১৯ অক্টোবর ২০১৮, ২১:০০

সরকারি চাকরিতে ‘৩৫ চাই’: দ্বিধায় পড়েছে সরকার

‘৩৫ চাই’ আন্দোলন

‘৩৫’ ইস্যুতে দ্বিধায় পড়েছে সরকার। লাগাতার আন্দোলনের মুখে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর সুপারিশ করলেও তা বাস্তবায়নে গড়িমসি চলছে। আবার ৩৫ নাকি ৩২ হবে; সেটি নিয়েও চলছে নানা পর্যায়ের দেন-দরবার। যদিও সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়াতে সরকারও আন্তরিক। এজন্য সুপারিশও করা হয়েছে। তবে এটি নির্বাচনের আগে নাকি পরে বাস্তবায়ন করা হবে; সেটি নিয়েই ধন্ধ। সূত্রটির তথ্য, যেহেতু কোটা সংস্কার ইস্যুটি সমাধান হয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব এটিও হবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলছে, সরকারি চাকরিতে প্রবেশে বয়স বৃদ্ধির বিষয়টির প্রস্তাবনা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। যেহেতু চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এবং সরকারের নীতি নির্ধারণী বিষয়; তাই উচ্চ পর্যায়ের সম্মতি প্রয়োজন। তবে বিষয়টি নিয়ে যেকোন সময় সিদ্ধান্ত হতে পারে। জানা যায়, গত জুনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ২৯ তম সভায় সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ বছর করার সুপারিশ করা হয়। এর আগে কমিটির ২১ তম সভায় ৩২ বছর করার সুপারিশ করা হয়েছিল। তবে সরকার ইচ্ছা করলে সেটা আরও বাড়াতে পারে। কারণ, এটা নীতিনির্ধারণী বিষয়।

আরও পড়ুন: সবাই ৩৫ চায়, বাধা কোথায় জানিনা: ইমতিয়াজ হোসেন

হিসাবে কষে দেখা গেছে, বাংলাদেশে কোনভাবেই ২২ বছরের আগে শিক্ষাজীবন শেষ হয় না। অথচ দেশে সরকারি চাকরিগুলোয় আবেদনের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর। হিসাব অনুযায়ী, মাত্র ৫ বছরে শিক্ষাজীবন শুরু হলেও শুধু মাধ্যমিক পড়তেই জীবনের ১৫টি বছর চলে যায়। আর উচ্চমাধ্যমিক (১৭বছর), স্নাতক (২১বছর) ও স্নাতকোত্তর পড়তে লাগে ২২ বছর। সেক্ষেত্রে নন-পিএসসি চাকরি ক্ষেত্রে আবেদন শুরুর বয়স ১৮ বছর রাখার আইনটি একেবারেই অকার্যকর। আবার বর্তমানে ক্যাডারের ক্ষেত্রে ২১ বছর বয়সে আবেদনের আইনটিও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। 

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, সরকারি চাকরিতে আবেদন করার আগেই যদি জীবনের ৪টি বছর চলে যায়; তবে প্রবেশের  বয়স কেন ৩৫ হবে না? এ দাবি একেবারেই ‘যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত’। তারা বলছেন, কর্মে যোগদানের অধিকার আমাদের সাংবিধানিক অধিকার; সুনির্দিষ্ট বয়স দিয়ে তা থামিয়ে দেয়ার অধিকার কারো নেই। তাছাড়া চাকরিতে ৩০ রাখাটা তারুণ্যকে বেঁধে রাখার মত একটা ব্যাপার। এটা অনুচিত।

 ছ'বছর ধরে আন্দোলন করে আসছে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদ নামের এই সংগঠন

অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যমতে, পাকিস্তান আমলে চাকরি শুরুর বয়স ছিল ২৫ বছর। নতুন দেশে সরকারি চাকরি করার জন্যে দক্ষ লোক পাওয়া যাবে না বলে সেটা বাড়িয়ে ২৭ করা হয়েছিল। পরে ১৯৯১ সালে সেটাও তো বাড়িয়ে ৩০ করা হয়েছে।  ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে সেটা বাড়িয়ে করা হয় ৩০ বছর। ২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অবসরের বয়স ৫৭ থেকে বাড়িয়ে ৫৯ বছর করা হয়; যা এর কয়েকদিন পর ২৬ ডিসেম্বর কার্যকর হয়। মূলত এরপর থেকেই চাকরি চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর দাবি ওঠে চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে। এ নিয়ে আন্দোলনের পাশাপাশি সারা দেশে বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করেন তারা।

পড়ুন: সার্টিফিকেট পেতেই ২৫ বছর, কেন চাইব না ৩৫?

চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করার দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদের উপদেষ্টা ইমতিয়াজ হোসেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ২০১১ সালে সরকারি চাকরিতে অবসরের বয়স বাড়ানোর পর থেকেই তাদের আন্দোলন শুরু হয়। তিনি বলেন, ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ চাই’র প্রথম আন্দোলন হয়। সেদিন এই আন্দোলন শাহবাগে ব্যাপক সাড়া ফেলে। এরপর বর্তমান রাষ্ট্রপতি ও তৎকালীন স্পিকার সংসদে ৩৫-এর পক্ষে কথা বলেন। মূলত তখনই আন্দোলনটা সারা দেশে ছড়িয়ে যায়। তিনি যুক্তি দেখান, সরকারি নিয়ম অনুসরণ করে বেসরকারি ব্যাংকসহ বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও ৩০ বছরের বেশি বয়সীদের নিয়োগ দেয় না। ফলে বেসরকারি ক্ষেত্রেও চাকরির সুযোগ সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদের আহ্ববায়ক সঞ্জয় দাস বলেন, বাংলাদেশের বাস্তবতা ও শিক্ষাব্যবস্থার কথা বিবেচনা করতে হবে। তার ভাষ্য, ‘পড়াশোনা শেষ করতে করতেই তো অনেক বয়স হয়ে যায়। তখন আর চাকরি খোঁজার জন্যে পর্যাপ্ত সময় থাকে না।’

সঞ্জয় বলেন, আগে ছেলেমেয়েরা যে কোন সময়ে লেখাপড়া শুরু করতে পারত। তখন জন্ম নিবন্ধনের কোন বিষয় ছিল না। কিন্তু এখন জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেটে কমপক্ষে ৬ বছর দেখিয়ে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হতে হয়। ছয় বছর বয়সে কোন শিক্ষার্থী প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হলে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদালয়ে পড়াশোনার শেষ করে বয়স দাঁড়াবে ২৩ বছর। চাকরির পড়া কখন পড়বে? তাছাড়া বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।

বয়স বৃদ্ধির সমাধান শিঘ্রই আসবে: বলছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম

জানা গেছে, বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকটি দেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫। অধিকাংশ দেশেই এই বয়স ৪০ বা তারও বেশি। অথচ বাংলাদেশে তার চেয়েও কমিয়ে ৩০ বছরে রাখা হয়েছে। দেশের গড় আয়ু, মাথাপিছিু আয়সহ সার্বিক সূচক বাড়লেও বাড়ানো হয়নি এ বয়সসীমা। ছাত্র পরিষদের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, উন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৫৯ বছর। পার্শবর্তী দেশ ভারতে (পশ্চিমবঙ্গ) বয়সসীমা ৪০ বছর। উন্নত দেশ ফ্রান্সেও চাকরির এ বয়স ৪০ বছর। এছাড়া চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ৫৫ বছর রাখা হয়েছে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে। এ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, বাহরাইন, অস্ট্রেলিয়া, মালায়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কাতার, ওমান, কুয়েতসহ বেশ কয়েকটি দেশ। একমাত্র দেশ সুইডেন চাকরির বয়স ৪৭ বছর রেখেছে। চাকরির বয়স ৪৫ বছর রেখেছে যথাক্রমে ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলঙ্কা। এছাড়া চাকরির সর্বোচ্চ বয়স ৩৫ বছর রেখেছে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ। যার মধ্যে কাতার, তাইওয়ান, এঙ্গোলা, ইতালী ও নরওয়ে উল্লেখযোগ্য।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফয়েজ আহম্মদ বলেন, স্থায়ী কমিটির সুপারিশ যৌক্তিক।  আমরা সেটা যাচাই-বাছাই করছি। তবে সিদ্ধান্ত নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে আসবে। 

আর পরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধির বিষয়টি শিঘ্রই সমাধান হবে। প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে উঠলেই সুরাহা হবে।

লাগাতার অবস্থান ধর্মঘট শুরু

এদিকে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর না হওয়া পর্যন্ত শনিবার থেকে রাজধানীর শাহবাগে টানা অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদ। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সংগঠনটি এই ঘোষণা দেয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বাড়ানোর জন্য গত ২৭ জুন, ১০ সেপ্টেম্বর ও সর্বশেষ গত ১১ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সুপারিশ করে। সুপারিশটি ৪০তম বিসিএস পরীক্ষার আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগে বাস্তবায়ন না হওয়ায় আবার এই অবস্থান কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়েছে।

আন্দোলনকারী চাকরিপ্রত্যাশীরা গতকাল বৃহস্পতিবার শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে বেলা ১১টায় উপস্থিত হয়ে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করতে গেলে শারদীয় দুর্গা উৎসবের কারণ দেখিয়ে পুলিশ বাধা দেয়। পরে তারা জাতীয় প্রেসক্লাবে সামনে গিয়ে দাবির পক্ষে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। আন্দোলনকারীদের ঘোষণা, বয়সসীমা ৩৫ বছর বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা শাহবাগের জাদুঘরের সামনে টানা অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন। এর আগের অবস্থান কর্মসূচিতে ঢাকা, কুমিল্লা, রাজশাহী, ময়মনসিংহ থেকে আন্দোলনকারীরা যোগ দিয়েছেন। আর বাকিরা ২০ অক্টোবরের মধ্যে অবস্থান কর্মসূচিতে যোগ দেবেন।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্যে বর্তমানে চাকরি শুরু করার বয়স ৩০ বছর। আর মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, উপজাতি কোটায় এই বয়স ৩২, নার্সের চাকরির জন্যে ৩৬ আর বিভাগীয় প্রার্থীর কোটায় ৩৫ বছর।