২৯ জুলাই ২০২৪, ১৮:৪২

কোটা আন্দোলনে না জড়িয়েও গুলিবিদ্ধ, সুদে টাকা নিয়ে মেটাচ্ছেন চিকিৎসা খরচ

আহত রাব্বি  © টিডিসি ফটো

মো. রাব্বির গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর জেলায়। ঢাকার নারায়নগঞ্জের সানারপাড় এলাকায় গ্রাহক পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সরবরাহের একটি ছোট প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। গত ২০ জুলাই দুপুরের দিকে হাত খরচের টাকার জন্য প্রতিষ্ঠান মালিকের কাছে গিয়ে ফিরতি পথে কোটা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের মাঝে পড়ে যান। এরমধ্যে গুলিতে আহত হয়ে রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকেন। রাস্তায় পড়ে থাকা অবস্থায় পকেটে থাকা প্রায় ২৫ হাজার টাকা মূল্যের মোবাইল ফোন এবং পকেটে থাকা নগদ ৫ হাজর টাকা কেউ নিয়ে যায়।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে বিক্ষোভ-সংঘাতে নিহতদের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান এখনো জানা যায়নি। বিভিন্ন হাসপাতাল, মরদেহ নিয়ে আসা ব্যক্তি ও আত্মীয়-স্বজন থেকে পাওয়া সূত্রে অনুযায়ী এ পর্যন্ত দেশজুড়ে ২১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিদিনই মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। তবে আন্দোলন ঘিরে দেশজুড়ে কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। হারিয়েছেন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। সব থেকে বেশি হতাহতের খবর পাওয়া যায় ১৭ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত।

‘তাছাড়া বর্তমানে সুদের উপর টাকা নিয়ে ভাইয়ের চিকিৎসা চালাচ্ছি। কিন্তু যে পরিমাণ খরচ এখন নতুন করে টাকা নিয়ে যে চিকিৎসা চালাবো সেটাও সম্ভব হবে না। ইতোমধ্যে যে পরিমাণ দেনা তৈরি হয়েছে সেটা শোধ করতেও অনেকদিন লেগে যাবে। তার উপর সামনে কি আছে কপালে সেটা অনিশ্চিত। আমরা গরীব হওয়ার কারণে কোথাও যেন জীবনের মূল্যটুকু নেই-কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন মো. রাব্বির বড় ভাই

সংঘর্ষে গুরুতর আহত অবস্থায় যারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন তাদের কারও হাতে কারও পায়ে, পিঠে, বুকে এমনকি শরীরের একাধিক স্থানে গুলি লেগেছে। অনেকের শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে গুলিবিদ্ধ হওয়ায় অপারেশনের পরও সেগুলো বের করা সম্ভব হয়নি। ফলে শরীরে গুলি নিয়েই বাকি জীবন কাটাতে হবে তাঁদের। 

আরও পড়ুন: কোটা আন্দোলনে জড়িত না থেকেও গুলিবিদ্ধ তারা

তবে সহিংসতার ঘটনাটি ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঘটলেও চিকিৎসাধীন অধিকাংশই খেটে-খাওয়া মানুষ। এমনটিই বলছে ঢামেক হাসপাতাল সূত্র। সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়েও একই চিত্র দেখা যায়। আহতদের বেশিরভাগ দিনমজুর, ড্রাইভার, পথচারী কিংবা বাসা বাসা বাড়িতে অবস্থানরত ছিলেন। 

নারায়নগঞ্জের সানারপাড় এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত রাব্বির বড় ভাই জানান, ‘আমাদের দারিদ্রতার সাথে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। ভাইয়ের গুলি লাগার ঘটনাটি আমাদের আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছ। তার গুলি লেগেছে প্রায় কিডনির কাছাকাছি। ডাক্তার বলেছে কিডনিতে আঘাত পেয়েছে। এই বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত করেছে আমাকে। বিষয়টি পরিবারের অন্যদেরও জানাতে পারিনি। এভাবে কতদিন সুস্থভাবে বাঁচবে সেটাও জানি না।’ 

তিনি আরও যোগ করেন, ‘তাছাড়া বর্তমানে সুদের উপর টাকা নিয়ে ভাইয়ের চিকিৎসা চালাচ্ছি। কিন্তু যে পরিমাণ খরচ এখন নতুন করে টাকা নিয়ে যে চিকিৎসা চালাবো সেটাও সম্ভব হবে না। ইতোমধ্যে যে পরিমাণ দেনা তৈরি হয়েছে সেটা শোধ করতেও অনেকদিন লেগে যাবে। তার উপর সামনে কি আছে কপালে সেটা অনিশ্চিত। আমরা গরীব হওয়ার কারণে কোথাও যেন জীবনের মূল্যটুকু নেই।’

তিনি আরও জানান, ‘আমার নিজের উপার্জন সীমিত। দুটো ছোট বাচ্চা আছে। অন্য ভাইয়েরাও তেমন বিত্তবান নয়। আমাদের এখন নিয়মিত ভাইয়ের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করাটা অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে। যারা এই হামলা চালিয়েছে, অকারণে নিরপরাধ মানুষদের গুলিবিদ্ধ করেছে তাদের উচিত সম্পূর্ণ চিকিৎসার ভার বহন করা। প্রধানমন্ত্রী ১০ হাজার টাকা দিয়ে গেছে। কিন্তু এই টাকায় কি হবে? আমরা কোন অপরাধ না করেও কেন নির্যাতনের শিকার হচ্ছি?’

