‘দেশের সার্বিক উন্নয়নে যুবদের সম্পৃক্ততা গুরুত্বপূর্ণ’

ডা. মো: এনামুর রহমান
ডা. মো: এনামুর রহমান  © ফাইল ফটো

‘বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে যুবদের সম্পৃক্ততা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা মোট জনসংখ্যার ৩৭% যুব, যাদের বয়স ১৫-৩৫ এর মধ্যে। দেশের উন্নয়নে এই যুবরাই বিরাট অবদান রাখছে।’ এমনটিই মন্তব্য করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মো: এনামুর রহমান।

বৃহস্পতিবার (২৬ আগস্ট) অক্সফ্যাম বাংলাদেশের সহযোগিতায় ওয়েভ ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘ক্রমবর্ধমান দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবেলায় সরকারি ব্যবস্থাপনা ও যুব সমাজ’ শীর্ষক ওয়েবিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের দেশে যেকোন দুর্যোগে যুবরাই সর্বপ্রথম এগিয়ে আসে ও ভূমিকা রাখে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সরকারি ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি যুব সমাজকে সর্বদা সম্পৃক্ত করে থাকে। তিনি ওয়ার্ড, ইউনিয়ন এবং উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিতে যুবদের অর্ন্তভূক্তি বিষয়ে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। একইসাথে এ বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের আশ্বাস প্রদান করেন।

অর্থনীতিবিদ ও পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ-এর সভাপতিত্বে ওয়েবিনারে অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরিন ও লেখক গবেষক
গওহার নঈম ওয়ারা।

ভার্চুয়াল এই ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী।

বক্তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমবর্ধমান দুর্যোগ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। এসব ঝুঁকি মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক নানা উদ্যোগের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারেরও রয়েছে বিভিন্ন নীতি-কৌশল। তবে দুর্যোগ মোকাবলার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে যে কমিটিগুলো রয়েছে সেগুলো সবখানে কার্যকর নয়, রয়েছে পারস্পরিক সমন্বয়হীনতা। এসব কার্যক্রমে এলাকার যুব সমাজকে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রেও নেই কার্যকর উদ্যোগ। ঝুঁকি মোকাবেলায় নির্মিত অবকাঠামোগুলো নিয়মিত সংস্কার না হওয়ায় বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে জানমালের ক্ষয়-ক্ষতি বেড়েই চলেছে। তাই দুর্যোগ সহিষ্ণু অবকাঠামো নির্মাণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলো কার্যকর করা এবং সেগুলোতে যুব প্রতিনিধিদের সংযুক্ত করা, নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান, ব্যাপক বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে সবুজ বেষ্টনী বৃদ্ধি করা এবং দুর্যোগ মোকাবেলায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে সে অনুযায়ী যথাযথ বরাদ্দ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, শুধুমাত্র দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নয় সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যুবদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। যাতে তারা নিজেদের পাশাপাশি দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে অবশ্যই তাদের মানবিক মূল্যবোধও সৃষ্টি করতে হবে। একইসাথে স্থানীয় পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে স্থানীয় জনগণ ও প্রতিনিধিকে সম্পৃক্তকরণ প্রয়োজন।

