অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিনে শাহবাগ-টিএসসি, শহীদ মিনার ও ঢামেকের চিত্র
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিন সারা দেশে দফায় দফায় সংঘর্ষে শিক্ষার্থী-পুলিশ-সাংবাদিক ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীসহ প্রায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় প্রায় সহস্রাধিক ব্যক্তি আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়েছে। এক দফা দাবি আদায়ে সোমবার (৫ আগস্ট) ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।
রবিবার (৪ আগস্ট) রাজধানীর শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তন কেন্দ্র (টিএসসি), শহীদ মিনার এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকার তথ্য সংগ্রহ করেছে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস। নিচে রিপোর্টারের চোখে দেখা এই স্থানগুলোর চিত্র তুলে ধরা হলো।
শাহবাগ
বেলা ১১টার দিকে শাহবাগে গিয়ে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকে শিক্ষার্থীদের ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করা হচ্ছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ইট নিক্ষেপ করছেন। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার এক পর্যায়ে পিজি হাসপাতালের ভেতর থেকে কালো ধোয়া বের হতে দেখা যায়। পূবালী ব্যাংকের সামনে গিয়ে দেখা যায়, পিজি হাসপাতালের ভেতরে রাখা গাড়িগুলোতে আগুন জ্বলছে। তবে কারা আগুন লাগিয়েছে সেটি তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। শিক্ষার্থীরা বলছেন, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মোটরসাইকেল এবং গাড়িতে আগুন লাগিয়েছে।
পরে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ পিজি হাসপাতালের গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ধাওয়া দেয়। এ সময় আন্দোলনকারীরা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি নিয়ে আসার চেষ্টা করলেও তা সম্ভব হয়নি। পরে দুপুর ১টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ির ঘটনাস্থলে নিয়ে আসা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে যানবাহনে আগুন
শাহবাগ থানার সামনে পুলিশ-শিক্ষার্থীর সহাবস্থান
দুপুর দেড়টার দিকে শাহবাগ থানার সামনে গিয়ে দেখা যায়, থানার সামনে বিপুল সংখ্যক পুলিশ অবস্থান করছেন। পুলিশের ঠিক সামনেই শিক্ষার্থী-জনতার একটি দল রাস্তায় বসে আছেন। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পুলিশের উপর যেন কেউ আঘাত করতে না পারে সেজন্য তারা সেখানে অবস্থান করছেন। এ সময় টিএসসি থেকে শিক্ষার্থীদের খণ্ড খণ্ড মিছিল শাহবাগের দিকে যাচ্ছিল।
রাজু ভাস্কর্যে ছাত্র-জনতার অবস্থান, লাশ নিয়ে মিছিল
দুপুর দুইটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে ছাত্র এবং সাধারণ মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। সেখানে তারা এক দফা আদায়ে নানা ধরনের স্লোগান দিচ্ছিলেন। বিকেল ৫টার পর শাহবাগ থেকে এক আন্দোলনকারী রিকশাযোগে রাজু ভাস্কর্যের দিকে এগিয়ে এসে আন্দোলনকারীদের শাহবাগের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আহবান জানান। এ সময় তাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমাদের ভাইদের উপর আক্রমণ করা হয়েছে, আপনারা দ্রুত শাহবাগের দিকে অগ্রসর হোন।
এর কিছুক্ষণ পর শহীদ মিনারের দিক থেকে দুটি মরদেহ রাজু ভাস্কর্যে নিয়ে আসা হয়। লাশ নিয়ে ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা দুইজনই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। গুলিতে নিহত হওয়ার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে তাদের মরদেহ নিয়ে আসা হয়েছে। পরে আন্দোলনকারীরা লাশ দুটি নিয়ে শাহবাগের দিকে রওনা হয়। লাশ নিয়ে যাওয়া মিছিলটি শাহবাগ থানার সামনে পৌঁছালে আন্দোলনকারীরা শাহবাগ থানার ভেতরে থাকা পুলিশকে লক্ষ করে ইট, পানির বোতল নিক্ষেপ করে। এ সময় পুলিশ থানার গেটের সামনে থেকে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ শুরু করলে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
ঢাকা মেডিকেলে গুলিবিদ্ধ রোগীদের ভিড়
দুপুর ৩টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় প্রায় ২২ জন ব্যক্তি জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ। কিছুক্ষণের মধ্যেই একের পর এক গুলিবিদ্ধ ব্যক্তি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসতে থাকেন। কারো চোখে গুলি, কারো পায়ে, কারো তলপেটে, পিঠে। রোগীর চাপে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ভিড় বেড়ে যায়। এ সময় একটি দলকে রক্ত জোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে যান। অন্য আরেকটি দল রোগীর স্বজনদের সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। বিকেল সাড়ে ৪টার পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেলে প্রায় ৮০ জন আহত ব্যক্তি চিকিৎসা নেন। যাদের অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ।
হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ শিক্ষার্থী ও অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ
হঠাৎ দ্রুত গতির একটি অ্যাম্বুলেন্স জরুরি বিভাগের সামনে আসেন। ভেতর থেকে একজন ব্যক্তিকে দ্রুত স্ট্রেচার নিয়ে আসার অনুরোধ করা হয়। হাসপাতালে কর্মরত ব্যক্তিরা স্ট্রেচার নিয়ে আসলে অ্যাম্বুলেন্স থেকে এক তরুণকে বের করে দ্রুত ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকরা তাকে অবজারভেশন রুমে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জানান ওই তরুণ মারা গেছেন।
তরুণের সাথে থাকা তার বন্ধু পরিচয় দেওয়া জহুরুল নামে এক ব্যক্তি জানান, নিহত তরুণের নাম আব্দুল্লাহ। তিনি রাজধানীর হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। রাজধানীর ঝিগাতলায় গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাকে পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন।
আব্দুল্লাহর মৃত্যুর তথ্য সংগ্রহ করার সময় হাসপাতালের কর্মচারীদের অজ্ঞাত এক ব্যক্তির মরদেহ স্ট্রেচারে করে নিয়ে যেতে দেখা যায়। এ সময় দায়িত্বরত জিজ্ঞেস করা হলে তারা জানান, নিহত ব্যক্তির নাম-পরিচয় জানা যায়নি। অজ্ঞাত হিসেবে লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের চিত্র
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা গুরুতর আহত রোগীদের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়। সেখানে প্রবেশ করে ৬ জনকে চিকিৎসা নিতে দেখা যায়, এদের মধ্যে দুইজনের মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছিল। বাকিদের ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। ইমারজেন্সি বিভাগে রক্তের গন্ধে থাকা কষ্টকর হচ্ছিল।