কোটা আন্দোলন অব্যাহত থাকলে সরকার কি কঠোর হবে?
কোটা সংস্কার আন্দোলন এবারই নতুন নয়। ২০১৮ সালে প্রথমবার কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখে সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নিয়োগে কোটা পদ্ধতি তুলে দেয়। পরে পরিপত্র জারি করে সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত বা আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন কর্পোরেশনে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কোটা বাতিল করে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর নবম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত সরাসরি নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে একটি পরিপত্র জারি করে। সেখানে বলা হয়েছিল, ৯ম গ্রেড (পূর্বতন ১ম শ্রেণি) এবং ১০ম-১৩তম গ্রেড (পূর্বতন ২য় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাতালিকার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে। ওই পদসমূহে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হয়। নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, উপজাতি পাঁচ ও প্রতিবন্ধীদের এক শতাংশ কোটা বাতিল করা হয়।
এই পরিপত্রের মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ বতিল চ্যালেঞ্জ করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল ২০২১ সালে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করে। গত ৫ জুন রায় দেয় হাইকোর্ট। রায়ে সরকারের পরিপত্র বাতিল করে মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ কোটা বহাল রাখার আদেশ দেয়া হয়।
এই রায়ের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রপক্ষ’ আবেদন করলে ৪ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে নিয়মিত আপিল করতে বলেন। ফলে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ ও আপিল নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে কোটা বহাল থাকছে। এরপর থেকে এখনো কোটা সংস্কারপন্থি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলামান রয়েছে।
এদিকে, গত বুধবার (১০ জুলাই) সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করেছেন আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে আগামী চার সপ্তাহ পর বিষয়টি পরবর্তী শুনানি করার জন্য দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, আদালত নয়, জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে কোটা সমাধান করতে হবে।
চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা জারির পর অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছেন, আপিল বিভাগের রায়ের পর কোটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের আর কোনো যৌক্তিকতা নেই। তিনি বলেন, আপিল বিভাগের আগের রায়ের স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে বলেছেন। অর্থাৎ যেমন আছে, তেমন থাকবে। কোটা বাতিলসংক্রান্ত ২০১৮ সালের পরিপত্রের ভিত্তিতে যেসব সার্কুলার দেওয়া হয়েছে, সে ক্ষেত্রে কোটা থাকছে না।
শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন নিয়ে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেছেন, তারা (কোটা আন্দোলনকারীরা) যেন অযথা সড়কে ভীড় না করে। লেখাপড়া নষ্ট না করে। তাদের প্রতি অনুরোধ, তারা নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাক।
এদিকে, আজ শুক্রবারও সারাদেশের সব ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ কর্মসূচি রয়েছে আন্দোলনকারীদের। আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম গতকাল বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) রাতে শাহবাগে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, শুক্রবার বিকেল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও হামলার স্থানে একযোগে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
শিক্ষার্থীদের অব্যাহত আন্দোলন নিয়ে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, জনগণের নিরাপত্তা, জনগণের চলাফেরার নিরাপত্তা ও জনগণের কাজ করার পরিবেশ রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের। এসব বিষয়গুলো নিশ্চিতে যদি কোনো ধরনের হুমকি তৈরি হয়, একইসঙ্গে সরকারকে যদি বাধ্য করা হয়— সেক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
আন্দোলন নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনের মতোই মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের রায় অমান্য করে কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে সময় নষ্ট করার যৌক্তিকতা নেই।
