ছিলেন সামনের সারিতে, গ্রুপিংয়ের শিকার হয়ে ‘মাইনাস’ তারা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ছাত্রদলের এক নাম্বার সাংগঠনিক ইউনিট মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল। হলটির সভাপতি তারেক হাসান মামুন ঢাবি ছাত্রদলের সদ্য ঘোষিত কমিটির শীর্ষ পদপ্রত্যাশীদের একজন ছিলেন। শীর্ষ পদতো দূরের কথা, ৩৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে তার স্থান হয়নি।
দীর্ঘ এক যুগ ধরে ছাত্রদলের রাজনীতি করেও সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী না হওয়ার পদবঞ্চিত হয়েছেন বলে অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ২০১১-১২ সেশনের এই শিক্ষার্থী। শুধু তিনি নয়, গ্রুপ রাজনীতির ফাঁদে পড়ে সদ্য ঘোষিত ঢাবি কমিটিতে জায়গা হয়নি এরকম ডজন খানেক পদপ্রত্যাশীর। যাদের অনেকে দীর্ঘ ৮-১০ বছর দলীয় কর্মসূচিতে সক্রিয় ছিলেন। দায়িত্ব পালন করছেন হল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাছাড়া কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে তাদের অনেকে হামলা-নির্যাতনের শিকার এবং কারাগারেও যেতে হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রদলের এই কমিটিতে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিজেদের অনুসারীদের পদ দিতে গিয়ে নেতৃত্বে এগিয়ে এনেছেন বেশ কয়েকজন অযোগ্য, নিষ্ক্রিয় ও বিতর্কিতদের। ফলে এই কমিটির পক্ষে ক্যাম্পাসে দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন আগের কমিটিগুলোর চেয়ে কঠিনতর হবে বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা। তাই অবিলম্বে যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের সমন্বয় করে এই কমিটি পুনগর্ঠিত বা বর্ধিত করার দাবি উঠেছে।
জানা যায়, ঢাবি শাখা ছাত্রদলে ছয় থেকে আটটি গ্রুপ ও উপ-গ্রুপ রয়েছে। এর মধ্যে সাবেক সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর অনুসারীদের দুটি উপ-গ্রুপ। এ দুটি বর্তমান ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় ১নং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম রাকিবের গ্রুপ হিসেবে পরিচিত।
তাছাড়া রয়েছে বর্তমান ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সাইফ মোহাম্মদ জুয়েলের গ্রুপ; ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান মিন্টুর গ্রুপ; ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সিনিয়র সহ-সভাপতি রাশেদ ইকবাল খানের অনুসারী (সাবেক ছাত্রদলের সভাপতি আব্দুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল অনুসারী); সাবেক সিনিয়র যুগ্ম-সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন; সাবেক কেন্দ্রীয় সাহিত্য ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক মিনহাজুল ইসলাম ভূইয়ার গ্রুপ।
গত রবিবার খোরশেদ আলমকে সভাপতি ও আরিফুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের ৩৩ সদস্যের নতুন কমিটি ঘোষিত হয়। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কমিটির সদস্যদের নাম প্রকাশ পায়। পরদিন সোমবার দুপুরের পর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে খোরশেদ-আরিফুলের নেতৃত্বে একটি শুভেচ্ছা মিছিল হয়। মিছিলে ১৭-১৮ জন নেতাকর্মী অংশ নেন। এরপর আর কোন কর্মসূচিতে দেখা যায়নি তাদের। কমিটিতে সভাপতির দায়িত্ব পাওয়া সোহেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী এবং আরিফুল ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ছাত্রদলের রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত নতুন এবং নিষ্ক্রিয় ছিলেন বলে জানা গেছে।
