১০ আগস্ট ২০২৪, ১০:১৯

সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ 

শাহরিয়ার রাহাত ও আশিক  © ফাইল ছবি

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আল নাহিয়ান জয়-লেখক ভট্টাচার্যের শেষ সময়ে এসে অনুমোদন পায় রাজধানীর সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি। ২০২২ সালের ৮ নভেম্বরে কাগজে কলমে মেয়াদ এক বছর হলেও কমিটিটি তাদের কার্যক্রম চালায় প্রায় ১ বছর ৯ মাস। দীর্ঘ এ সময়ে  কমিটির বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক অভিযোগ। কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার রাহাত মোড়ল কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন এবং সম্পাদক আশিক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ইনানের অনুসারী ছিলেন।

তাদের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে মেয়াদ শেষ হলেও ছাত্রত্ব রাখা, পূর্ণাঙ্গ কমিটি না দেওয়া, চাঁদাবাজি, নারী কেলেঙ্কারি, ইভটিজিং, সাংবাদিক নির্যাতন, পরীক্ষা চলাকালীন টাকার বিনিময়ে বাথরুমে বসে প্রশ্নের সমাধান বিক্রি করাসহ একাধিক অভিযোগ। 

মেয়াদ শেষ হলেও ছিল ছাত্রত্ব
সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রসংসদের সদ্য সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার রাহাত মোড়ল ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। তার শিক্ষাবর্ষ ছিল ২০১২-১৩। তিনি দাবি করছিলেন, তার স্নাতক শেষ হলেও মাস্টার্সে অধ্যয়নরত আছেন এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। অপরদিকে ছাত্রসংসদের সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক আশিক ছিলেন ডিগ্রির ছাত্র। যেখানে সাত কলেজেই ডিগ্রির পড়াশোনাই নেই সেখানে ছাত্রসংসদের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন তিনি।

পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রদানের ব্যর্থতা
কমিটির মেয়াদ ১ বছর ৯ মাস হলেও এত দীর্ঘ সময়ে আংশিক কমিটির পূর্ণাঙ্গতা দানে ব্যর্থ রাহাত-আশিক নেতৃত্ব। জানা যায়, কমিটি পূর্ণ না করে সবাইকেই ব্যবহার করেছেন তারা। এসময় সাবেক কমিটির বিভিন্ন পদ প্রত্যাশীরা জানান, কেন্দ্রের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে আমাদের চলাফেরা পছন্দ করতেন না তারা। একারণেই তারা পূর্ণাঙ্গ কমিটি না দিয়ে আমাদের হাতে রাখার চেষ্টা করেছে।

চাঁদাবাজি 
রাহাত-আশিক নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে রয়েছে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে বিপুল পরিমাণ চাঁদাবাজির অভিযোগ। একটি সূ‌ত্র জানিয়েছে, আমাদের ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠানগুলো কেন অফিসার্স কাউন্সিলে আয়োজন করা হয় জানেন? কারণ বড় করে অডিটোরিয়ামে আয়োজন করার উদ্যোগ নিলেই সেখানে ছাত্রলীগের নেতারা ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করতো! আপনিই বলেন সব অনুষ্ঠানে এত টাকা চাঁদা দেওয়া সম্ভব? একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করতে কত টাকাই বা বরাদ্দ থাকে আর কত টাকাই বা খরচ হয়! এসব কারণেই আমরা অফিসার্স কাউন্সিল মিলনায়তনে ঘরোয়াভাবে বেশিরভাগ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতাম।

নারী কেলেঙ্কারি 
ছাত্রসংসদের সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক আশিকের বিরুদ্ধে রয়েছে নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ। ছাত্রসংসদের ভেতরে নিয়ে ছাত্রলীগেরই প্রাক্তন এক নারী কর্মীকে মারামারি ও শ্লীলতাহানির অভিযোগ ওঠে সম্পাদক আশিক ও তার অনুসারীরা। তুশি জাহান নামে এক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী জানান, ইংরেজি বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের মুরাদ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মাসুদ শিকদার ইনসানের অনুসারী। মুরাদ ক্যাম্পাসে ভুক্তভোগীর কিছু বান্ধবীদের সামনে তার জামা ধরে টান দেয়। এমনকি তাকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করবার হুমকিও প্রদান করে মুরাদ।

ছাত্রলীগের আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আশিক আবদুল্লাহ। তিনি বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসের নারী শিক্ষার্থীদের হয়রানি করতেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। ছাত্রীদের জোর করে প্রেমের প্রস্তাব করতেন তিনি। বেগতিক দেখলে দিতেন হুমকি।