ইউনিয়ন পর্যায়ে যে সকল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি রয়েছে সেগুলো সারা বছর কাজ না করলেও দুর্যোগকালীন সময়ে তাদের সক্রিয়তা খুব জরুরী উল্লেখ করে গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট কমিটির সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে। স্থানীয় বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষিতে সমস্যা ও দুর্যোগের ধরণও ভিন্ন হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে দুর্যোগ মোকাবেলায় এলাকার সম্পদ বা সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে সামগ্রিক পরিকল্পনা করা প্রয়োজন যেখানে যুবরা সম্পৃক্ত থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে মহসিন আলী বলেন, অতিসম্প্রতি মে-২০২১ এ ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াসের’ প্রভাবে সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরগুনা, বরিশাল, খুলনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে, বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে, গৃহহারা হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। এসব ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস প্রভাবে উপকূল অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষ প্রতি বছরই আক্রান্ত হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেন, হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল, পুকুর ও মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়, গাছপালা উপড়ে যায়, বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে পড়ে, জলোচ্ছ্বাস ফলে লবণাক্ত পানিতে কৃষি জমি প্লাবিত হয়, শত শত মাইল রাস্তাসহ বেড়িবাঁধ, ব্রিজ-কালভার্ট এবং বিদ্যালয় ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসকল ক্ষতি উপকূল অঞ্চলের মানুষ কখনই পরিপূর্ণভাবে কাটিয়ে উঠতে পারে না। সরকারের পক্ষ হতে দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবেলা ও ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন উদ্যোগ ও বাস্তবায়নের নির্দেশনা সত্বেও মাঠ পর্যায়ের বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, দুর্যোগ বিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলী অনুযায়ী দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড পর্যায়ে কোন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন হয়নি; অধিকাংশ ইউনিয়নে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠিত হয়নি, আবার যেগুলি রয়েছে সেগুলির কার্যকারিতা নেই। এছাড়া উপজেলা ও জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকলেও নিয়মিতভাবে (দুর্যোগের সময় ছাড়া) কার্যকর নেই এবং ওয়ার্ড থেকে জেলা পর্যায় পর্যন্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ২০১৭ সালে বিবিএস-এর জরীপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি যুব (১৮ থেকে ৩৫ বছর) জনগোষ্ঠী। ব্যাপক সংখ্যক এই যুব সমাজকে যুবশক্তিতে রূপান্তরিত করে সামাজিক উন্নয়নসহ দুর্যোগ মোকাবেলায় সম্পৃক্ত করতে পারলে এই পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধানের দিকে আমরা অগ্রসর হতে পারি। সার্বিক দিক বিবেচনায় তিনি কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন। সেগুলো হলো-

•ঘূর্নিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্লাবন থেকে রক্ষা পেতে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি, নদীশাসনসহ স্থায়ীভাবে বেড়িবাঁধ নির্মাণ, খাল সংস্কার এবং সাইক্লোন শেল্টার সংস্কার ও শেল্টার সংশ্লিষ্ট সংযোগ রাস্তাসমূহ পাকা করাসহ দুর্যোগ সহিষ্ণু অবকাঠামো নির্মাণ করা।

•দুর্যোগ বিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলী ২০১৯ অনুযায়ী, স্থানীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিসমূহে (ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা) যুব প্রতিনিধিদের সংযুক্ত করার ব্যবস্থা করা এবং কমিটিসমূহের কার্যকারিতা নিশ্চিত করা।

•ক্রমবর্ধমান দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবেলায় সরকার ও রেডক্রিসেন্ট এর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচী (সিপিপি)’ ভলান্টিয়ারদের সাথে আরো বেশী করে যুবদের সম্পৃক্ত করা।

• তৃণমূল পর্যায়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলির সকল সদস্যকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ (বিশেষত সতর্ক সংকেত প্রচার, ফার্স্ট এইড, সার্চ এন্ড রেসকিউ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি) প্রদানের ব্যবস্থা করা, যাতে তারা দুর্যোগপূর্ব, দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ পরবর্তী সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে।

•দুর্যোগকালে নদীভাঙ্গন এবং জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার যাদের ঘর-বাড়িসহ সহায়-সম্পদ ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ মৎস্য চাষী ও কৃষকদের ফসলের ক্ষতি অনুযায়ী সকলকে পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা করা।

•সুন্দরবনের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, বৃক্ষরাজি এবং বন্যপ্রাণীর যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা এবং ক্ষতিকর যেকোনো কার্যক্রম কঠোরভাবে দমন করা।

• অন্যান্য উপকূল অঞ্চলে ব্যাপক বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে সবুজ বেষ্টনী তৈরি করা এবং স্থানীয় লোকায়ত জ্ঞানকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে দুর্যোগ মোকাবেলায় কাজে লাগানো।

• দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় বিশেষত উপকূল অঞ্চলে দুর্যোগ কেন্দ্রিক সরকারি বরাদ্দের পাশাপাশি স্থায়ীভাবে দুর্যোগ প্রতিরোধে স্বল্পমেয়াদী-মধ্যমেয়াদী-দীর্ঘমেয়াদী যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী যথাসময়ে সরকারি বরাদ্দ প্রদান ও এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা।

• প্রতিবছর দুর্যোগের পূর্বে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণসহ সকল প্রতিরোধ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের কার্যক্রম যথাযথভাবে মনিটরিং এবং সে প্রেক্ষিতে কোন গাফিলতি দেখা দিলে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা নিশ্চিত করা।


সর্বশেষ সংবাদ