২০২৪ এর স্বাধীনতার ভাইরাল সব সংলাপ
সম্প্রতি দেশে ঘটে যাওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও শেষে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ঘিরে সহিংসতায় ১ হাজার ৪২৩ জন নিহত হয়েছেন। কুড়ি দিন ব্যাপক সহিংসতা এবং প্রবল গণ-আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার (৫ আগস্ট) পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যান।
সেনা প্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ-জামান একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন এবং প্রতিটি মৃত্যু তদন্ত করার প্রতিশ্রুতি দেন।
ছাত্রদের বিক্ষোভ শুরু হয় সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি নিয়ে, কিন্তু সরকার সহিংসতা দিয়ে ছাত্রদের দমন করার চেষ্টা করলে সর্বস্তরের মানুষ আন্দোলনে যোগ দেয়।
কোটা আন্দোলন কীভাবে সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হলো সে গল্প আমরা সবাই জানি। ১৪ জুলাই, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা কোটা পাবে না তো রাজাকারের সন্তানেরা পাবে? এই কথা নিয়ে শুরু হয় উত্তেজনা। ১৫ তারিখ রাতে প্রথম সূর্যসেন হল থেকে রাতের বেলা একদল শিক্ষার্থী বলে ওঠে,
'তুমি কে, আমি কে?
রাজাকার, রাজাকার,
কে বলেছে, কে বলেছে?
স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।'
কিছু সময়ের মধ্যেই প্রত্যেকটি হলে স্লোগানটি ছড়িয়ে পড়ে। পুরো ক্যাম্পাসে বাজতে থাকে এই স্লোগান। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার দেওয়া ট্যাগিংকে স্যাটায়ার করে তুলে ধরাই ছিল এই স্লোগানের উদ্দেশ্য। তবে এই স্লোগানটির মাধ্যমে দেশের মেধাবীরা প্রথমবারের মতো শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলো। এটাই বোধহয় শুরু কোটা আন্দোলন থেকে সরকার পতনের আন্দোলনের দিকে যাত্রার।
এরপর ১৫ তারিখ দিনের বেলায় শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের আকস্মিক হামলা সব কিছুর মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এরপর টানা ২০ দিন বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আন্দোলন চলতে থাকে। শেখ হাসিনার গণহত্যা ও সর্বস্তরের মানুষের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় এই আন্দোলন আর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সীমাবদ্ধ থাকেনা। শুরু হয় গণ আন্দোলন। ৯ দফা দাবি যখন পূরণ তো হয়ই না উল্টো চলতে থাকে হত্যাকাণ্ড। এরপর ঘোষিত হয় এক দফা এক দাবি। শেখ হাসিনার পতন। পুরো সময়টাতে মানুষের মাথায় কী চলছিলো ভাবলে অবাক লাগে। স্বাধীনতার তৃষ্ণায় মানুষ গুলির সামনে বুক পেতে দিতেও ভাবেনি। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে ভাবেনি একবারও। আর সেই সময় শেখ হাসিনা টেলিভিশনের সামনে একটাই উক্তি দিয়ে যাচ্ছিলো, 'স্বজন হারানোর বেদনা আমি বুঝি'। তার এই উক্তিটি ছিল কাটা ঘায়ে নুনের ছেটার মতো।