সাংবাদিক নির্যাতন 
রাহাত-আশিক জুটির নেতৃত্বে সোহরাওয়ার্দী কলেজে একাধিকবার একাধিক সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে কথা হয় সে সময়কার দৈনিক আমার বার্তার প্রতিনিধির সঙ্গে। তিনি জানান, সেদিন ছিল ২৬ শে মার্চ, জাতীয় দিবসের সঞ্চালনা করছিলেন আমার ডিপার্টমেন্টের একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। এসময় সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি বাংলা বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের জুনায়েদ ইসলাম এসে সঞ্চালকের সামনে থেকে মাইক্রোফোন নিয়ে যায়।

এর কারণ ছিল অনুষ্ঠানের ব্যানারে উনাদের নেতাদের নাম না থাকা। আমার ফোনে সে সময়ের কিছু ফুটেজ ছিল। হঠাৎ আমার দিকে চোখ পড়তেই ফোন নিয়ে যায়। পরবর্তীতে নেক আবেদন করে ফোন ফেরত নিলাম। তিনি আমাকে ত্যাম্পাসে না ডুকার হুমকিও দেন। 

পরীক্ষা চলাকালীন বাথরুমে বসে প্রশ্নের সমাধান বিক্রি
পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে এক হাজার টাকার বিনিময়ে প্রশ্নের উত্তর সমাধান করে পরীক্ষার্থীদের মাঝে বিক্রির অভিযোগ উঠে সোহরাওয়ার্দী কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহরিয়ার রাহাত মোড়ল ও তার কয়েকজন কর্মীর বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় ডেইলি ক্যাম্পাসের। তিনি জানান, সেদিন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ইংরেজি বিষয়ের পরীক্ষা ছিল। 

পরীক্ষা শেষ করে হল থেকে বের হয়ে জানতে পারি এক হাজার টাকায় কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও তার কর্মীরা প্রশ্নের সমাধান বিক্রি করেছে। বেশ কয়েকজন তা দিয়ে পরীক্ষাও দিয়েছে। আবার অনেকে টাকা দিয়ে কেনা সেই উত্তরপত্র নিয়ে পরীক্ষার হলে ধরা পড়েছে।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হস্তক্ষেপ 
রাহাত-আশিক জুটির সময় ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা মুক্তবুদ্ধিচর্চার সুযোগ পেতো না। যদি নিজেদের মতাদর্শের সঙ্গে অন্য কেউ ভিন্নতা প্রদর্শন করতো তবে তাকে দেখানো হতো বিভিন্ন ভয়ভীতি। এমনকি অভিযোগ রয়েছে শিবিরের ট্যাগ দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ারও। এছাড়াও রাহাত-আশিকের অনুসারীরা বিভিন্ন বিভাগের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ থেকে গোপনীয় কথোপকথন সংগ্রহ করে পরবর্তীতে চালানো হতো সম্পন্ন ব্যাচের উপর অমানুষিক অত্যাচার। 

এ বিষয়ে ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে কথা হয় ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থীর। তিনি জানান, প্রথম বর্ষে আমাদের এক ব্যাচমেট (মেয়ে)। আমাদের প্রাইভেট ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে বলছিল আমার ছাত্রলীগ পছন্দ না। কোন এক একজন সে কথা বড় ভাইদের বলে দিয়েছিল। পরে ডিপার্টমেন্টের ছাত্রলীগের এক বড় ভাই আমাদের পুরো ব্যাচের সামনে ঐ মেয়েকে চেয়ার দিয়ে মারতে আসছিল। আমরা ঐদিন কিছু বলতে পারিনি। 

আরেক ভুক্তভোগী জানান, যেদিন আমাদের কলেজের ছাত্রদলের কমিটি প্রকাশ করে। সেদিন আমি তাদের ছবি আমার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শেয়ার করেছিলাম। আমি কোন রাজনীতি সঙ্গে যুক্ত নই শুধুমাত্র ক্যাম্পাসের বড় ভাই হিসেবে অন্য সবার সঙ্গে আমার যেমন সর্ম্পক তেমনটাই ছাত্রদলের তাদের সঙ্গে। সামান্য বড় ভাইদের এ ছবি শেয়ারের কারণে আমাকে নানা ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। আমাকে জামায়াত শিবিরের ট্যাগ দিয়ে বিভিন্ন ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়। তার কয়েকঘণ্টা পরে আমি পোস্টটি ডিলিট করতে বাধ্য হই। 

এছাড়াও রাহাত-আশিক জুটির অনুসারীরা একাধিকবার সোহরাওয়ার্দী কলেজের ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি কাউসার আলীকে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও মারধর করেন। এ বিষয়েও অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে।

চলমান বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে (৫ আগস্ট) সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে গেলে সেদিনই সোহরাওয়ার্দী কলেজের ছাত্রসংসদের দখল নেয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এসময় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কোন অনুসারীদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও ছাত্রলীগের দায়িত্বশীল কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।