‘কমেন্টে’ ফিরে এলো আন্দোলনে শহীদ ওয়াসিমের পুরনো ছবি, আবেগাপ্লুত বন্ধুরা
‘অন্নহীনকে অন্ন দাও, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দাও, অন্ধকে পথ দেখাও। এগুলো ছিল নিত্যদিনের স্লোগান। হঠাৎ দেখি চট্টগ্রাম জিইসি মোড়ে আমার বন্ধু ওয়াসিম আকরাম এক বৃদ্ধ অন্ধকে রাস্তা পার করতে। আমি দেখা মাত্রই ক্যামেরা ধারণ করলাম’ ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২০ তারিখে এই ক্যাপশনে ছবিটি আমার ফেসবুকে পোস্ট করি।
ফেসবুকে পোস্টের কিছুক্ষণ পর বন্ধু প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে- "বন্ধু পোস্ট করার কী ছিল। ছবি তোলা প্রয়োজন মনে করলি, অথচ নেমে কথা বললি না এটাই বন্ধুত্ব। যা হোক ধন্যবাদ নেজাম।’
তার প্রতি উত্তরে আমার জবাব ছিল,‘আসলে ছবিটা আমি গোপনে তুলেছিলাম, যাতে তুই দেখতে না পাস। এ ধরনের কাজ গুলো আমার খুব ভালো লাগে। এইজন্য মানুষের সামনে তুলে ধরলাম। তুই কিছু মনে করিস না, তুই শুধুমাত্র একটি দৃষ্টান্ত।’
বৃহস্পতিবার (২৯ আগষ্ট) কথাগুলো ফেসবুকে লিখেছেন ১৭ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত ওয়াসিমের বন্ধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এ.জে.নেজামউদ্দিন।
১৭ জুলাই চট্টগ্রাম শহরের মুরাদপুর এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সংঘর্ষের সময় নিহত হন মো. ওয়াসিম। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে তিনি স্ট্যাটাস দেন ‘চলে আসুন ষোলশহর’। এর তিন ঘণ্টা পর সন্ধ্যা ছয়টার দিকে তার লাশ মিলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
ওয়াসিমের গ্রামের বাড়ি কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের বাঘগুজারা বাজারপাড়া এলাকায়। তাঁর বাবা শফিউল আলম সৌদিপ্রবাসী। মা জোসনা বেগম গৃহিণী। ওয়াসিম পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয়।
ওয়াসিম ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি পেকুয়া উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন।
এ.জে.নেজামউদ্দিন ফেসবুকে লিখেন, গত পরশু কেউ একজন পুরাতন ছবিতে কমেন্ট করলে পোস্টটি আমার সামনে আসে। এদিকে সকল মেসেঞ্জার গ্রুপ, ফেসবুক ঘাটাঘাটি করে তার সব স্মৃতিময় ছবি, ভিডিও, সংরক্ষণ করে রাখতেছি। এই ছবিটা মহামূল্যবান স্মৃতি।
বন্ধু শহীদ হওয়ার পর থেকে আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। একদম চুপ হয়ে গেছি বললে চলে। সেদিন থেকে তেমন কোনো আয়োজনে বা আনন্দ অনুষ্ঠানে (আন্দোলন ব্যতীত) যুক্ত হইনি। আমার প্রতিটা দিন আমার জন্য শোক দিবস। রাতে যখন শুইয়ে থাকি তখন তার স্মৃতি ভেসে বেড়ায় চোখের সামনে। কখন যে অশ্রুসিক্ত হয়ে যাই নিজেই বুঝতে পারি না।
আমরা একসাথে স্কুলে পড়াশোনা করছি। দীর্ঘদিন ক্লাস ক্যাপ্টেন ছিলাম। যেকোনো উদ্যোগ আমাকে নিতে হতো। এখনও কোনো আয়োজনের আলোচনা হলে আমাকে সামনের সারিতে থাকতে হয়। আমি ওয়াসিমকে সবসময় প্রাধান্য দিতাম এই বিষয়ে। এইতো তার মৃত্যুর কয়েকদিন আগেও এক বন্ধুর বাবার ক্যান্সার হলে তাকে সাহায্য করার জন্য ওয়াসিম, জাহেদ এবং আমি ফান্ড সংগ্রহ করি। তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার পাশাপাশি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিষয়েও কম ধারণা ছিল না। সামাজিক সংগঠন, রক্তদানসহ সবধরনের ভালো কাজে যুক্ত ছিল। তারই বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ছবিটির কথা বলতে পারি।
আমি চকবাজার থেকে আসার সময় হঠাৎ জিইসি মোড়ে বন্ধুকে দেখি। সেই হয়তো কলেজ থেকে আসতেছে। সাদা ইউনিফর্মে জিইসি এলাকা আলোকিত করেছে। আমি মুগ্ধ হয়ে ছবিটি তুলি। পরে পোস্ট করি। আমি নাকি সেদিন তার সাথে কথা বলিনি, শুধু নাকি ছবি তুলেছি। কিন্তু আমি তো কখনো এরকম করব বলে মনে হয় না। হয়তো আমার তাড়াহুড়ো ছিল নয়তো তার সাথে কোনো কারণে অভিমান করছি, এজন্য হয়তো কথা বলা হয়নি। আজ ওয়াসিম থাকলে তার থেকে ব্যাখ্যা চাইতাম।
তার সাথে কথা না বললে, আজীবন ভালবাসা আছে বলে ফেসবুকে মন্তব্য করেছে। আমরা এমন একজন বন্ধু হারিয়ে ফেলছি, যাকে মনে কষ্ট দিলেও প্রতিদান হিসেবে ভালবাসা দিয়েছে। গত ১৬ জুলাই কোটা আন্দোলনে চট্টগ্রামে সেই শহীদ হয়েছে। এমন বন্ধুকে কি কখনো ফিরিয়ে পাব?
মোহাম্মদ ওয়াসিম মেহেরনামা উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০১৭ সালে এসএসসি, ২০১৯ সালে বাকলিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ২০১৯-২০ সেশনে চট্টগ্রাম কলেজে স্নাতকে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে ভর্তি হয়ে চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
জানতে চাইলে নিহত ওয়াসিমের বন্ধু নেজামউদ্দিন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমার বন্ধু অনেক পরোপকারী ছিলেন। তাকে যারা হত্যা করেছে আমি তাদের বিচার চাই।