শিবির সন্দেহে নির্যাতন, রক্তাক্ত ছাত্রকে ফের ছাত্রলীগের হাতেই তুলে দিয়েছিলেন ঢাবি অধ্যাপক
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের কথা সবারই জানা। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা পিটিয়ে হত্যা করেন মেধাবী শিক্ষার্থী আববারকে। বুয়েট শুধু নয়, সারা দেশের প্রায় প্রতিটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল ছাত্রলীগের টর্চার সেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আবাসিক হলে তুচ্ছ কারণেই ছাত্রলীগের হাতে মারধরের শিকার হতো সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা। জানাচ্ছেন ভয়াবহভাবে নির্যাতিত হওয়ার কথা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী মো. মনিরুল ইসলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের সাবেক শিক্ষার্থী। সম্প্রতি তিনি ফেসবুকের এক পোস্টে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে নির্যাতিত হওয়ার কথা বর্ণনা করেন। তিনি লেখেন, ‘আমি কোনো রাজনীতিই করি না, গরিব ঘরের সন্তান। ঘটনার সময় ছাত্রলীগ কিছুতেই সেট মানতে রাজি হয়নি। তারা মেরে রক্তাক্ত করার পর হলের তৎকালীন সিনিয়র আবাসিক শিক্ষক শামসুজ্জোহা (ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এটিএম শামসুজ্জোহা) আসেন। তারপর ফের ছাত্রলীগের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তৎকালীন সিনিয়র আবাসিক শিক্ষক শামসুজ্জোহা।’
মো. মনিরুল ইসলাম লেখেন, ‘সময়টা ছিল ২০১৭ সালের ১২ আগস্ট। রাত আনুমানিক সাড়ে ৮টা। আমি সেন্ট্রাল লাইব্রেরি থেকে পড়াশোনা করে হলের ১০৯ নম্বর রুমে আসলাম। পরের দিন আমার ডিপার্টমেন্টের ইনকোর্স পরীক্ষা, তাই লাইব্রেরিতে পড়তে গিয়েছিলাম। রুমে এসে বইপত্র রেখে খাওয়ার জন্য ক্যান্টিনে যাবো এমন সময় ২২৮ নম্বর রুম থেকে আমার ইয়ারমেট রায়হান শরীফ(রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ) এবং তানভীর ফোন দিয়ে ২২৮ এ যেতে বলে। কারণ জানতে চাইলে বলে আয় জরুরি কথা আছে। ২২৮ নম্বর রুমে গেলে তারা দুইজন আমাকে রুমের মাঝখানে বসায় এবং জিজ্ঞেস করে আমি শিবির করি কি না। আমি বললাম আমি এসব রাজনীতির কিছুই জানি না, আমি কিছুই করি না।
তখন তারা বললো তাদের কাছে প্রমাণ আছে। কি প্রমাণ দেখতে চাইলে তারা দেখালো ২০১৫ সালে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর একটা ছবি আমার টাইমলাইন থেকে শেয়ার করা। আমি নিজেও জানি না এই ছবি আমার টাইমলাইন থেকে কীভাবে শেয়ার হয়েছে। সেই সময়ে বাটন ফোন চালাতে গিয়ে কখন আমার অজান্তে শেয়ারে চাপ লেগে গেছে আমি নিজেও জানতাম না। তারা এবার জোর করা শুরু করলো। বললো এখনও সময় আছে স্বীকার কর তুই শিবির করিস, তাহলে ছেড়ে দিবো। আমি বললাম আমি এসব কিচ্ছু জানি না, আমি কি স্বীকার করবো। তখন রায়হান এবং তানভীর আমাকে চড় মারতে শুরু করে।
তিনি আরও লেখেন, এরপর আমাকে তারা ২২৫ নম্বর রুমে ইমিডিয়েট সিনিয়রদের কাছে নিয়ে যায়। বলে যে ভাই শিবির ধরছি। ২২৫ নম্বর রুমে তখন উপস্থিত ছিল কায়সার (উর্দু, ফরিদপুর), নিজারুল(উর্দু, বরিশাল), আলী হোসাইন (রাষ্ট্রবিজ্ঞান, জামালপুর), মাহমুদুল (স্বাস্থ্য অর্থনীতি, সুনামগঞ্জ ) সহ আরো ৬-৭ জন। তারা সবাই ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। তারা জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করে, বল, তুই শিবির করিস কি না? বল তোর সাথে আর কে কে আছে? আমি যতবারই বলি ভাই আমি শিবির করি না, কোনো রাজনীতিই করি না, আমি গরিব ঘরের সন্তান। তারা কিছুতেই মানতে রাজি না।
আমি যতই বলি ভাই আমি এসব কিছু করি না, আমি নির্দোষ; তারা কোনো কথা শুনে না। ১ ঘণ্টা ধরে তারা মারধর করে। পুরো শরীরে রক্ত জমে কালো হয়ে যায়। এত মারের পরেও যখন চোখ দিয়ে পানি বের হয় না তখন কায়সার বলে ওঠে, এই আসলেই শিবির করে। এত মারের পরেও চোখ দিয়ে পানি পড়ে না। এরে আরো মার।
তাদের কথামতো আমি আমার এলাকার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে ফোন দিলাম। চেয়ারম্যান আমাকে ভালোভাবেই চিনেন। তিনিও ফোনে বললেন ছেলেটা খুবই ভালো ও সহজ-সরল, সে এ ধরনের কোনো রাজনীতি করে না। কায়সার চেয়ারম্যানকে বলে যে আপনি ওকে চিনেন না, ও তলে তলে শিবির করে। এই বলে ফোন কেটে দিলো। তারপর কায়সার আর নিজারুল হাতে নিলো স্ট্যাম্প, আলী হাতে নিলো লোহার রড আর মাহমুদুল নিলো বেল্ট। ৪ জন এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করলো আর বলতে লাগলো স্বীকার কর তুই শিবির, বল তোর সাথে আর কে কে আছে?’