শহীদ মুগ্ধর 'পানি লাগবে পানি?' আমাদের কানে পুরো আন্দোলনের সময়ই যে বাজছিল তাই নয়। হয়ত ২০২৪ এর জুলাই যারা দেখেছেন তাদের কানে আজীবনই বাজবে। মুগ্ধর পানি ভুলতে না ভুলতেই 'আমারে যাইতে দেন না, আমার একটা ছোট্ট বোন আছে' ফেসবুকে ঘুরছিল ২৯ জুলাই সময়টাতে।
ওই সময় কিন্তু ছাত্রলীগও চুপ ছিল না। তারা 'হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই', 'জনে জনে খবর দে, এক দফার কবর দে' ইত্যাদি স্লোগান চালিয়ে যাচ্ছিলো। ছাত্রলীগের নেত্রী আতিকার ফেইক আইডি থেকে করা পোস্ট '৭ মিনিটে ক্লিয়ার' ওই রাতে আন্দোলনকারীদের ভালোই বিনোদন দিয়েছিলো। ছাত্রলীগ নেতা হাফিজের 'চালায় দেন' তো আরেক বিনোদন। এক দফা ঘোষণার পর এক ছাত্রলীগ কর্মী পোস্ট দিয়েছিলো 'আগে যেটা বলছেন সেটার পক্ষে ছিলাম, এখন যা চাইতেছেন তার পক্ষে নাই।' তার এই পোস্টের লেখার সাথে মিলিয়ে ফেসবুকে ট্রল হতে থাকে 'কোটা সংস্কারের পক্ষে ছিলাম, এখন যেটা চাচ্ছেন সেটার পক্ষে নেই' এই লাইনটি ব্যবহার করে।
সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক এবং উপস্থাপিকা দীপ্তি চৌধুরীর সেই টক শো। যেখানে দীপ্তির ধৈর্যের প্রশংসা করতেই হবে। সাবেক বিচারপতি মানিকের 'রাবিশ কথা বলবেন না' আর উপস্থাপিকা দীপ্তির 'উত্তেজিত হবেন না' সেই সময়ের ভাইরাল বিষয়। অনেকেই এই উপস্থাপিকার কাছে ধৈর্য শিখতে চাচ্ছিলেন।
'হারুনের ভাতের হোটেল' তো ভুলে যাওয়ার মতোই না। ভাতের হোটেলের ব্যাপারটা এসেছিল ডিবি হারুন সমন্বয়কদের ধরে নিয়ে তাদের উপর অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে আবার চাইনিজ খাইয়ে সেটার ছবি ফেসবুকে দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো যে সবকিছু স্বাভাবিক আছে।
৫ আগস্ট 'স্বাধীনতা ২.০' প্রাপ্তির পর শান্তি পাননি আন্দোলনকারীরা। সংখ্যালঘুরা অনিরাপদ হয়ে পড়েন। সেই সময়ে কিছু গুজবও চলতে থাকে। রাতের বেলা সেই গুজব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাসি তামাশা চলতো। ওই গুজবের রাত গুলোকে বলা হতো 'লাইলাতুল গুজব'। একবার তো গুজব হলো 'র' এসেছে। এরপর শুরু হলো "ডাকাত" ধরা। ডাকাত ধরতে গিয়ে পিকনিক, খেলা সবই চলছিলো।
তবে 'স্বাধীনতা ২.০' এর পরে 'আফসোস লীগ' ট্যাগ আসলো। 'আফসোস লীগ' হলেন তারা যাদের কথা 'আগেই ভালো ছিল'। 'oi mama na pls' এবং 'দেখেন আপনারা যা ভালো মনে করেন' লাইন দুটির দফারফা হয়ে গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তর্কের শেষ লাইন হিসেবে এই দুই লাইনের ব্যবহার সত্যিই মজার।
আন্দোলনের সময়ে পরিচিত মুখ ফারজানা সিথির 'wait, its my turn now' সবাইকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সবাইকে শিবির ট্যাগ দিয়ে দেওয়া থেকে এসেছিল 'মানুষ মাত্রই শিবির'। এরই সূত্র ধরে এখন ট্রল হয় 'মানুষ মাত্রই সমন্বয়ক' - এই লাইন নিয়ে।
আন্দোলনের ওই কঠিন দিনগুলোতে অনেক উক্ত, স্লোগান আমাদের প্রেরণা দিয়েছে। আবার অনেক কিছু আমাদের ওই কঠিন সময়েও হাসিয়েছে। নির্ভেজাল বিনোদন দিয়েছে। তবে শেষে একটা কথাই বলবো আন্দোলন, সংগ্রাম কিন্তু এখনো শেষ হয়নি।
'We are open
We are looking for শত্রুজ'