কমিটিতে পদবঞ্চিত এবং প্রত্যাশিত পদ না পাওয়া একাধিক নেতা বলেন, কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিজেদের অনুসারীদের পদ দিতে গিয়ে ঢাবি ছাত্রদলের নেতৃত্ব থেকে অনেক যোগ্যদের বাদ দিয়েছে। সক্রিয় না থেকেও পদ পেয়েছেন অনেকেই। আর সক্রিয় ও পরিচিত মুখদের বাদ দেওয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কমিটিতে স্থান পাওয়া ৩৩ জনের মধ্যে সবেচেয়ে বেশি অনুসারী রয়েছে কেন্দ্রীয় সভাপতি শ্রাবণের। কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলামসহ ১৪ জন তার অনুসারী। এরপর বেশি রয়েছে কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জুয়েলের অনুসারীর সংখ্যা। কমিটিতে সভাপতি খোরশেদ আলম সোহেলসহ মোট ৬ জন তার অনুসারী রয়েছে। এছাড়া কমিটিতে দুয়েকজন করে সাবেক ও বর্তমান কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতার অনুসারী রয়েছে। তবে কমিটিতে ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান মিন্টুর অনুসারীদের বাদ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কমিটিতে একাধিক নেতার বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়, বিবাহিতসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। তেমনই একজন সহ-সম্পাদক মুন্সি সোহাগ। অভিযোগ রয়েছে, মাস তিনেক রাজনীতি করে ‘বড় ভাইয়ের’ আর্শীবাদে তিনি দুটি পদ (হল ও ঢাবি) পেয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাবি ছাত্রদলের পদবঞ্চিত এক নেতা বলেন, একটা গ্রুপকে মাইনাস করে কমিটিতে পদ দেওয়া হয়েছে। অথচ এই গ্রুপটিই এতোদিন ঢাবির বিভিন্ন কর্মসূচিতে সবার আগে থাকতো। বিশ্ববিদ্যালয় ও হলে হলে তাদের জনবলও বেশ ভালো ছিল। এখন হলে হলে নতুন কমিটি দিতে গিয়ে নেতাও খুঁজে পাবে না বলে তিনি মনে করেন।
ঢাবি শাখা ছাত্রদলের সদ্য সাবেক আহবায়ক (ভারপ্রাপ্ত) আক্তার হোসেন বলেন, কমিটিতে একটি গ্রুপের নেতাকর্মীদের বঞ্চিত করে কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের ব্যক্তিগত অনুসারীদের পদ দেওয়া হয়েছে। তাই এই কমিটি কতটুকু পারফর্ম করতে পারবে সে ব্যাপারে সন্দিহান। উদাহরণ হিসেবে-কমিটি ঘোষণার পরদিন নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে শুভেচ্ছা মিছিলে মাত্র ১৭-১৮ জন অংশ নেন। এরপর ক্যাম্পাসে আর কোন কর্মসূচিতে দেখা যায়নি তাদের। অথচ অন্যান্য কমিটি ঘোষণার পর ক্যাম্পাসে আসতো, ভিসির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতো। এটা কিন্তু দেখা যায়নি।
জানা যায়, ২০০৮-০৯ সেশন থেকে এবার ঢাবির কমিটিতে ২-৩ জনকে পদায়ন করা হয়েছে। এর আগের ব্যাচগুলোর পদপ্রত্যাশীদের কেন্দ্রে পদায়ন করা হয়। এদিকে ঢাবির কমিটিতে সর্বশেষ ২০১২-১৩ সেশন পর্যন্ত পদায়ন করা হয়েছে। এই ৫টি ব্যাচের মধ্যে ২০১১-১২ সেশনের পদপ্রত্যাশীদের সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত করা হয়েছে।
এই ব্যাচগুলো থেকে আগের কমিটির বিশ্ববিদ্যালয় ও হলের পদধারী অনেকেই সদ্য ঘোষিত কমিটিতে কোন পদ পায়নি। এদের মধ্যে এসএম হলের সাবেক সভাপতি আবদুর রহিম রনি, জিয়া হলের সভাপতি তারেক হাসান মামুন, কবি জসীমউদ্দিন হলের সভাপতি তৌহিদুর রহমান তাজ, জগন্নাথ হলের সাধারণ সম্পাদক সুপ্রিয় শান্ত, মুহসিন হলের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল ইসলাম, ঢাবির আহবায়ক সদস্য নাজমুস সাকিব, শাহিনুর ইসলাম, হাসান আবিদুর রেজা বায়জিদ, আমান উল্লাহ আমান উল্লেখযোগ্য।