ঢাবির এই শিক্ষার্থী আরও লেখেন, ‘আমি যতই বলি ভাই আমি এসব কিছু করি না, আমি নির্দোষ; তারা কোনো কথা শুনে না। ১ ঘণ্টা ধরে তারা মারধর করে। পুরো শরীরে রক্ত জমে কালো হয়ে যায়। এত মারের পরেও যখন চোখ দিয়ে পানি বের হয় না তখন কায়সার বলে ওঠে, এই আসলেই শিবির করে। এত মারের পরেও চোখ দিয়ে পানি পড়ে না। এরে আরো মার।
আরো কিছুক্ষণ চললো মার। সেদিন হয়তো আমার অবস্থাও হতে পারতো আবরার ফাহাদের মতো। এরপর তারা আমাকে টেনে নিয়ে গেলো তাদের ইমিডিয়েট সিনিয়র ইমন ভাইয়ের কাছে। ইমন ভাই সব শুনে রবি ভাইকে ফোন দিলো যে, তোর এলাকার ও কলেজের ছোট ভাইকে আলী, কায়সাররা মেরেছে; তাড়াতাড়ি রুমে আয়। রবি ভাই রুমে এসে আমার অবস্থা দেখে আমার এলাকার সাব্বির ভাইকে (তৎকালীন এসএম হলের সাংগঠনিক সম্পাদক) ফোন দিলেন। সাব্বির ভাইকে বললেন ওকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি ওখানে আসতে।
রিকশায় করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হলো। মেডিকেলে ঢুকে এক্সরে করে দেখলো কোনো হাত-পা ভেঙেছে কি না। কোনো হাড় ভাঙে নি নিশ্চিত হয়ে শুধু একটা ব্যথানাশক ইনজেকশন দিয়ে আবার হলে ফিরিয়ে আনা হয়। কোনো চিকিৎসার সুযোগ তারা দেয় নি।’
প্রভোস্ট জিয়া স্যার অনুপস্থিত থাকায় সেখানে ছিলেন হলের সিনিয়র আবাসিক শিক্ষক ইসলামের ইতিহাস ডিপার্টমেন্টের জোহা স্যার। তিনি সব ঘটনা শুনে হলের ছাত্রলীগ সভাপতি ইউসুফ ভাইকে বলেন, তুমি যা করবা করো। ইউসুফ ভাই বললেন, ওকে পুলিশের হাতে দিয়ে দিই, ওরাই তদন্ত করবে। জোহা স্যার আমার কোনো কথা কানে তোলেননি। আমার হল আইডি কার্ড নিজের কাছে জমা নিয়ে নিলেন।
নির্যাতনের ঘটনা উল্লেখ করে লিখে তিনি আরও লেখেন, ‘হলে এনে আবার ২২৮ নম্বর রুমে কিছুক্ষণ রেস্ট নিতে বলে। তখন বন্ধুরা আমার কাপড় চেঞ্জ করতে গিয়ে সারা শরীরে রক্ত জমাট বাধা দেখে সবাই শিউরে ওঠে। ১০ মিনিট পর প্রভোস্টের রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রভোস্ট জিয়া স্যার অনুপস্থিত থাকায় সেখানে ছিলেন হলের সিনিয়র আবাসিক শিক্ষক ইসলামের ইতিহাস ডিপার্টমেন্টের জোহা স্যার। তিনি সব ঘটনা শুনে হলের ছাত্রলীগ সভাপতি ইউসুফ ভাইকে বলেন, তুমি যা করবা করো। ইউসুফ ভাই বললেন, ওকে পুলিশের হাতে দিয়ে দিই, ওরাই তদন্ত করবে। জোহা স্যার আমার কোনো কথা কানে তোলেননি। আমার হল আইডি কার্ড নিজের কাছে জমা নিয়ে নিলেন।
পুলিশ আসলো হলে। রাত ২টার দিকে পুলিশ গাড়িতে করে শাহবাগ থানায় নিয়ে গেলো। সেখানে আরো বিজয় একাত্তর হল থেকে ১ জন,সূর্যসেন হল থেকে ৩ জন, এ এফ রহমান হল থেকে ২ জনকে রাজনৈতিক ব্লেইম দিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। পরেরদিন ওসি থানার বাইরে অবস্থান করায় তারপরের দিন অর্থাৎ ১৫ তারিখ দুপুর ১২ টার দিকে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারা আমার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পায়নি।’
তিনি লেখেন, ‘আমার সাথে এতবড় ঘটনা ঘটেছিলো তাও আমি এতদিন বুকে পাথর বেধে চাপা দিয়ে রেখেছিলাম। কারো বিরুদ্ধে এখনও কোনো মামলা করিনি, করার ইচ্ছাও নাই। আমি এই কুলাঙ্গারগুলোকে ক্ষমা করলেও আমার মা-বাবা ক্ষমা করবে কিনা তা আমি জানি না। তাদের বিবেকের কাছে আমার একটাই প্রশ্ন, সেদিন আমাকে মেরে তারা পৈশাচিক আনন্দ ছাড়া আর কী কী পেয়েছে?’