আত্মপ্রত্যয়ী রাকিবের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
পুরো নাম বোরহান আহমেদ রাকিব। জন্ম এক অজপাড়াগাঁয়ে। যেখানে সকাল হতো কৃষকদের হাঁক ডাকে আর সন্ধ্যা নামতো সারাদিনের পরিশ্রম করা নিথর দেহগুলোর। শিক্ষার আলো একেবারে ছিলো না বললেই চলে।
বলছি রংপুরের জেলার কাউনিয়া উপজেলার টেপামধুপুর ইউনিয়নের কথা। এখানে মাগরিবের নামাজের সময় হওয়া মানে অনেক কিছু। সন্ধ্যা নামতেই ঘুমিয়ে পড়তো এই গ্রামটি। বিদ্যুৎও ছিলো না গ্রামটিতে তাই সন্ধ্যার পর পুরো গ্রাম জুড়ে নিরবতা বিরাজ করতো। এতে গ্রামটিকে একদিকে যেমন শান্তিপূর্ণ গ্রাম হিসাবে চিহ্নিত করা হতো ঠিক তেমনি পিছিয়ে পড়া গ্রাম বলে মনে করাতো অনেকেই৷ এমন গ্রামেই বেড়ে ওঠেন রাকিব৷ দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি বড়। আর ছোট ভাই গ্রামের একটি মাদ্রাসায় হেফজ বিভাগে পড়াশোনা করে।
তার পরিবার শুরুর দিকে ভালো আর সুখী ছিলো বেশ। সমস্যা শুরু তখন থেকেই যখন রাকিব তৃতীয় শ্রেণিতে ওঠে। পরিবারে দৈন্যতার শুরু হয় আর একে একে হারাতে থাকে চাষের সব জমি। রাকিবের বাবার কৃষি ব্যাংক থেকে নেয়া লোনের পরিমাণ চক্রবৃদ্ধি হারে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় তখন তাদেরকে বসতভিটার কিছু অংশ বিক্রি করে লোন শোধ করতে হয়।
গ্রামে একটি দোকান ছিলো তাদের। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে নগদের চেয়ে বাকিই বেশি চলে। বাকির টাকাও উঠতো না সেভাবে। একসময় এমন সময় আসে যে, দোকানে নতুন মালামাল তুলতে গিয়ে আবারো সেই লোন নিতে হয় তাদেরকে। এবার আর শেষ রক্ষা হলো না, আবার সেই চক্রবৃদ্ধিহারের লোনের কবলে পরে রান্নাঘর আর অল্প একটু জমি বাদে থাকার ঘরটাও বিক্রি করে দিতে হয় তাদেরকে। এরপর আর দোকানেও বসেন না রাকিবের বাবা।
থাকার ঘর বিক্রি করার পর রান্নাঘরেই দিনের পর দিন কাটে রাকিবের পরিবারের সদস্যদের। ছোট্ট একটা রান্নাঘরে থাকতে হতো পুরো পরিবারকে। রাকিবের বাবা তখন টুকটাক কৃষি কাজ করতো। কিন্তু কৃষি কাজে তেমন দক্ষ না হওয়া নিজ গ্রামের কৃষকরাও দলে নিতে চাইতো না রাকিবের বাবাকে। গ্রামে কাজ না পেয়ে রকিবের বাবা যেখানেই ছোটোখাটো কাজ পান সেখানেই ছুটে যান। নোয়াখালী, টাঙ্গাইল, বগুড়ায় যেতেন কাজের খোঁজে। শীতকালে এসব এলাকায় ধান রোপনের জন্য অন্য জেলা থেকে কৃষক নেয়া হতো৷ এই সুযোগকে কাজে লাগাতেন তিনি।
এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে পাশ করে নিজদর্পা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। ওই স্কুল থেকে রাকিবই একমাত্র ছাত্র যে সর্বপ্রথম জিপিএ-৫ পান। ইতিমধ্যে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম থেকে গ্রামে। রাকিবের পরিবারের সব ভার একমাত্র আয়ের উৎস তার বাবা। তখন তার বাবা একটা রড-সিমেন্টের দোকানে কাজ করে। মাসিক বেতন পাঁচ হাজার টাকা।
