আন্দোলনকারীদের জন্য ঠান্ডা পানি নিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান নাসির
গত ২০ জুলাই ঘুম থেকে উঠেই বাসা থেকে বেরিয়ে যান মো. নাসির হোসেন (৩৯)। নাশতা খাওয়ার জন্য পেছন থেকে মায়ের ডাকাডাকি না শুনেই তাড়াহুড়া করে চলে যান। কিছু সময় পর বাসায় ফিরে মায়ের দেওয়া দুটো রুটি খান নাসির। তারপর পাঁচ লিটারের পানির পাত্রে ফ্রিজে ঠান্ডা করা পানি ভরে আবার বেরিয়ে যান। বের হওয়ার ঘণ্টাখানেক পরই হটাৎ বাড়ির বাইরে লোকজনের চিৎকার শুনা যায়। সবাই বলছিলেন, ‘নাসির গুলি খাইছে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি চলাকালে ২০ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রায়েরাগ এলাকায় মাথায় ও মুখমণ্ডলে গুলিবিদ্ধ হন নাসির। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ভর্তি করা হয় মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানকার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৩ জুলাই সকাল সাড়ে সাতটায় মারা যান নাসির।
নাসিরদের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলায়। তার বাবা রফিকুল ইসলাম ও মা নাজমা বেগম। চার ভাই, পাঁচ বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন নাসির। অবিবাহিত নাসির পেশায় দরজি ছিলেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে গত ১৯ জুলাই শরিক হন তিনি। পরদিনই গুলিবিদ্ধ হন।
দুই ভ্রুর ওপরে দুই পাশে ও মাথার ডান পাশে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন নাসির। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তার মাথা দিয়ে অনেক রক্ত ঝরছিল।
রক্তপাত ঠেকাতে কেউ একজন নাসিরের পরনের আকাশি রঙের শার্টটি খুলে তাঁর মাথায় পেঁচিয়ে দিয়েছিলেন। সেই শার্টটি ধুয়ে যত্ন করে রেখে দিয়েছেন তার মা নাজমা বেগম।
নাসিরের এক ভাই জানান, সেদিন বাসায় এসে আন্দোলনকারীদের জন্য ঠান্ডা পানি নিয়ে যাচ্ছিলেন ভাই। পানি কোথায় নিয়ে যাস—জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক গরম। পুলিশের ধাওয়া খেতে খেতে আন্দোলনকারীরা অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তাদের জন্য ঠান্ডা পানি নিয়ে যাচ্ছেন। এর আগের দিন এলাকায় রান্না করা খিচুড়ি নিয়ে আন্দোলনকারীদের দিয়ে এসেছিলেন ভাই।
তিনি আরও বলেন, ‘আপনার কাছে এখন মন খুলে সব বলছি। কিন্তু যখন আমার ভাই গুলি খেল, ভয়ে কারও সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। হাসপাতালে, মর্গে, এমনকি কবরস্থানে গিয়েও হয়রানির শিকার হয়েছি। বাসার সামনে এই ব্যানার টাঙানোর সাহসও ছিল না। বাসায় কুলখানির আয়োজন করতে পারিনি। ভয়ে মসজিদ থেকে কোনো হুজুর আসতে রাজি হচ্ছিলেন না।’
তিনি জানান, নাসির গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর বাসার কাছের একটি দোকানের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সেদিন ওই এলাকা ছিল যুদ্ধক্ষেত্রের মতো। ক্রমাগত গুলিবর্ষণ চলছিল। ছোড়া হচ্ছিল কাঁদানে গ্যাসের শেল। তাঁদের বাসার ছাদে তিনটি কাঁদানে গ্যাসের শেল এসে পড়েছিল। সবাই বাড়ির দরজা-জানালা সব বন্ধ করে রেখেছিলেন। এরপরও ঘরে টেকা যাচ্ছিল না। তার মা ও বোনেরা ধোঁয়ায় কাবু হয়ে বমি করছিলেন।
নাসির গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা শুনে তার ভাই দৌড়ে নিচে নেমে দেখেন, তার ভাই দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে। মাথায় শার্ট বাঁধা। কোথায় গুলি লেগেছে, জানতে চান জিলানী। নাসির বলেছিলেন, ‘মাথায়।’ এটাই ছিল নাসিরের সঙ্গে শেষ কথা।
পরে করে নাসিরকে নিয়ে এসএমসি নামের স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নিলে তারা জানায়, এত গুরুতর আহত ব্যক্তির চিকিৎসা সেখানে সম্ভব নয়।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিনা মূল্যে একটি অ্যাম্বুলেন্স দেয়। এই অ্যাম্বুলেন্সে করে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নাসিরকে নিয়ে যান। সেখানেই মারা যান তিনি।