বাবা-মায়ের টাকায় চলা শিক্ষার্থীরা ‘পেরে উঠছে না’
বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে পড়াশোনার খরচ যোগাতে বাবা-মায়ের আয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মা পরিবারের খরচ চালানোর পাশাপাশি সন্তানদের চাহিদা অনুযায়ী সেই অর্থ সরবরাহ করতে পারছেন না। এতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নত দেশে এই চিত্র ভিন্ন। সেখানে শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই খণ্ডকালীন কাজে যুক্ত থাকেন। নিজেদের পড়ার খরচ নিজেরাই যোগাড় করেন। বাংলাদেশেও এই সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সামাজিকভাবে অবমূল্যায়নের ভয় ও চাকরির সুযোগ কম থাকার কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী খণ্ডকালীন কাজে নিজেকে জড়াতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। সম্প্রতি টিউশনি করে পড়ার খরচ যোগাড় করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও খণ্ডকালীন কাজে যুক্ত হয়ে পড়ার খরচ যোগাড় করছেন এমন সংখ্যা খুবই কম। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, খণ্ডকালীন কাজে যুক্ত হওয়ার সুযোগ খুবই কম। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও সেই সুযোগ তৈরি করে দেয় না।
সম্প্রতি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী অন্তু রায় আত্মহত্যা করেছেন। সহপাঠীদের ধারণা, হলের ডাইনিংয়ে মোটা অঙ্কের টাকা বকেয়া থাকা ও সেন্ট্রাল ভাইভা না দিতে পারায় হতাশ ছিলেন অন্তু। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ রশীদ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। স্বজনরা জানান, ২০১৮ সালে কুয়েটে ভর্তির পর থেকে অভাবের মধ্য দিয়ে দিন পার করছিলেন অন্তু।
অন্তু রায়ের মৃত্যুর পর উচ্চ শিক্ষা পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের পড়ার খরচ চালানো নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। খোঁজে জানা গেছে, শুধু অন্তু নয়, পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ আর্থিক সমস্যায় ভুগে থাকেন। বাবা-মা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল না হওয়ায় একদিকে তারা যেমন পরিবারের দ্বারস্থ হতে পারেন না, তেমনি খণ্ডকালীন চাকরি কিংবা টিউশনি না পাওয়ায় নিজের পড়ালেখাও ঠিকভাবে চালিয়ে নিতে হিমশিম খান। স্বভাবতই একসময় হতাশাগ্রস্থ হয়ে ভুল সিদ্ধান্তের দিকে ধাবিত হন।
আরও পড়ুন: সর্বশেষ পাঁচ বিসিএসে অবিবাহিতদের দাপটই বেশি
ভুলপথে পা না বাড়ালেও পরিস্থিতি শিকার এমনই একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা আসাদ বিন হোসেন। আসাদ জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেকেই অসচ্ছল পরিবার থেকে আসে। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে চিত্রটা এমনই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে শিক্ষার্থীরা চেষ্টা করে টিউশনি পাওয়ার। কিন্তু ভালো বিষয়ে না পড়ার কারণে অনেক শিক্ষার্থী টিউশনি পান না। খণ্ড-কালীন চাকরির জন্য কিছু কিছু বিভাগ শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করলেও বেশিরভাগ বিভাগ থেকে সহযোগিতা পাওয়া যায় না।
নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আমি টিউশনি করাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পাইনি। পরে খণ্ডকালীন চাকরির জন্য ঘুরেছি। তিন বছর চেষ্টা করার পর একটি রেডিও স্টেশনে খণ্ডকালীন চাকরির সুযোগ পাই। মাঝের তিন বছর খুবই কষ্টের মধ্য দিয়ে পার করেছি। হতাশা ঘিরে ধরে ছিলো। বাধ্য হয়ে পরিবারের কাছ থেকে টাকা নিতে হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই নিজের খরচ যোগাতে সেই টাকা পর্যাপ্ত ছিল না।