‘আমার পরিবারের একমাত্র উপার্জন করা ছেলেটি হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে। গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) রাত ১০ টায় উত্তরায় হাউজ বিল্ডিং এলাকায় মিজান মালিকের গাড়ি পার্ক করে বাসায় যাচ্ছিলেন। এমন সময় রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসার সময় হঠাৎ উপর থেকে গুলি এসে তার পিঠের ডান পাশের উপরের অংশে লাগে। গুলি যেভাবে লেগেছিল, তাতে বুকের ডান পাশ দিয়ে গুলি বের হওয়ার কথা। কিন্তু গুলিটা বুকের ডান পাশের নিচের অংশ দিয়ে বের হয়ে যায়। কেউ যদি রাস্তা থেকে গুলি করত তাহলে এমন আড়াআড়ি গুলি লাগার কথা না-কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন মো. মিজানুর রহমানের বাবা

আহতদের সাথে কথা বলতে চাইলে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, আমাদের কোন অপরাধে গুলি করা হয়েছে সেটাই জানি না। যদি কোনও অপরাধ করতাম তাহলে পুলিশ ধরে নিয়ে যেতো! আন্দোলনে সম্পৃক্ততা পেলে শাস্তি দিতো। কিন্তু এভাবে কোনও কারণ ছাড়া পুলিশ গুলি করে হাসপাতালে পাঠালো। আমরা নিম্ন আয়ের মানুষ, তাই বলে কি জীবনের নিরাপত্তাটুকু পাওয়ার অধিকার রাখি না? এই পরিস্থিতিতে পরিবারের দায়িত্ব নিবে কে? আমাদের এই পঙ্গুত্ব নিয়ে বাঁচব কিভাবে?

আরও পড়ুন: ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিপুল প্রাণহানির দায় প্রধানত সরকারের’

সুনামগঞ্জের আরেক বাসিন্দা মোতালেব। পেশায় রাজমিস্ত্রী মোতালেবের বয়স ২৫ বছর। নারায়নগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় দুই ভাই এবং বাবার সাথে থাকেন। দুই ভাই এবং বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালান। গত ১৯ জুলাই বিকেলে রাজমিস্ত্রীর কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলেন। এমন সময় আচমকা গুলি লাগে পায়ে। সেখানেই পড়ে থাকেন। পরে খবর পেয়ে মোতালেবের পরিবার  ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসে।

‘আমাদের কোন অপরাধে গুলি করা হয়েছে সেটাই জানি না। যদি কোনও অপরাধ করতাম তাহলে পুলিশ ধরে নিয়ে যেতো! আন্দোলনে সম্পৃক্ততা পেলে শাস্তি দিতো। কিন্তু এভাবে কোনও কারণ ছাড়া পুলিশ গুলি করে হাসপাতালে পাঠালো। আমরা নিম্ন আয়ের মানুষ, তাই বলে কি জীবনের নিরাপত্তাটুকু পাওয়ার অধিকার রাখি না? এই পরিস্থিতিতে পরিবারের দায়িত্ব নিবে কে? আমাদের এই পঙ্গুত্ব নিয়ে বাঁচব কিভাবে?’

হাসপাতালের বেডে শুয়ে মোতালেব জানান, ‘এই মুহূর্তে আমার কোন রোজগারের সুযোগ নেই। বাবা ভাই তারাও আমার সাথে হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতির জন্য দায় কে নিবে? প্রতিদিনের উপার্জন করা অর্থ দিয়ে আমাদের পরিবার চলে। অথচ ১০ দিন হল এখানে শুয়ে আছি। আমাদের আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নাই। কারও কাছে সহযোগিতা চাইব সেই সুযোগও নাই।’

আরেক ভুক্তভোগী পেশায় প্রাইভেট কার চালক মিজানুর রহমান গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) রাতে উত্তরায় হাউজ বিল্ডিং এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তিটির আকস্মিক গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকায় পরিবারটি প্রায় নিঃস্ব হওয়ার পথে। ছেলের এই অবস্থার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিলেন মিজানুরের বাবা। 

আরও পড়ুন: চট্টগ্রামে পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ, বিক্ষোভকারীরা ছত্রভঙ্গ

মো. মিজানুর রহমানের বাবা জানান, ‘আমার পরিবারের একমাত্র উপার্জন করা ছেলেটি হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে। গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) রাত ১০ টায় উত্তরায় হাউজ বিল্ডিং এলাকায় মিজান মালিকের গাড়ি পার্ক করে বাসায় যাচ্ছিলেন। এমন সময় রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসার সময় হঠাৎ উপর থেকে গুলি এসে তার পিঠের ডান পাশের উপরের অংশে লাগে। গুলি যেভাবে লেগেছিল, তাতে বুকের ডান পাশ দিয়ে গুলি বের হওয়ার কথা। কিন্তু গুলিটা বুকের ডান পাশের নিচের অংশ দিয়ে বের হয়ে যায়। কেউ যদি রাস্তা থেকে গুলি করত তাহলে এমন আড়াআড়ি গুলি লাগার কথা না।’

তিনি আরও বলেন, ‘ছেলেটা মৃত্যুর সাথে লড়ছে। কবে সুস্থ হবে তাও জানা নেই। ওয়ার্ডে চিকিৎসারত যারা ছিল প্রধানমন্ত্রী দেখতে এসে সবাইকে ১০ হাজার টাকা করে দিয়ে গেছেন। কিন্তু এটাই কি সমাধান? আমার পরিবার কে চালাবে? আমি ত গরীব মানুষ, ছেলের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে হয়। ইতোমধ্যে অনেক টাকা ধার করে এনেছি। কিন্তু আমার ছেলেকে আগের মতো সুস্থতা দিবে কে? কেন সে গুলি খেল? তার দোষ কি? যদি আগের মতো পরিবারের হাল ধরতে সক্ষম না হয়, তাহলে আমাকে দেখবে কে?’