২৮ জুলাই ২০২৪, ১৮:১৭

কোটা আন্দোলনে জড়িত না থেকেও গুলিবিদ্ধ তারা

গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন একজন  © ফাইল ছবি

আব্দুর রহিম (২৮)। রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় একটি ওয়ার্কশপে কাজ করেন। গত ১৮ জুলাই দুপুরের দিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রামপুরা এলাকায় সংঘর্ষ চলাকালীন ভয়ে দোকান বন্ধ করে বাসায় ফিরছিলেন। পথেই আচমকা গুলিতে পড়ে যান তিনি। উপস্থিত মানুষের সহায়তায় প্রথমে বেসরকারি একটি হাসপাতালে নেয়া হলেও পরবর্তীতে পরিবারের সহায়তায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।

বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আব্দুর রহিমের মা রাহেলা বেগম জানান, ‘আমার ছেলের বয়স ২৮ বছর। কোনো প্রকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে কখনও তার সম্পৃক্ততা ছিল না। ওয়ার্কশপে কাজ করলেও কখনো তার কোনো বদ অভ্যাস ছিল না। গুলিতে তার পায়ের অবস্থা ভালো না। কতটুকু সুস্থতা ফিরে পাবে সে ব্যাপারে ডাক্তাররাও তেমন নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না।’ 

‘আমার ছেলেকে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয়েছে। নিরপরাধ ছেলেটা কোনোদিন খারাপ কিছুর সাথে যুক্ত হয়নি। রাজনীতির ধারে কাছেও ছিল না। কিন্তু অমানুষের মতো তাকে গুলি করে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। এখন সে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। কবে সুস্থ হবে তাও জানা নেই। ওয়ার্ডে যারা ছিল প্রধানমন্ত্রী দেখতে এসে সবাইকে ১০ হাজার টাকা করে দিয়ে গেছেন। কিন্তু এটাই কি সমাধান? আমার ছেলেকে আগের মতো সুস্থতা দিবে কে? কেন সে গুলি খেল? তার দোষ কি?’-কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন মো. মিজানুর রহমানের বাবা

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে বিক্ষোভ-সংঘাতে নিহতদের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান এখনো জানা যায়নি।  বিভিন্ন হাসপাতাল, মরদেহ নিয়ে আসা ব্যক্তি ও আত্মীয়-স্বজন থেকে পাওয়া সূত্রে অনুযায়ী এ পর্যন্ত দেশজুড়ে ২০৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিদিনই মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। তবে আন্দোলন ঘিরে দেশজুড়ে কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। হারিয়েছেন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। সব থেকে বেশি হতাহতের খবর পাওয়া যায় ১৭ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত।

সংঘর্ষে গুরুতর আহত অবস্থায় যারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন তাদের কারও হাতে কারও পায়ে, পিঠে, বুকে এমনকি শরীরের একাধিক স্থানে গুলি লেগেছে। অনেকের শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে গুলিবিদ্ধ হওয়ায় অপারেশনের পরও সেগুলো বের করা সম্ভব হয়নি। ফলে শরীরে গুলি নিয়েই বাকি জীবন কাটাতে হবে তাঁদের। 

আরও পড়ুন: আহতদের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা দিলেন প্রধানমন্ত্রী

চিকিৎসকেরা জানান, সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় হাত-পা হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন অনেকে। চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন হাত-পা যাতে কেটে ফেলতে না হয়। তবুও অনেকের শেষ রক্ষা হবে কি না, নিশ্চিত নয়। তাদের কারও লেগেছে একটি গুলি, কারও একাধিক; ছররা গুলিও শরীরে নিয়ে বিছানায় কাতরাচ্ছেন অনেকে। 

‘সুমনের বাম বাহুতে গুলি লেগে হাড় ভেঙ্গে অপর পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। হাতটা ভেঙ্গে গেছে। কিন্তু এই হাত কতটা সুস্থ হবে জানা নেই। ভাইয়ের ছোট দুটি সন্তান আছে। তাদের কি হবে? আমরা নিম্ন আয়ের মানুষ। আমাদের প্রতিদিনের উপার্জন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যেটা হয়েছে সেটা অন্যায়। এই বিচার কার কাছে চাইব জানা নেই। একমাত্র উপরওয়ালার কাছে চোখের পানি ফেলছি। তিনিই এর বিচার করবেন।’-কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন সুমনের বড় ভাই

বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষে হতাহতরা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তবে চিকিৎসাধীন রোগী এবং স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আহতদের বেশিরভাগ পুরো ঘটনায় কোন প্রকার বিক্ষোভ কিংবা সংঘর্ষে অংশ নেননি। বরং বেশিরভাগ নিম্ন আয়ের মানুষ হওয়ায় জরুরি কাজে কিংবা জীবিকার তাগিদে বাসা থেকে বের হয়ে হতাহতের শিকার হয়েছেন। অনেকে সংঘর্ষের মাঝে পড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পালাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।