এই সামান্য আয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবারের চাহিদা মেটানো অনেক কঠিন হয়ে যায়। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে এসএসসির পর নিজের লেখাপড়ার খরচ নিজেকেই সংগ্রহ করতে হবে আর যদি বাবাকে আরেকটু সহয়তা করা যায় এমনটা ভেবেই টিউশনি শুরু করে রাকিব। বেশ সাড়া পায় সে৷ পরিবারের পাশে তার বাবার আয় করা পাঁচ হাজার টাকার সাথে যোগ হয় প্রায় দুই হাজার টাকা করে।
ওইদিকে রাকিবের বৃদ্ধা দাদী দিনকে দিন অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করে। ঔষধ লাগতো অনেক টাকার। পাঁচ সদস্যের খরচ চালানো আবার দাদীর ঔষধের খরচ মিলিয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হয় তাদেরকে। দিনশেষে বাবা-মায়ের মলিন মুখ দেখে তাদেরকে হেরে যাওয়া কেনো সৈনিক মনে হতো রাকিবের কাছে । তবুও একটি বিষয় রাকিবকে খুব ভাবাতো৷ শতো কষ্টের মধ্যেও রাকিব আর তার ছোটো ভাইকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতো তার বাবা-মা। দুই সন্তানের স্বপ্নপূরণের জন্য তাদের সাধ্যের সর্বোচ্চটুকু দিয়েছেন তাঁরা৷ এরপর থেকে পরিবারের আর্থিক সমস্যা দিনকে দিন বাড়তেই শুরু করে। এরপর রাকিব আরো বেশি করে টিউশনি করাতে শুরু করে, যদি পরিবারের কষ্ট একটু হলেও লাঘব হয়!
এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর টিউশনি করাতে সমস্যা হয় রাকিবের। দমে যায় না সে। দুপুর পর্যন্ত ক্লাস করে, বিকেলে নিজের পড়া পড়ে রাতে টিউশনি করানো শুরু করে সে। এভাবেই কলেজ জীবন পার করে রাকিব৷ এইচএসসিতে রংপুরের কাউনিয়া কলেজ থেকে জিপিএ-৪.৬৭ পেয়ে পাশ করে সে।
এইচএসসি শেষে উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নেয় শিক্ষার্থীরা। রাকিবের বন্ধুদের মধ্যে প্রায় সবাই ঢাকায় চলে যাচ্ছিলো কোচিং করার জন্য। রাকিবের মাথায় আসে না এখন সে কি করবে! যদিও তার বাবা-মা কোচিং করার জন্য রাকিবকে ঢাকায় যেতে বলে। রাকিবকে বেশ অবাক হতে হয় তখন। যেখানে তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরাতো তখন কিভাবে বাবা-মা এতো সাহস করে ঢাকায় যেতে বলে!
তাছাড়া গ্রামের অনেকেই বলাবলি করতে থাকে যে, তমুকের ছেলে নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে! এ্যাহ! গার্মেন্টসের চাকরির জন্য ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেইতো পারে। পড়াতে চাইলে ডিগ্রি কলেজেই পড়াতে পারে!