তিনি বলেছেন, আমি দেখেছি এখন যে কোটা আন্দোলন... সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা বাতিলের কথা বলা হচ্ছে, নারীদের কোটা বাতিল করতে হবে, অমুক-সমুক। সেটা কিন্তু একবার বাতিল করা হয়েছিল। কিন্তু ফলাফলটা কী? পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার হিসাব যদি দেখা যায়, দেখা যাবে যে আগে যেখানে কোটা থাকত মেয়েরা যে পরিমাণ সুযোগ পেত সেই পরিমাণ সুযোগ কিন্তু এই কয় বছরে পায়নি।
সতর্ক অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেছেন, আদালতের আদেশ মেনে চলার জন্য বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কোন ধরনের অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি পুলিশ বরদাশত করবে না।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি নিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর এক মাসের স্থিতাবস্থা দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বিষয়টি আদালতের। আদালতের প্রতি সবার আস্থা রাখা ও শ্রদ্ধা-সম্মান থাকা উচিত।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে এক মাসের বেশি সময় ধরে শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন চলছে। এর মধ্যে চলতি মাসের শুরু থেকে সড়ক-মহাসড়ক এমনকি রেলপথ অবরোধ করে তারা বিক্ষোভ করলেও সেই অর্থে কোনো বাধা দেয়নি পুলিশ। সরকার বা ক্ষমতাসীনেরাও মোটামুটি চুপচাপ ছিলেন। কিন্তু গতকাল বৃহস্পতিবার হঠাৎ করে বদলে গেল পরিস্থিতি। সব পক্ষের গলা চড়া। সবাই জোরেশোরে জানিয়ে দিল, শিক্ষার্থীদের আর রাস্তায় নামতে দেওয়া হবে না।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা আগের দিন বুধবারই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন, গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ৩টায় ঢাকাসহ সারা দেশে রাস্তায় ‘বাংলা ব্লকেড’ বা অবরোধ কর্মসূচি পালন করবেন। সে অনুযায়ী তাদের প্রস্তুতির মধ্যেই সকালে পুলিশ জানিয়ে দেয়, তাদের আর রাস্তায় নামতে দেওয়া হবে না।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ যে আদেশ দিয়েছেন, তারপরও আন্দোলনের কোনো ‘যৌক্তিকতা নেই’। আন্দোলনকারীদের সড়কে বসতে দেওয়া হবে না। তারা রাস্তায় নেমে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করলে ‘প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে’ বাধ্য হবে পুলিশ।
রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার খ মহিদ উদ্দিন বলেন, কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালের পরিপত্রকে বলবৎ রেখে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা দিয়েছেন আপিল বিভাগ। যে কারণে এই চার সপ্তাহ কোটা নিয়ে আন্দোলন করার কোনো অবকাশ বা প্রয়োজন আছে বলে ঢাকা মহানগর পুলিশ মনে করে না। রাস্তায় নেমে কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কোটা নিয়ে মুখে সম্মতি, ক্যাম্পাসে মারমুখী ছাত্রলীগ
কোটা সংস্কার আন্দোলনে আন্দোলনকারীরা পাশে পাচ্ছে না প্রায় সব ক্যাম্পাসে একক নিয়ন্ত্রণে থাকা ছাত্রলীগকে। উল্টো একাধিক ক্যাম্পাসে এই আন্দোলন দমনে বাধা, শোডাউন ও হামলার অভিযোগ উঠছে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে তাদের মৌন সম্মতি রয়েছে বলে জানা গেছে। ছাত্রলীগ বলছে, কোটাপদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনকে ‘রাজনৈতিক রূপ’ দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। তারা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অবিলম্বে ক্লাস-পরীক্ষায় ফেরার আহ্বান জানিয়েছে।
সংগঠনটি বলছে, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করেছে। বর্তমানে যা বিচারাধীন বিষয়। একটি বিষয় যখন আদালতের গণ্ডিতে প্রবেশ করে, তখন তার সমাধান আইনের কাঠামোতেই হতে হয়। এর জন্য প্রয়োজনীয় সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এ কথা কি আন্দোলনকারীরা জানেন না? পাশাপাশি স্থিতাবস্থার আদেশের পরবর্তী ধাপগুলো পর্যন্ত অপেক্ষা না করে কেন জনবিরোধী অবরোধ অব্যাহত রাখতে হবে, তা মানুষ জানতে চায়। জনগণকে জিম্মি করে তথাকথিত আন্দোলন চালানো হলে আন্দোলনকারীদের এটিও মনে রাখা দরকার, দেশের আইন বিভাগ সার্বভৌম, বিচার বিভাগ স্বাধীন ও নির্বাহী বিভাগ জনগণের ভোটে প্রতিষ্ঠিত। তাই অহেতুক কোনো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আন্দোলনের কাছে কেউ নতি শিকার করবে না।
ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেছেন, কোটার জন্য জনদুর্ভোগ না বাড়িয়ে আইনসংগত পদ্ধতি মেনে সমাধান করা যায়। তা বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়াও রয়েছে কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় আন্দোলনকারীরা যাচ্ছেন না। তবে মূল আন্দোলনকারীরা আদালতের রায় মেনে নিয়ে পড়ার টেবিলে ফিরে গেছে। বর্তমানে আদালতের স্থিতি আদেশ দেওয়ার পরেও যারা অবরোধ করছেন তারা প্রফেশনাল আন্দোলনকারী।