১৯ এপ্রিল ২০২৩, ২০:১৩

এক কমিটিতেই অর্ধ যুগ পার, অপকর্মে টালমাটাল রাবি ছাত্রলীগ

রাবি ও ছাত্রলীগ  © লোগো

অর্ধ যুগেরও বেশি সময় ধরে এক কমিটিতেই চলছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। নতুন কমিটি না হওয়ায় নেতাকর্মীদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে বর্তমান কমিটি। ফলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়ে ওঠা এ সংঠনের নেতাকর্মীরা দলীয় শৃঙ্খলার বাইরে গিয়ে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, প্রক্সিকাণ্ড, শিক্ষক হেনস্তা, সিট বাণিজ্য, শিক্ষার্থী নির্যাতন, চুরি ও মাদকসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জর্জরিত। ছাত্রলীগের ইমেজ সংকটের কারণে দলীয় কোনো কর্মসূচিতে গুটি কয়েক নেতাকর্মী ছাড়া উপস্থিত হতে দেখা যায় না কাউকে। 

রাবি শাখা ছাত্রলীগের দপ্তর সূত্রে, সকল হল ইউনিট, অনুষদ ও বিভাগসহ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বর্তমানে দুই হাজারের বেশি পদধারী নেতা রয়েছে। মোট কর্মী রয়েছে পাঁচ হাজারের মতো। তবে অধিকাংশ নেতাকর্মী এখন নিষ্ক্রিয়। বিভিন্ন র‌্যালি, সমাবেশ ও আলোচনা সভায় সেটা লক্ষ্য করা যায়। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি-সেক্রেটারি কিংবা উচ্চপদস্থ কোনো নেতা ক্যাম্পাসে এলেও দু'শোর বেশি নেতাকর্মী এক জায়গায় হতে দেখা যায় না।অর্থাৎ মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না তারা।

তবে অতীত ইতিহাস ছিল ভিন্ন রূপে। সে সময় রাসিক মেয়র, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন নেতানেত্রী ক্যাম্পাসে এলে বা কোনো সমাবেশ হলে সেখানে উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যেত। কিন্তু অতীতের এই সাধারণ কাজ বর্তমানে অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

এর কারণ খুঁজতে গেলে প্রথমেই উঠে আসে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নিস্ক্রিয়তা। রাবি শাখা ছাত্রলীগের সর্বশেষ কমিটি হয় ২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগের কমিটির মেয়াদ এক বছর হলেও ইতোমধ্যে এই কমিটি অর্ধযুগ পার করেছে। কয়েকবার কেন্দ্রীয় কমিটি হলেও বদল হয়নি রাবি ছাত্রলীগের কমিটি। ফলে নতুন নেতৃত্বের পথ বন্ধ সাড়ে ছয় বছর। এতে অনেকেই অভিমান নিয়ে কর্মী থেকেই ক্যাম্পাস ত্যাগ করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমান কমিটি ২৫১ সদস্যবিশিষ্ট। এর মধ্যে অধিকাংশ নেতার বর্তমানে ছাত্রত্ব নেই। অনেকেই বিয়ে করেছেন এবং পড়াশোনা শেষ করে চাকরিও করছেন। ক্যাম্পাস ছেড়েছেন দেড় শতাধিক নেতাকর্মী।

২৫১ সদস্যবিশিষ্ট শাখা ছাত্রলীগে পদপ্রত্যাশীরা জানান, শাখা ছাত্রলীগের ২৫১ সদস্যের মধ্যে দেড় শতাধিক নেতাকর্মী ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করছেন। যাদের মধ্যে সহ-সভাপতি, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও উপ-সম্পাদকসহ ২৫ জনেরও বেশি নেতা বর্তমানে বিবাহিত। চাকরিতে প্রবেশ করেছেন প্রায় অর্ধশত সিনিয়র নেতাকর্মী। পড়াশোনা শেষে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন শতাধিক নেতাকর্মী। 

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সকাল ১২টায় প্যারিস রোডে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ আয়োজিত র‌্যাগিং ও সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট বিরোধী পদযাত্রায় বরাবরের মতো নেতাকর্মীদের তেমন ভিড় লক্ষ্য করা যায়নি। এর আগে, ২৬ ফেব্রুয়ারি  বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে কাটাখালিতে আয়োজিত অশুভ শক্তির সন্ত্রাস-নৈরাজ্য ও ষড়যন্ত্রমূলক অপরাজনীতির বিরুদ্ধে শান্তি সমাবেশ করে কাটাখালী পৌর আওয়ামী লীগ। সেখানে রাসিক মেয়র এ.এইচ.এম. খায়রুজ্জামান লিটন, জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক, দপ্তর সম্পাদকসহ জেলা আওয়ামী লীগের বড় মাপের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।  

সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকে উপস্থিত থাকার কথা ছিল। শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সেক্রেটারি বিভিন্ন হল, অনুষদ ও বিভাগে দায়িত্বে থাকা নেতাদের কর্মীসহ সেখানে উপস্থিত থাকতে জোরালো আবেদন করেন। কিন্তু সেখানে আশানুরূপ সদস্য উপস্থিত হয়নি। সাত হাজার নেতাকর্মীদের মধ্যে মাত্র দুইশত জনের মতো উপস্থিত করা গিয়েছিল শান্তি সমাবেশে। 

ছাত্রলীগের এক কর্মী জানায়, সেদিন চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া। নেতাকর্মীরা কেন সমাবেশে যোগ দেয়নি সেই কৈফিয়ত নিতে হলে হলে যান তিনি। এসময় চিৎকার করে করে কৈফিয়ত নেন তিনি। 

এছাড়া গত ২৯ জানুয়ারি রাজশাহীতে প্রধানমন্ত্রীর জনসভাকে সফল করতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নবনির্বাচিত সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান। কিন্তু তাঁরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে তাদেরকে প্রটোকল দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ক্যাম্পাসে লক্ষ্য করা যায়নি। তবে বিগত সময় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ক্যাম্পাসে আসলে তাদেরকে বিভিন্নভাবে অভ্যর্থনা জানানো ছিলো সাধারণ একটি ঘটনা।  তাদেরকে বরণ করে নেওয়ার জন্য মোটরসাইকেল শোডাউন, রাস্তায় অবস্থান করাসহ বিভিন্ন আয়োজন করে থাকেন ছাত্রলীগ। কিন্তু এবার দেখা গেছে তার উল্টো চিত্র। এছাড়া ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের মাঝে তেমন কোনো উৎসুক আমেজও লক্ষ্য করা যায়নি সেদিন।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি শহীদ ফারুক দিবস উপলক্ষ্যে রাবি শাখা ছাত্রলীগ আয়োজিত কর্মসূচি শুরু হওয়ার কথা ছিল বেলা ১১টায়। কিন্তু নেতাকর্মীদের উপস্থিত না থাকায় নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। ফলে বক্তব্য না দিয়েই ফিরে গেছিলেন কর্মসূচিতে অতিথি হয়ে আসা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ডা. আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা।

প্রোগ্রাম দেরিতে শুরুর বিষয়ে জানতে ডা. আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা বলেন, আমি সময়মতো প্রোগ্রামস্থলে আসি কিন্তু গিয়ে দেখি প্রোগ্রাম শুরু হয়নি। অন্যদিকে আমার আরেকটা প্রোগ্রাম থাকায় চলে এসেছিলাম।

গুরুত্বপূর্ণ এসব আলোচনা সভায় নেতাকর্মীদের অনুপস্থিতির বিষয়ে বর্তমান কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহিনুল ইসলাম সরকার ডন বলেন, কিছুদিন আগে কমিটি হওয়ার কথা ছিল কিন্তু কমিটি না হওয়ায় নেতাকর্মীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। নতুন কমিটি হলে নেতাকর্মীদের মধ্যে আগ্রহ বাড়বে।

নেতাকর্মীর সংখ্যা কম হওয়ার বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বর্তমান কমিটির এক সিনিয়র নেতা বলেন, এটি সম্পূর্ণ সিট বাণিজ্যের প্রভাব। হলে কর্মী না উঠিয়ে টাকার বিনিময়ে সিট বিক্রি করা হয়। যারা টাকা দিয়ে হলে উঠে তারা প্রোগ্রামে আসতে চায় না।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে আরেক সিনিয়র নেতা বলেন, সম্মেলনের তারিখ ঘোষণার কমিটি ঘোষণা করা হয়নি ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের অবস্থা যেমন লাজুক তেমনি কর্মীরাও দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন। টাকা দিয়ে হলে কর্মী তুললে অবশ্যই মিছিলে আসতে বাধ্য নয় তারা। এ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচনের আগে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নতুন কমিটি দিয়ে ছাত্রলীগকে ঐকবদ্ধ ও নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করা উচিত।