রাকিবের সাহসে কুলায় না৷ সে সাফ না বলে দেয়। কিন্তু বাড়ি থেকে অনুপ্রেরণা পায় সে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা বাবা-মা। তাদের কথা হচ্ছে, তোর উদ্দেশ্য সৎ থাকলে কেউ তোকে আটকাতে পারবে না বাবা! আল্লাহ তোর সহায় হবেন৷ আমরা গরীব হলেও আল্লাহর তো আর গরীব না, আল্লাহর ওপর যেহেতু ভরসা আছে আল্লাহ তোর জন্য অবশ্যই কিছু করবেন৷ বাবা-মায়ের কাছ থেকে এমন সাহস পেয়ে রাজি হয়ে যায় রাকিব। রাকিব একা যায়নি ঢাকা।
রাকিবের বাবা তার যাওয়ার একমাস আগেই এসেছেন; তুলনামূলক বড় কোনো কাজের খোঁজে। রড-সিমেন্টের দোকানের আয় দিয়ে নিজের সন্তানের স্বপ্নপূরণ আর পরিবারের খরচ তার জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে সেজন্যই এই সিদ্ধান্ত।
রাকিবের বাবা একটি বাসা-বাড়িতে কেয়ার টেকারের চাকরি নেন। প্রথম দু’মাসের খরচ সময়মতো দিতে পারলেও পরের মাসে হোস্টেলের টাকা যথাসময়ে দিতে না পেরে কথা শুনতে হয় রাকিবকে। এমন পরিস্থিতিতে রাকিবের বাবা যেই বাসায় কাজ করতেন সেই বাসার মালিকের কাছে অগ্রীম কিছু টাকা চান৷ কারণ জানতে চান বাড়ির মালিক। কেয়ার টেকারের ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চায় শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন বাড়ির মালিক৷
রাকিবের বাবাকে তাচ্ছিল্যের সাথে বলেন, কেয়ারটেকারের ছেলে পড়বে ইঞ্জিনিয়ারিং! গরিবের ছেলেদের এতো স্বপ্ন দেখতে নেই, শাহজাহান গরীবের ছেলেরা ডাক্তারি- ইঞ্জিনিয়ারিং এসব পড়ে না।
রাকির বলেন, এসব ঘটনা বাবা আমাকে ফোন দিয়ে অনেক কাঁদে। আমার সাথে বাবা সবকিছুই শেয়ার করে। সুখ-দুঃখ সব। আমিও অনেক কান্নাকাটি করি৷ পৃথিবীর সব সন্তানের কাছে বাবা একজন সুপারম্যান। আমার ক্ষেত্রেও তাই। এতো অপমানের পরও কাজ ছাড়েনি রাকিবের বাবা। আজ কাজ ছাড়লে হুট করে নতুন কাজ কোথায় পাবেন! রাকিব এখনও সময় হলেও কান্না করে। এমন কষ্ট আর অপমান যেনো আর কারও কখনও না হয় আল্লাহর দরবারে এটাই তার প্রার্থনা৷
এরপরের ঘটনা আরো করুণ! বাড়ির মালিকের পরিবারের সবাই ঈদে ভারত থেকে আনা শপিং করে এসে সেগুলো ঘরে এনে সবাই মিলে দেখছিলো। চাবি আনতে গিয়ে তাদের ঘরে যান তিনি। কিন্তু শপিং দেখার অপরাধে তাদের মেঝ ছেলে রাকিবের বাবাকে অপমান করে। এতো অপমান সইতে না পেরে চাকরি ছেড়ে দিন তিনি।
এইদিকে রাকিবেরও টাকার প্রয়োজন। টাকা দেয়ার জন্য নিজের কানের দুল বিক্রি করে দেন রাকিবের মা। সাধারণ কোনো দুল নয়, বিয়ের সময়ে স্বামীর দেয়া উপহার ছিলো সেটি। তাতেও রাকিবের খরচের টাকার ব্যবস্থা না হওয়ায় রান্নাঘর বাদে যেইটুকু জমি অবশিষ্ট সেগুলোকেও বিক্রি করে দেয় তার বাবা। তার বাবা-মা চাকরি ছেড়ে দেয়ার ঘটনা, কানের দুল আর সবশেষে জমি বিক্রি ঘটনা কিছুই জানতে দেয়নি রাকিব ভেঙে পড়তে পারে বলে।
অবশেষে রাকিবের ভর্তি হওয়ার সুযোগ মেলে দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) যন্ত্রপ্রকৌশল বিভাগে। হাবিপ্রবির ২০২০ ব্যাচের এই শিক্ষার্থীর পরিবার এখন সুখী পরিবার।
রাকিব টিউশনি করে যা আয় করে তাতে সে নিজের খরচ চালানোর পরও পরিবারকে বেশ ভালো অংকের টাকা দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে। টিউশনিতে বেশি সময় দিয়ে আবার নিজের পড়াশোনাতে যাতে অমনোযোগী না হয়ে যায় এমন পরামর্শ রাকিবের বাবা-মায়ের। ধীরে ধীরে ঘুরে দাড়াচ্ছে তার পরিবার। রাকিবের স্বপ্ন বিসিএস ক্যাডার হওয়া। দেশ ও সমাজের জন্য কাজ করা।