মো. মিজানুর রহমানের বাবা জানান, ‘গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) আমার ছেলে রাত ১০ টায় উত্তরায় হাউজ বিল্ডিং এলাকায় মালিকের গাড়ি পার্ক করে বাসার দিকে যাচ্ছিলেন। এমন সময় রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসার সময় হঠাৎ উপর থেকে গুলি এসে তার পিঠের ডান পাশের উপরের অংশে লাগে। গুলি যেভাবে লেগেছিল, তাতে বুকের ডান পাশ দিয়ে গুলি বের হওয়ার কথা। কিন্তু গুলিটা বুকের ডান পাশের নিচের অংশ দিয়ে বের হয়ে যায়। কেউ যদি রাস্তা থেকে গুলি করত তাহলে এমন আড়াআড়ি গুলি লাগার কথা না।’

আরও পড়ুন: কোটা আন্দোলনে ৪ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষতি ৩ কোটিরও বেশি

তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছেলেকে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয়েছে। নিরপরাধ ছেলেটা কোনোদিন খারাপ কিছুর সাথে যুক্ত হয়নি। রাজনীতির ধারে কাছেও ছিল না। কিন্তু অমানুষের মতো তাকে গুলি করে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। এখন সে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। কবে সুস্থ হবে তাও জানা নেই। ওয়ার্ডে যারা ছিল প্রধানমন্ত্রী দেখতে এসে সবাইকে ১০ হাজার টাকা করে দিয়ে গেছেন। কিন্তু এটাই কি সমাধান? আমার ছেলেকে আগের মতো সুস্থতা দিবে কে? কেন সে গুলি খেল? তার দোষ কি?’ 

বরিশালের মো. সুমন উত্তরার আরেকজন প্রাইভেট কার চালক। গত ১৮ জুলাই উত্তরায় ড্রাইভিং শেষে প্রাইভেট কার পার্ক করে বাসায় ফেরার পথে রাস্তায় পুলিশের গুলিতে আহত হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন মো. সুমন। তত্ত্বাবধানে থাকা তার বড় ভাই জানান, ‘আমিও পেশায় প্রাইভেট কার চালক। আমার ভাই কোনো অন্যায় করেননি। গত ১৮ জুলাই বাসায় ফেরার পথে রাস্তায় তিনি গুলিতে আহত হন।’

এ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর পরিদর্শনের সময় চিকিৎসাধীন ব্যক্তি কিংবা পরিবারের হাতে ১০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়। এর বাহিরে কিছুসংখ্যক ভুক্তভোগী কর্মস্থল থেকে কিছুটা আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। কিন্তু সার্বিকভাবে এই আর্থিক সহায়তার চেয়ে খরচের পরিমাণ অনেক বেশি। ফলে চিকিৎসার ব্যয়ভার সামলাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে ভুক্তভোগী পরিবারদের।

আহত সুমনের বড় ভাই আরও জানান, ‘সুমনের বাম বাহুতে গুলি লেগে হাড় ভেঙ্গে অপর পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। হাতটা ভেঙ্গে গেছে। কিন্তু এই হাত কতটা সুস্থ হবে জানা নেই। ভাইয়ের ছোট দুটি সন্তান আছে। তাদের কি হবে? আমরা নিম্ন আয়ের মানুষ। আমাদের প্রতিদিনের উপার্জন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যেটা হয়েছে সেটা অন্যায়। এই বিচার কার কাছে চাইব জানা নেই। একমাত্র উপরওয়ালার কাছে চোখের পানি ফেলছি। তিনিই এর বিচার করবেন।’

আরও পড়ুন: প্রবাসী আয়ে ভাটা, ৬ দিনেও আসেনি ১ দিনের সমান রেমিট্যান্স

শুধু আব্দুর রহিম, সুমন কিংবা মিজানুর রহমান ছাড়াও কোটা সংস্কার আন্দোলনে ভুক্তভোগীদের বড় একটি অংশ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত না থেকেও হতাহতের শিকার হয়েছেন। অনেকের অঙ্গহানি হয়েছে কিংবা শঙ্কায় রয়েছেন। এতে ভবিষ্যতে পারিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন কিংবা স্বাচ্ছন্দে বেচেঁ থাকা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে তাদের। 

কোটা বিরোধী সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর পরিদর্শনের সময় চিকিৎসাধীন ব্যক্তি কিংবা পরিবারের হাতে ১০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়। এর বাহিরে কিছুসংখ্যক ভুক্তভোগী কর্মস্থল থেকে কিছুটা আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। কিন্তু সার্বিকভাবে এই আর্থিক সহায়তার চেয়ে খরচের পরিমাণ অনেক বেশি। ফলে চিকিৎসার ব্যয়ভার সামলাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে ভুক্তভোগী পরিবারদের।