তিনি বলেন, রেডিও স্টেশনটি খণ্ডকালীন চাকরির জন্য নিয়োগ দিয়েও আমাকে ফুল-টাইম খাটিয়ে নিত। তবে টাকা খণ্ডকালীন সময় হিসেব করেই দিত। টাকা লাগবে। তাই বাধ্য হয়ে সেটি চালিয়ে গেছি। ফুল-টাইম করতে গিয়ে আমার ইয়ার-ড্রপ হয়েছে। কিছুদিন পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে জমানো টাকা দিয়ে পড়াশোনা শেষ করেছি। আসাদ বলেন, শিক্ষার্থীরা আর্থিকভাবে সচ্ছল না হওয়ায় অনেকে হতাশা থেকে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
জার্মানির মারবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে নর্থ আমেরিকান স্টাডিজ নিয়ে পড়াশোনা করছেন মেহেদী হাসান। তিনি গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। মেহেদী জানান, পড়ার খরচ যোগাতে তিনি জার্মানিতে ফুড ডেলিভারির কাজ করেন। সেই সঙ্গে ইউটিউবে কন্টেন্ট তৈরি করেন। বাংলাদেশে থাকাকালীন তিনি পরিবারের আয় দিয়ে নিজের খরচ চালাতেন।
তিনি বলেন, বিদেশে শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করা সহজ। পড়ার ক্ষতি না করে নিজের সুবিধা মতো সময়ে কাজ করা যায়। এছাড়া দেশে এ ধরনের কাজ করলে সামাজিকভাবে হেয় করা হয়। অনেক সময় প্রতিবেশী বা বন্ধুরা এড়িয়ে চলে।
পড়ুন: ‘ঢাবি-বুয়েট-ইডেন ছাত্রীরা পতিতাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত’— গাইড বইয়ের তথ্যে বিভ্রান্তি-সমালোচনা
একসময় সৌদি আরবে ব্যবসা করতেন সাইফুল ইসলাম। তার বড় ছেলে শরীফুল ইসলাম বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। করোনার কারণে সাইফুল বর্তমানে দেশে আছেন। সাইফুল জানান, তিন সন্তানের সবাই পড়াশোনা করছেন। সন্তানদের পড়ার খরচ যোগাতে তিনি হিমশিম খাচ্ছেন।
সাইফুল জানান, সৌদি থাকা অবস্থায় বাড়তি পরিশ্রম করে পরিবারের পাশাপাশি সন্তানদের পড়ার খরচ যোগানো সহজ ছিলো। দেশের বাজারে এখন খাদ্য-পণ্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে। আগে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে সব খরচ মেটাতে পারলেও এখন সম্ভব হচ্ছে না। মাঝে দুই-তিন মাস কর্জ করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। এখন পুনরায় দেশের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বলে জানান তিনি।
এসব বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নিগার সুলতানা বলেন, আমাদের দেশের পরিস্থিতি এবং বাহিরের দেশের পরিস্থিতি অনেক ভিন্ন। এমনকি সামাজিক পদ্ধতিতেও রয়েছে অনেক পার্থক্য। আমাদের দেশে একটা ছেলের ২৫/২৬ বছর বয়স এমনি চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের বাবা-মাকেই দায়িত্ব নিতে হয়। কিন্তু বাহিরের দেশে এমন না।
তিনি বলেন, বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে একজন মেধাবী অসচ্ছল শিক্ষার্থীকে আমরা শিক্ষকরা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় তার চাহিদা অনুযায়ী সহযোগিতা করতে পারি না। আবার বাহিরের একজন শিক্ষক যে ধরনের অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা পায় আমাদের দেশের শিক্ষকরা তা পায় না। ফলে আমাদের দেশের শিক্ষকদের তুলনায় বাহিরের দেশের শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের অর্থনৈতিকভাবে বেশি সহযোগিতা করতে পারেন। আমেরিকা, চায়না ছাড়াও বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকে। শুধু যে নিজের অসচ্ছলতা দূর করার জন্য তা নয় নিজেদের উন্নয়নের জন্য তারা চাকরি করে। এমনকি আমেরিকা এবং চায়নার লোকাল শিক্ষার্থীরাও পার্টটাইম চাকরি করে।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের আয়ের জন্য শিক্ষকদের গবেষণার প্রজেক্ট বৃদ্ধির বিকল্প কিছু নেই। গবেষণার প্রজেক্ট বাড়ানোর পাশাপাশি গবেষণার ফান্ডও বৃদ্ধি করতে হবে। আমি চায়নাতে দেখেছি একজন শিক্ষকের গবেষণার প্রজেক্ট এর মাধ্যমে ৫ থেকে ৬ জন শিক্ষার্থী সম্পূর্ণ পড়াশোনার খরচ চালিয়ে নিতে উক্ত প্রজেক্ট কাজ করে।