২০১২-১৩ সেশনের অনেকেও কোন পদ পায়নি। এদের মধ্যে হলো-শহীদুল্লাহ হলের সভাপতি শাহিন, জিয়া হলের সাধারণ সম্পাদক কামরুল, জহুরুল হক হলের সিনিয়র সহ-সভাপতি বোরহান, মুহসিন হলের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহফুজ উল্লেখযোগ্য।
ঢাবি শাখা ছাত্রদলের সভাপতি খোরশেদ আলম সোহেল বলেন, নতুন কমিটি হওয়ার পর অনেকের মধ্যে অসন্তুষ্টি দেখা দেয়। বিশেষ করে যারা কাঙ্খিত পদ পায় না তাদের মধ্যে। ছাত্রদল একটি বৃহৎ ছাত্র সংগঠন এবং এখানে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা হয়। তবে কাঙ্খিত পদ না পেলেও রাজনীতিতে আরও ভালো করে উচ্চতর পদে যাওয়ার অনেক নজির রয়েছে। মেধা ও পরিশ্রমে ছাত্রদলের সব নেতা-কর্মীরাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে দল ও দেশের জন্য এগিয়ে আসবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
তিনি আরও বলেন, যারা পদবঞ্চিত হয়েছে তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এজন্য শনিবার কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সঙ্গে আমরা বসবো। আশা করি, একটি সুষ্ঠু সমাধান আসবে। সংগঠনের ব্যাপারে সকলে আন্তরিক থাকলে কোনো সমস্যাই জিইয়ে থাকে না। এখানেও তাই হবে।
ঢাবি শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম বলেন, আমাদের কমিটি মাত্র ৩৩ সদস্য বিশিষ্ট। এখনও পূর্ণাঙ্গ হয়নি তাই সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। আমরা অতিদ্রুত পদবঞ্চিতদের পদায়ন করবো। আমরা সবাই ভাই-ভাই। সবাই হামলা-মামলার শিকার। তাই তাদের ভিন্ন চোখে দেখার সুযোগ নেই।
রাজনীতিতে নিজে নিষ্ক্রিয় থাকার অভিযোগের বিষয়ে আরিফ বলেন, আমি নাকি ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নিষ্ক্রিয় ছিলাম। অথচ এই সময়ের মধ্যে অর্ধশতের বেশি ছবি দেখাতে পারবো, যেগুলোতে আমি সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছি।
কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ বলেন, ঢাবিতে ৩৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি হয়েছে। আমরাতো এখনও কমিটি পূর্ণাঙ্গ করিনি। এখানে বলা হচ্ছে পদবঞ্চিত হয়েছেন অনেকেই। তাহলে পদবঞ্চিত কীভাবে বলা যায়? আমি শাখা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে নির্দেশনা দিয়েছি কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার ব্যাপারে।
কমিটিতে নিষ্ক্রিয়দের পদায়নের ব্যাপারে তিনি বলেন, এ ধরণের অভিযোগ ভিত্তিহীন। কমিটিকে বির্তকিত করার জন্য অনেকে এ ধরণের অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল বলেন, কমিটিতে সবাইকেতো সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক কিংবা ভালো পদ দেওয়া সম্ভব নয়। সামনের দিকের পদ সীমিত। এখানে সমন্বয় করা হয়েছে। আর যোগ্যতা অনুযায়ী পদ দেওয়া হয়েছে। আর যারা পদ পায়নি, বাদ পড়েছেন তারাও তাদের সমসাময়িক। তাই তাদেরও কিছুটা মন খারাপ হবে স্বাভাবিক। আশা করছি, নতুন কমিটি ক্যাম্পাসে সু্ষ্ঠু ধারা অব্যাহত রাখতে পারবে।
যারা পদ পাননি তাদের ব্যাপারে তিনি বলেন, কমিটি এখনও ৩৩ সদস্যের। আগামীতে আরও বাড়ানোর সুযোগ আছে। কমিটি যখন বাড়ানো কিংবা পূর্ণাঙ্গ করা হবে তখন তাদের বিবেচনা করা হবে।