১৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৬:৫৭

৫ কারণে রাবিতে অস্তিত্ব সংকটে বাম ছাত্রসংগঠন

  © ফাইল ফটো

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) এক সময় জাতীয় রাজনীতি থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থীর দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর দাপট ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে সবশেষ নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তাদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল দেখার মতো। কিন্তু তারপর থেকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে এই দাপট। বর্তমানে অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, কোনো কোনো সংগঠনের কমিটি গঠনের মতো সদস্যও নেই।

কয়েক বছর আগেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ এবং জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুর জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে সংগঠনগুলো। তাদের কর্মসূচিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ছিল স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। তবে বর্তমানে ক্যাম্পাসে সেই চিত্র আর নেই। গত কয়েক বছরে বদলে গেছে পুরো দৃশ্যপট। কালে-ভদ্রে দুয়েকটি প্রেস রিলিজ ছাড়া দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম করতে দেখা যায় না বাম সংগঠনগুলোর। 

ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের একক আধিপত্য, নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতা, কর্মী সংকট, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সরকারের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করা ও দেশের সার্বিক রাজনৈতিক অবস্থা— মোটা দাগে এই ৫ কারণে ক্যাম্পাসে বর্তমানে কোণঠাসা রয়েছে বাম ছাত্রসংগঠন ও তাদের কার্যক্রম। এমনটাই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা। 

ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর এক আধিপত্য ছিল। ভর্তি ফি কমানো, সান্ধ্য আইন বাতিল, সান্ধ্যকোর্স বাতিল, হলের খাবারের মান বৃদ্ধিসহ সাধারণ ছাত্রদের অধিকার আদায়ে তাদের ছিল অগ্রণী ভূমিকা। কিন্তু সেসব আজ ইতিহাস। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট— এই চারটি বাম রাজনৈতিক সংগঠন আছে। এই চারটি বাম সংগঠনকে একটি সংগঠনে রূপ দিয়ে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি মো. শাকিল। 

কর্মী সংকট, নিষ্ক্রিয়তা ও তাদের ভাবনা নিয়ে শাকিল বলেন, ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ একক আধিপত্য বিরাজ করেছে। বৈধ শিক্ষার্থীকে হল থেকে নামিয়ে দেওয়া, সিট বাণিজ্যের মতো অনৈতিক কর্মকাণ্ড করলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তারা বাম সংগঠনগুলোতে যোগ দিতে পারছে না। আমরা ভাবছি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম সংগঠনগুলোকে একটি সংগঠনে রূপ দিয়ে আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাব।

ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি শাকিলা খাতুন বলেন, বর্তমানে দেশে কোনো মানুষই ন্যায্য কথা বা হকের কথা বলতে পারেন না। মত প্রকাশের স্বাধীনতাও নাই। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সরকারের রিপ্রেজেন্টেটিভ হয়ে কাজ করছে। একটি ক্যাম্পাসে যে ধরনের সংস্কৃতি ও রাজনীতি প্যাট্রোনাইজিং হওয়ার কথা সেটা তো হয়ই না; বরং যারা ন্যায্য কথা বলেন তাদের বাঁধা প্রদান করা হয়। তাদেরকে হেনস্তা করা হয়। হলের খাবারের মান বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন করার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা আমাদের সংগঠনের প্রত্যেক সদস্যকে ফোন করে করে থ্রেট দিয়েছিলেন। এটি কর্মী সংকটের বড় একটি কারণ।

নিস্ক্রিয়তা ও কর্মী সংকটকে স্বীকার করে ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি রায়হান আলী বলেন, বর্তমানে দেশ একটা অস্থিতিশীল পরিবেশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাই রাজনীতি নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে ভয় বিরাজ করছে। ফলে বামরাজনীতিতে তারা সম্পৃক্ত হতে পারছে না। 
তাছাড়া গণতান্ত্রিক সিস্টেম না থাকায় বিভিন্ন ন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়ে আমরা আন্দোলন করতে পারছি না। তাছাড়া ছাত্রলীগের উৎপীড়নের ভয়ে বাম সংগঠনগুলো সেই কার্যক্রমে নেই বলে তিনি জানান।

বাম সংগঠনগুলোর নিষ্ক্রিয়তার জন্য সাংগঠনিক দুর্বলতাও দায়ী বলে মন্তব্য করেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি রিদম শাহরিয়ার। তিনি বলেন, বরাবরই আমাদের সংগঠনগুলোতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলোর তুলনায় কম ছিল। গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকার যে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে সেখানে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে আমাদের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে। তবে এটিও সত্য, ক্যাম্পাসে বাম সংগঠনগুলোর যেই ইতিহাস ছিল আমাদের নানা সীমাবদ্ধতায় সেখানে ভাটা পড়েছে। আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতাও আছে।

বাম ছাত্ররাজনীতিকে খুব কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আমিরুল ইসলাম কনক। বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর নিষ্ক্রিয়তা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নব্বইয়ের পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ছাত্ররাজনীতি অনেকটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনগুলো হলগুলোতে ব্যাপক আধিপত্য বজায় রেখেছে; যার ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোনো রিস্ক না নিয়ে তাদের সাথেই যুক্ত হচ্ছে। 

তিনি আরও বলেন, মূলত দেশের সার্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণেই বাম ছাত্রসংগঠনগুলো সাংগঠনিকভাবে ভালো অবস্থায় নেই। তাছাড়া রাকসু না থাকার কারণেও ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির যে প্র্যাকটিস থাকার কথা, সেটি হচ্ছে না।