এছাড়া শিক্ষার্থীরা শুধু টিউশনির দিকে না ঝুঁকে এর পাশাপাশি বিভিন্ন সফটওয়্যার সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ নিতে পারে, কাজ শিখতে পারে। এতে করে তাদের একটি দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি অনার্স শেষ করে কোন শিক্ষার্থীকে হতাশার সাগরে ডুবে থাকতে হবে না।
অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কিছু বৃত্তি রয়েছে। কিন্তু সেই সংখ্যাও অনেক কম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, একজন শিক্ষার্থী তার আবার আয় থাকবে কেন। তবে ব্যতিক্রম কিছু শিক্ষার্থী থাকে। যারা পারিবারিক-ভাবে অসচ্ছল। তাদের জন্য সমাজের উচ্চ পর্যায়ের মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, মেধাবী তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন মেধা বৃত্তির ব্যবস্থা করা এবং সহযোগিতা করা তো আমাদের দায়িত্ব। সেই লক্ষ্যেই আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন স্কলারশিপ, ট্রাস্টের ব্যবস্থা করি।
আরও পড়ুন: ছাত্রলীগ থেকে পুলিশ ক্যাডার শাস্ত্রী
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মশিউর রহমান বলেন, পৃথিবীর সব জায়গাতেই একটা নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বাবা-মায়ের আয়ের ওপর নির্ভরশীল থাকে। আবার এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা ছাত্র অবস্থায় শুধুমাত্র টিউশনি করে নিজের চাহিদা পূরণ করে বাবা-মাকেও টাকা পাঠায়। প্রত্যেকেই যদি কাজ করে ছাত্রজীবনে তাহলে তো তারা পেশাজীবীই হয়ে গেলো।
সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের জন্য ‘অন ক্যাম্পাস জব’ চালু করেছে। শিক্ষার্থীদের টিউশনি থেকে ফিরিয়ে আনতে এমন উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। কর্তৃপক্ষ বলছে, শিক্ষার্থীরা টিউশনি করিয়ে যে অর্থ আয় করবে ক্যাম্পাসে খণ্ড-কালীন চাকরি করে তার চেয়ে বেশি আয় করতে পারবে। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পড়ার সময় বাঁচবে এবং গবেষণায় আগ্রহী হবে।
বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ বিষয়ক পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে প্রায় সম্পূর্ণ ফ্রিতেই শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করে। সে ক্ষেত্রে তাদের পরিবারের উপর বেশি প্রভাব পড়ার কথা না। তারপরও কিছু পরিবার রয়েছে যারা তাদের সন্তানদের পড়ালেখার খরচ চালানোর সামর্থ্য রাখে না। সেই শিক্ষার্থীরা অনেকেই টিউশনি করে নিজের খরচ চালায় আবার পারিবারের খরচও চালায়। আবার অনেক শিক্ষার্থী আছে যাদের পরিবার থেকে খরচ বহন করতে সক্ষম তারপরেও তারা টিউশনি করায়। নিজেদের খরচ নিজেরাই চালাই।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব তত্ত্বাবধানে যদি শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসের মধ্যেই কোন ধরনের চাকরির ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে সবচেয়ে ভালো হয়। এতে আর্থিক সমস্যা দূর হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা পড়ায় আরও মনযোগী হতে পারবে।