‘পায়ে গুলি লেগেছে পরিবারের কাউকে বলিনি, কারণ তারা কান্নাকাটি করবে’
আমার পায়ে পরপর ৩টি গুলি এসে লাগার পরে আমি মাটিতে পড়ে যায়। তখন মনে হয়েছিল আমি মারা যাবো কারণ পুলিশ গুলি করা শুরু করলে সবাই দৌড়ে পালাচ্ছে; আমি তো আর দৌড়াতে পারছি না। কথাগুলো বলছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত ওমর ফারুক। গত ২৬ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ির কাজলাতে আবু সাঈদসহ সারাদেশে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে কারফিউ উপেক্ষা করে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন ছাত্র জনতা। এসময় পুলিশ গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন ওমর ফারুক।
ছোটবেলায় বাবা ও মা হারায় ওমর ফারুক। বয়সে ছোট থেকে বড় হয়েছেন তার একমাত্র দায়িত্বশীল বড় বোনের কাছে। তিনি ঢাকা কলেজ সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০২০-২০২১ সেশনের শিক্ষার্থী। তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী জেলার কোম্পানিগঞ্জ উপজেলায়।
আহত অবস্থায় থেকেও পায়ে গুলি লাগার কথা গোপন করেছিলেন ওমর। তিনি বলেন, আমি কাউকে জানতে দিইনি যে আমার গুলি লেগেছে। সব সময় ক্ষতস্থান ঢেকে রাখতাম। এমনকি আমার রুমমেটরা ও জানে না। আমার পরিবারের কাউকে পর্যন্ত বলিনি। যদি বলি তারা আমার জন্য কান্নাকাটি করবে। টেনশন করবে।
পায়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ওমরের পায়ের ক্ষত থেকে ইনফেকশন হয়। পায়ে পুঁজ জমতে থাকে। মেসে থেকে একা একা দীর্ঘ এক মাস চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি। বর্তমানে সুস্থভাবে চলাফেরা করতে পারেন ওমর ফারুক।
তিনি বলেন, গুলি লাগার পরে হাঁটতে পারছিলাম না। একটা গলি দেখে হামাগুড়ি দিয়ে সেখানে ঢুকে নিজেকে আড়াল করি। তার পরে পুলিশ যখন চলে যায় তখন এক অপরিচিত আংকেল আমাকে একটা ফার্মেসিতে দিয়ে যায়। সেখানে ডাক্তার আমার পা থেকে গুলি বের করে ড্রেসিং করে দেয়, ব্যান্ডেজ করে দেয়। আমাকে কিছু ঔষধ দিয়ে বলে এগুলো নিয়মিত খাবে মিস দিবে না। আর কোনো সমস্যা হলে আমার সাথে যোগাযোগ করবে। ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
আরও পড়ুন: নেচে-গেয়ে যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ৩ জন গ্রেপ্তার
বাসায় থেকে চিকিৎসা নেওয়া ও সেসময় আপনজনদের সাথে যোগাযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঐ রকম সামর্থ্য ছিলে না। আর সরকারি হাসপাতালে তো ছাত্রলীগরা সব সময় টহল দিত। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরে আমার মানসিক অবস্থার অনেক অবনতি হয়, না পারছি কাউকে বলতে না পারছি সইতে। তার পরেও নিজের মন কে শক্ত করে সবাই কে হ্যান্ডেল করছি। যখন বাড়ি থেকে আপুরা কল দিতো, আমার খালা কল দিতো তখন খুব কষ্টে চোখের জ্বল আটকে রাখতাম। আমার দুর্বলতা যেন প্রকাশিত না হয় তার জন্য শক্তভাবে কথা বলতাম। তারা যেন কিছু বুঝতে না পারে। আমাকে সব সময় বলতো আন্দোলনে যাওয়ার দরকার নাই কারণ পুলিশের মায়া দয়া নাই তারা কখন গুলি করে বসে। তুই আমাদের একমাত্র ভাই, আমাদের আগে পিছে কেউ নাই যে এগিয়ে আসবে। তাই সব সময় সাবধানে থাকবি।
গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরে জুলাইয়ের উত্তাল সময়গুলোর বর্ণনা দিয়ে বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রথম থেকেই যুক্ত ছিলাম। আন্দোলনের সময় ভার্সিটিতে আমাদের ইনকোর্স পরীক্ষা আর টেস্ট পরীক্ষা ছিল। তার জন্য একটু বিপাকে পড়তে হয়েছিল। তারপরেও পরীক্ষা শেষ করে আবার আন্দোলনে যুক্ত হতাম। যে দিন পরীক্ষা থাকতো সে দিন পরীক্ষা শেষ করেই সাইন্সল্যাব অথবা শাহবাগে আন্দোলনে থাকতাম। আর যে দিন পরীক্ষা থাকতো না, সেদিন যাত্রাবাড়িতে আন্দোলনে অবস্থান করতাম কারণ আমার বাসা ছিল যাত্রাবাড়ি।
এভাবে কারফিউ এর মধ্যে ২৪ জুলাই আমি যাত্রাবাড়ি কাজলাতে গুলিবিদ্ধ হই। আমার পায়ে ৩টি ছররা গুলি এসে লাগে। তখন আমি মাটিতে পড়ে যায়। তখন মনে হয়েছিল আমি মারা যাবো কারণ সবাই দৌড়ে পালাচ্ছে, আমি তো আর দৌড়াতে পারছি না।
আরও পড়ুন; লেফটেন্যান্ট তানজিম হত্যায় সরাসরি জড়িত ৬ জন আটক
বুকে মূল্যবোধ ধারণ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন ওমর ফারুক। তার ভাষ্যমতে, আপনি যদি মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হন, তবে কোনো অন্যায় কাজ দেখলে আপনার হৃদয় প্রকম্পিত হয়ে উঠবে। আপনার মধ্যে যে একটা মনুষ্যত্ব আছে সেটা বার বার আপনাকে তাড়না দিবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। যখন দেখলাম আমার সহপাঠীদের উপর পুলিশ অমানবিক ভাবে গুলি ছুড়ছে। আমার বোনদের ছাত্রলীগ নির্যাতন করছে। আমাদের অধিকার থেকে আমাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। তখন আর ঘরে বসে থাকা যায় না।
অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হলে কোনো দল করা লাগে না। শুধু মনুষ্যত্ব থাকলে হয়। আমার পরিবারের আদেশ অমান্য করে দেশ মাতৃকা রক্ষা করার জন্য দেশের মানুষের মুক্তির জন্য আমার জীবন যদি বলিদান হতো, আমি তার জন্য কোনো আফসোস করতাম না। আমি এই দেশের নাগরিক এই দেশ আমার মাতৃভূমি। তাই এই দেশ রক্ষার ক্ষেত্রে আমি সবকিছু উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। এই দেশের মাটির সাথে মিশে আছে আমার অস্তিত্ব। এই দেশের জন্য যদি আবারো কোনো সংগ্রাম করতে হয় আমি নির্দ্বিধায় নিজেকে বিলিয়ে দিবো।
আরও পড়ুন: ওই ঘটনার পর পরিবারে বলেছিলাম— ক্লাস শেষের ১০ মিনিট পর আমাকে না পেলে থানায় খোঁজ করবা
দেশের জনগণ ও অন্তবর্তীকালীন সরকারে কাছে ওমর ফারুক তার প্রত্যাশার কথা উল্লেখ করে বলেন, বর্তমান সময়ে আমরা দেখি যারা আন্দোলনে নিহত হয়েছে তাদেরকে অনেক রাজনৈতিক দল নিজেদের কর্মি বলে পরিচয় দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কিন্তু যারা হাসপাতালে আহত অবস্থায় আছে তাদের খবর কেউ নিচ্ছে না। কারণ তাদের যদি সাহায্য করা লাগে। যদি রাজনৈতিক দলগুলোর এমন মানসিকতা থাকে তা হলে বাংলাদেশের অবস্থা পরিবর্তন হবে না। তাই নতুন বিপ্লবের মাধ্যমে আমরা আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন করি সবাই মানবতা ও দেশ মাতৃকা রক্ষার জন্য রাজনীতি করি। আর নতুন বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে আমার মতামত হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে ছাত্রদের কল্যাণে নতুন রাজনীতি চালু হোক।
তিনি বলেন, সরকারের নিকট আমার আবেদন হলো আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে পুলিশ, র্যাব ওআনসার তাদের আবার পুনঃগঠন করুন। কারণ তাঁদের অধিকাংশ ছিল স্বৈরাচার সরকারের দোসর। যাদের প্রতি অভিযোগ আছে তাদের প্রত্যেককে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা ও আইনানুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আর যারা আন্দোলনের আহত ও নিহত হয়েছে তাদের সর্বাত্মক সাহায্য করা। আন্দোলনে ছাত্ররা ছাড়া ও সাধারণ জনতা অনেকে আহত নিহত হয়েছে। তাদের দিকেও খেয়াল রাখা দরকার।