ফোর্বস তালিকায় ফুটপাতের ভিকি
ক্ষুধা মেটাতে অন্যের ফেলে দেয়া খাবার খেতে হতো তাকে। আবাসস্থল না থাকায় রাস্তায় কাটাতে হয়েছে অনেক রাত। সেই রাস্তা থেকেই তিনি উঠে এসেছেন বিশ্ববিখ্যাত মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের তালিকায়। এশিয়া মহাদেশের ৩০ বছরের কম বয়সী উদ্যোক্তাদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে ফোর্বস। রাস্তায় থেকে সেই তালিকায় নাম তুলেছেন ভিকি রায়।
ভারতের জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুম্বাইভিত্তিক জনপ্রিয় ফেসবুক পেজ ‘হিউম্যানস অব বোম্বে’ তে উঠে এসেছে ভিকির উত্থানের এই বিস্ময়কর গল্প। সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে মাত্র ১১ বছর বয়সে ঘর থেকে পালি্য়ে দিল্লিতে এসেছিলেন তিনি। ভিকি নিজেই বলেছেন, ‘তিন বছর বয়সে আমার মা-বাবা আমাকে দাদুর কাছে রেখে যান। কিন্তু দাদু আমাকে প্রায়ই মারধর করতেন। প্রায়ই শুনতাম সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় অনেক মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসেন। সেই কারণে ১১ বছর বয়সে দাদুর টাকা চুরি করে ট্রেনে উঠে দিল্লি চলে আসি।’
দিল্লিতে ভিকির পরিচিত কেউ ছিলেন না। যে কারণে তাকে রাস্তাতেই রাত কাটাতে হতো এবং খাবারের জন্য অন্যের দিকে চেয়ে থাকতে হতো। ভিকি বলেছেন, দিল্লিতে এসে আমি অকূল পাথারে পড়ে যাই। বেঁচে থাকার জন্য ট্রেনে পানি বিক্রি করেছি, প্রায়ই খোলা রাস্তায় রাত কাটিয়েছি। একটি বাসায় থালা-বাসন ধোয়ার কাজও করতাম। সারাদিন হারভাঙ্গা খাটুনির পর রাতে কোনো খাবারও দিত না। লোকে খাওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকত, সেগুলোই খেতে হতো আমাকে।
এই দুঃসময় বেশি দিন স্থায়ী হয়নি ভিকির। একটি বেসরকারী সংস্থার সহায়তায় জীবন বদলাতে শুরু করে ভিকির। ভিকি বলেন, ‘অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও খাবারের কারণে আমি প্রায়ই অসুস্থ হতাম। একবার চিকিৎসার জন্য একজন চিকিৎসকের কাছে যাই। আমার অবস্থা দেখে উনি আমাকে একটি এনজিওরসন্ধান দেন।পথশিশুদের পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করত সংস্থাটি। ওখানে গিয়ে আমার জীবন পাল্টাতে শুরু করে। ওখানে তিন বেলা খাবার ও নতুন কাপর পেতে শুরু করি। আমাকে তারা স্কুলেও ভর্তি করে দেয়।
তবে, ভিকির জীবন সত্যিকার অর্থেই পাল্টাতে শুরু করে এক ব্রিটিশ আলোকচিত্রীর সংস্পর্শে আসার পর থেকে। ভিকি শুনিয়েছেন তার আলোকচিত্রী হয়ে উঠার গল্প। ‘একবার এক ব্রিটিশ আলোকচিত্রী আমাদের এনজিওতে আসেন। তার কাজ দেখে আমি মুগ্ধ হই। রাস্তার মানুষের জীবন আমাকে এমনভাবে টানতে শুরু করে, যা আগে কখনো হয়নি। তখন থেকে আমি ছবির মাধ্যমে রাস্তার মানুষের দুর্দশার চিত্র ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি।’
এনজিও থেকেই একটি ক্যামেরা পান ভিকি। সেই ক্যামেরা নিয়েই শুরু হয় তার নতুন জীবনের পথচলা। ভিকি বলেন, ‘আমার বয়স যখন ১৮ হলো, এনজিও থেকে ৪৯৯ রুপি দিয়ে আমাকে একটি ক্যামেরা কিনে দেয়া হলো। স্থানীয় একজন আলোকচিত্রীর অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণেরও সুযোগ দেয়া হয়। তিনিই আমার প্রথম প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে দেন। এরপর আমার জীবন পাল্টে যায়। লোকে আমার ছবি কিনতে শুরু করে, আর আমি বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করি। আমাকে নিউেইয়র্ক, লন্ডন, দক্ষিণ আফ্রিকা, সান ফ্রান্সিসকো থেকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমি কখনোই ভাবিনি, আমার ভাগ্য এভাবে পরিবর্তিত হবে।’
ভিকির অর্জনের বাকি ছিল আরও। ২০১৪ সালে ‘এমআইটি মিডিয়া ফেলোশিপ’ পান তিনি। আর ২০১৬ সালে জায়গা করে নেন ফোর্বসের ‘এশিয়া আন্ডার থার্টি’ তালিকায়।
নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে অন্যদের পরামর্শ দিয়েছেন ভিকি। হাল না ছেড়ে নিজের স্বপ্নকে তাড়া করার পরামর্শ দিয়ে ভিকি বলেন, ‘আমি এটা বুঝতে পেরেছি, আমাদের সবার সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানোর সৌভাগ্য হয় না। একসময় আমার হাতে কিছুই ছিল না। কিন্তু আমি এখন আমার স্বপ্নকে ছোয়ার খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। শীর্ষে পৌঁছাতে হলে ধৈর্য থাকতে হবে। বিশ্বাস রাখতে হবে, ঝড়ের পর সূর্যও ওঠে।’