্রান্ত করছে। তারা ছাত্র রাজনীতিকে বিরাজনীতিকরণের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করতে চায়। আরেকটি অংশ বলছেন, ছাত্রলীগের রাজনীতি দেখে ভীত সন্ত্রস্ত হয়েই শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করছেন। এ সময় ডাকসু নির্বাচনের দাবিও তুলেছেন। তবে সংস্কার করে সুস্থ ধারার রাজনীতি চালু রাখার মতও এসেছে।

ছাত্র রাজনীতি ছাত্রদের মত প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম বলে মনে করেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি সালমান সিদ্দিকী। তাঁর ভাষ্য, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমুন্নত রাখতে ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি উঠেছে, তার দু’টি কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ, একটি অংশ গোপনে নিজের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য শিক্ষার্থীদেরকে ছাত্র রাজনীতিতে নিরুৎসাহিত করছে। আরেকটি অংশ দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের রাজনীতি দেখে অভ্যস্ত, যে কারণে ভয় পাচ্ছে। তবে ফ্যাসিবাদী মনোভাব থেকে বের হতে হলে ছাত্র রাজনীতি অবশ্যই প্রয়োজন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক এস এম ফরহাদ বলেন, ‘আমরা সবসময়ই ছাত্র রাজনীতির পক্ষে। তবে তার আগে ছাত্র রাজনীতিকে সংস্কার করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে একটি রূপরেখা দিতে হবে যে, ছাত্র রাজনীতিতে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না। প্রশাসনের এ ধীরগতির কারণেই ছাত্র সংগঠন ও ছাত্রদের মধ্যে ঝামেলার সৃষ্টি হচ্ছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন শিক্ষার্থী বলছেন, ছাত্র রাজনীতি অতীতে শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। তারা অতীতে ক্ষমতাসীন সংগঠনের হাতে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। পুরো ক্যাম্পাসে ছিল তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য। ফলে তারা রাজনীতি চাইছেন না। কোনও দল ক্ষমতায় এলে আবার তাদের ছাত্র সংগঠনের হাতে অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হতে পারেন। শুধু ছাত্রদল নয়, ছাত্রশিবির ও বাম সংগঠনগুলোর রাজনীতি নিয়েও সুন্দর সমাধান চান তারা। তবে যৌক্তিক সংস্কার করে সুস্থ ধারার ও শিক্ষার্থীবান্ধব রাজনীতির পক্ষে মতও দিচ্ছেন কেউ কেউ।

ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিদ বলেন, ‘অতীতের ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের যে শিক্ষা, সেখানে দলীয় যেকোনো ছাত্র সংগঠনই আমাদের ওপর আবার অন্যায় নির্যাতন করবে। সেজন্য লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে ডাকসু নির্বাচনকে আমি সঠিক সমাধান বলে মনে করি। তবে অবশ্যই কোনো গোপন সংগঠন বা গোপনে কেউ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চাইলে তাদেরকেও চিহ্নিত করতে হবে।’

আরো পড়ুন: ঢাবিতে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবিতে ফের বিক্ষোভ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ চেয়ে সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) রাতে বিভিন্ন হলের সামনে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। পরে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে জড়ো হন তারা। এ সময় ‘টু জিরো টু ফোর, লেজুড়বৃত্তি নো মোর’, ‘লেজুড়বৃত্তির ঠিকানা, এই ক্যাম্পাসে হবে না’, এমন নানান স্লোগান দেন তারা।

শিক্ষার্থী সাদিয়া ইয়াসমিন ঐতিহ্য বলেন, যে ছাত্র রাজনীতি ভীতি তৈরি করে, সে রাজনীতি তারা চান না। তারা ক্যাম্পাসে জিম্মি হতে চান না। একই ধরনের কথা বলেন তাহমিদ আল মুনতাসির। তাঁর ভাষ্য, হলে এবং ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির কালো অধ্যায় তারা দেখেছেন।শিক্ষার্থীরা দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি আর চায় না। প্রশাসনকে দ্রুত ডাকসু নির্বাচনের ব্যাবস্থা করতে হবে।

এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম বলেন, অভ্যুত্থানের পরে অপশক্তিরা হল দখল করে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। অভ্যুত্থানের তিন মাস পার হলেও প্রশাসন সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে পারেনি।