খোঁজ নিচ্ছেন শহিদদের, খোঁজ নেই আহতদের
চকবাজারে একটি কারখানায় কাজ করতেন শ্রমিক লোকমান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনে আহত হয়ে একটি বেসরকারি হাসপাতালে একমাসের অধিক সময় ধরে ভর্তি রয়েছেন। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে না পেরে তার পরিবার দুশ্চিন্তায় দিনাতিপাত করছেন। তবে তার সাথে এখনো যোগাযোগ করেনি কেউ।
চিকিৎসা সহায়তার জন্য সমম্বয়কদের দেখা পেতে তার পরিবার ঘুরছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে। তার স্ত্রী জানান, লোকমান একমাত্র উপার্জনকারী। তার শরীরের একাধিক স্থানে ছররা গুলি লেগেছিল। সে কাজে অক্ষম হওয়ায় পরিবার নিরুপায় হয়ে গেছে।
আহতদের করুণ পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত গণমাধ্যমে খবর বের হচ্ছে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে সন্তান দত্তক দেওয়ার খবরও আসছে। অভিযোগ উঠেছে, সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা জেলায় জেলায় গিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের কবর জিয়ারত ও সৌজন্য সাক্ষাৎ করলেও তেমন খোঁজ নিচ্ছেন না আহতদের।
এদিকে ১৭ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের যাবতীয় চিকিৎসা ব্যয় সরকার বহন করবে বলে প্রজ্ঞাপন জারি করে। তারপর থেকে রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে চিকিৎসা নিচ্ছেন আহতরা। তবুও আহতের সংখ্যা ২০ হাজারের কাছাকাছি হওয়া এবং অনেকের অঙ্গহানি ঘটায় কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া অনেকের চোখ নষ্ট হওয়ায় পরিবারের বোঝা হয়ে দাড়িয়েছে। এসব পরিবারের পুনর্বাসনে ধীরগতির অভিযোগ রয়েছে।
ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত মাসের (সেপ্টেম্বর) ৫ তারিখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় আওয়ামী লীগ সরকার। ভারতে পালিয়ে যান আওয়ামী প্রধান শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা। ৫ই জুন থেকে শুরু হওয়া আন্দোলন দমাতে সশস্ত্র অবস্থান নেয় পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও আওয়ামী সমর্থক গোষ্ঠী। তখন থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ধারণা করা হচ্ছে আন্দোলনে নিহত হয়েছে দেড় হাজারেরও বেশি এবং আহত হয়েছে হাজার হাজার ছাত্র জনতা। যার মধ্যে রিকশাওয়ালা, দিনমজুর, শ্রমিক থেকে শুরু করে হাজার হাজার ছাত্র জনতা। কারও চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছে কারও বা পা কেটে ফেলতে হয়েছে।
জানা যায়, বেশ কয়েকদিন যাবত বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন জেলায় জেলায় সৌজন্য সাক্ষাৎ, মতবিনিময় সভা এবং শহিদদের কবর জিয়ারত করছেন। তবে অভিযোগ রয়েছে জেলায় জেলায় গিয়ে নিহতদের কবর জিয়ারত করলেও আহতদের খুব বেশি খবরাখবর নিচ্ছেন না এবং সহায়তা করছেন না বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা।
এদিকে জুলাই গণ অভ্যুত্থানে গিয়ে আহত অনেক মানুষ অর্থের অভাবে পূর্ণ চিকিৎসা নিতে পারছেন না এমন চিত্র প্রায় প্রতিদিনই গণমাধ্যমে উঠে আসছে। আগস্টের শুরুতে কয়েকটি হাসপাতালে গিয়ে সমন্বয়করা খবর নিলেও পরে আর খবর নেননি সমন্বয়করা। এমনকি অনেক আহত সম্পর্কে জানেন না এবং খোঁজও নেননি বলে জানিয়েছেন একাধিক আহতের পরিবার।
এদিকে, আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ দিনমজুর আব্দুর রশিদের চিকিৎসা খরচ যোগাতে ও স্বামীকে সেবা করার জন্য নিজের সদ্যজাত শিশুকে ২৫ হাজার টাকায় দত্তক দেয় স্ত্রী রোকেয়া বেগম রত্না। সম্প্রতি এমন একটি সংবাদ গণমাধ্যমে উঠে এসেছে।
জানা যায়, আব্দুর রশিদ চিকিৎসায় অনেক টাকার প্রয়োজন। তার নাভির নিচে ৯টি ও পায়ে কয়েকটি ছররা গুলি লেগেছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অপারেশন করতে হবে। শেষে উপায়ন্তর না দেখে মাত্র নাড়িছেঁড়া ধন তিন দিন বয়সী সন্তানকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন কুড়িগ্রামের এক নিঃসন্তান পরিবারের কাছে।
এর আগে আগস্টের ১৮ তারিখে একটি বিবৃতিতে কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক নাহিদা বুশরা বলেন, সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে দেশের বিভিন্ন স্থানে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও শহিদ পরিবারকে সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে একটি নীতিমালা প্রণয়ন এবং শহিদ ও আহত ব্যক্তিদের পরিচিতিসহ একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব হুমায়ুন কবিরের সভাপতিত্বে ১৮ আগস্ট সকাল ১০টায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
এসময় সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানে শহিদ ও আহতদের পরিচিতিসহ পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুতকরণ, সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে একটি নীতিমালা প্রণয়নসহ কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা হয়। সেখানে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে কেন্দ্রীয় মেডিকেল টিমের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন নাহিদা বুশরা, আবদুল্লাহ ইবনে হানিফ আরিয়ান, নাহিদা সরোয়ার নিভা এবং ডাক্তার আতাউর রহমান রাজিব।
কিন্তু ২২ দিন চলে গেলেও এখনও পর্যন্ত নিহতের তালিকাও প্রকাশ করতে পারেনি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্য উপ-কমিটি। আহতের সংখ্যা সেই তুলনায় অনেক বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত আহতদেরকে নিয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন কোনো পরিকল্পনা সামনে আনেননি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা।
জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক নাহিদা বুশরা বলেন, আমরা আহতদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখছি। চেইন বিক্রি করে চিকিৎসা, সন্তান বিক্রি করে চিকিৎসা এগুলো জানার পর তাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেছি। আমাদের নিজস্ব কোনো ফান্ড নেই। কোনো আহতের ব্যাপারে জানতে পারলে যারা ডোনেট করতে আগ্রহী তাদেরকে বলি ঐ পরিবারকে সহায়তা করতে। এভাবেই আমাদের কার্যক্রম চলছে। বাচ্চা বিক্রি করে।দেওয়ার ব্যাপারটা মিথ্যা আমরা জানতে পেরেছি বাচ্চা তারা দত্তক দিয়েছে।