সেই খুকি এখন এই খুকি
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্য ফেসবুকে এক নারী পেপার বিক্রেতার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। খবরের কাগজ বিক্রেতার যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে- তা ছিল ২০০৯ সালের। তার নাম দিল আফরোজ খুকি। তিনি রাজশাহীর একমাত্র নারী হকার।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মৃত স্বামী, বাবা-মা, ভাই-বোনের অবহেলায় ঘরবাড়ি ছেড়ে দীর্ঘদিন রাস্তায় পড়ে ছিলেন তিনি। তবুও ভিক্ষার পথ বেছে নেননি। একদিন রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া মানিব্যাগ উপযুক্ত ব্যক্তিকে ফিরিয়ে দেয়ার সম্মানী হিসাবে ১৫০ টাকা পান খুকি। সে টাকা দিয়ে পথে পথে, ষ্টেশন, বাসাবাড়িতে খবরের কাগজ বিক্রি করে নিজেকে স্বাবলম্বী করেছেন।
খুকি যেখান থেকে খবরের কাগজ ক্রয় করেন সে প্রতিষ্ঠানের মালিক জানিয়েছেন, ‘‘খুকি নগদ টাকা দিয়েই পেপার কেনেন। কখনো বাকির জন্য আসে না সে। প্রত্যেক দিনই সে আসে। ঝড়-বৃষ্টি সে কিছু মানে না। যতদিন পত্রিকা আসবে ততদিনই সে আসবে। তার কোন মিস নাই’’।
পরিবারের সদস্যদের তথ্য অনুযায়ী, সাত বোন এবং পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে খুকি দশম। আশির দশকে টাঙ্গাইলের ভারতেশ্বরী হোমসে পড়াশুনা করেছেন। অল্প বয়সে তার বিয়ে হয়েছিল, বিধবাও হয়েছিলেন কম বয়সেই। স্বামীর মৃত্যুতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন খুকি। বিপর্যয় থেকে উঠে দাঁড়াতে দ্বিতীয় বিয়ে না করে স্বাবলম্বী হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
এদিকে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দিল আফরোজ খুকির একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার ছড়িয়ে পড়েছে। যেটি ছিল ২০০৯ সালে দেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে খুকিকে নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন। ভিডিওটি নেটিজেনদের নজর কেড়েছে। অনেকে এ ভিডিও শেয়ার করে খুকির প্রশংসা করেছেন।
মামুন বিশ্বাস নামে একজন ব্যবহারকারী ভিডিওটি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘‘স্যালুট হকার খুকি আপা। প্রতিদিনের রোজগার করা ৩০০ টাকার ৪০ টাকা নিজের জন্য রাখেন, ১০০ টাকা ইয়াতিম খানায় দেন, ৫০ টাকা মসজিদ/মন্দিরে দেন, ১০ টাকা ভিক্ষুককে দেন, ১০০ টাকা জমা করেন হজ্বে যাবেন বলে।
তিনি লিখেন, এ যাবত ৬ জন অসহায় মহিলাকে ৬টা সেলাই মেশিন দিয়েছেন, ৩ জন বিধবাকে দুধ বিক্রি করে সংসার চালানোর জন্য দিয়েছেন ৩টা গাভী। খুকি আপাদের জীবনের সংগ্রাম আমাদের প্রেরণা দেয়। আমরা উনার কর্মকান্ডে জীবনের স্বার্থকতা খুঁজি। সাথে ধিক্কার আসে তাদের প্রতি, যারা এমন সংগ্রামী নারীদের সামান্য প্রয়োজনটুকুতেও কর্ণপাত করেন না’’।
২০০৯ সালে টেলিভিশনে ভিডিও সাক্ষাৎকার দেয়া মধ্য বয়সী খুকি আজ বৃদ্ধা। এখনও তার হজ্বে যাওয়ার অর্থ জোগাড় শেষ হয়নি। হয়তো কখনও আর শেষও হবে না, তার আগেই ডাক চলে আসবে মহান সৃষ্টিকর্তার। ভিডিওতে তিনি বলেছিলেন, ‘‘কেউ আমাকে এক পয়সার হেল্প করেনি। কি হবে এই সাক্ষাৎকার নিয়ে। কেউ তো আমাকে সাহায্য করবে না।’’
হকার দিল আফরোজ খুকি জানান, ‘‘আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর আমি আমার মায়ের কাছে চলে আসি। তখন মা সবাইকে জায়গা-জমি ভাগ করে দিয়ে দিলেন। তবে আমি কারো কাছে কিছু চাইবো না। আমি নিজের প্রচেষ্টায় পেপার বিক্রি করে বড় হবো’’।
তিনি জানান, আগে বেশি পত্রিকা বিক্রি হতো। লোকজনের কাছে গেলে পত্রিকা নিতো। এখন কম পত্রিকা বিক্রি হয়। লোকজন তেমন পত্রিকা কিনতে চায় না। তারপরও আমৃত্য এই পেশার সাথে থেকেই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চান তিনি।
রাজশাহী সংবাদপত্র হকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সভাপতি জামিউল করিম সুজন জানান, খুকি এখনো প্রতিদিন তিন শতাধিক কপি খবরের কাগজ বিক্রি করেন। আগে আরও বেশি বিক্রি করতেন। এখন সংবাদপত্রের বিক্রি কিছুটা কমেছে। তিনি নগদ টাকা দিয়ে খবরের কাগজ কিনেন, কখনো বাকি রাখেন না।