জীবনের গল্প: বাবার সম্মান রক্ষায় এএসপি দিদার নূর
কয়েক বছর কথা। জনৈক এক চাচার ছেলে ৩৪তম বিসিএসে ক্যাডার হয়েছে; সেই খবর দিতে উনি আমাদের বাসায় এসেছিলেন। আমার বাবা ছিলেন খুব আবেগী মানুষ। উনার সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে তিন খুব বড় মুখ করে তাকে বলে ফেললেন; ভাই- দেখবেন আমার ছেলেও একদিন বিসিএস ক্যাডার হবে, পুলিশের এএসপি হবে। চাচা চোখ কপালে তুলে উত্তর দিয়েছিলেন এএসপি! হাবভাবে বুঝালেন- আমি মোটেও এএসপি হওয়ার যোগ্য নই।
শুধু তাই নয়, রাখঢাক না রেখে বলেই দিলেছিলেন, আগে একটা সরকারি চাকরি পেয়ে দেখাক তারপর না হয় এএসপি। আর আপনার ছেলের এসএসসি, এইসএসসি’র রেজাল্টও তো এত ভালো না। এএসপি হতে গেলে ভাল একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন লাগে। বাবার মুখটা দেখি মুহুর্তের মধ্যেই মলিন হয়ে গেছে। চাচা চলে গেলে বাবা আমার কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন এএসপি তোকে হতেই হবে। দরকার পড়লে চাকরিতে আবেদন করার শেষ সময়টুকু পর্যন্ত চেষ্টা করবি। তোর অন্য কোন চাকরি করা লাগবে না, এতদিন যখন তোর খরচ চালাতে পারছি বাকি দিনটুকুও পারবো।
তিনি আরো বলেছিলেন, আর কত মানুষের সামনে আমাকে ছোট করবি, নিজে অপমানিত হবি। তোর কাছে জীবনে কোনদিন কিচ্ছু চাইনি। অন্তত বিসিএস ক্যাডার হয়ে দেখা, তুই পারিস। আমি তো তোকে পড়ে দিতে পারব না, এটা ছাড়া যদি নিজের শরীরের রক্তও দেয়া লাগে; তবুও তা তোর জন্য দিব। নিজের ভিতরে একটু জেদ সৃষ্টি কর। তুই আমার ছেলে, আমি জানি তুই পারবি। ঠিক এই কথাগুলিই ৪ বছর আগে বাবা আমাকে বলেছিলেন।
চরম অপমানে সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম Either perish or survive. হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম আর অযত্ন অবহেলায় শরীরটা রীতিমতো অসুখ-বিসুখের অভয়ারণ্য হয়ে গিয়েছিল। তবুও হাল ছাড়িনি। বিশ্বাস ছিল- মহান আল্লাহ এ পরিশ্রমের প্রতিদান আমাকে একদিন অবশ্যই দেবেন। আমাকে চাকরির শেষ বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি। এর আগেই পরম করুণাময়ের অশেষ অনুগ্রহে শুধু এএসপি না, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে আরো কয়েকটা চাকরি পেয়েছি। আফসোস শুধু একাটাই, বাবা দেখে যেতে পারলেন না তার ছেলে আজ এএসপি।
পুলিশ ক্যাডার প্রাপ্তির এ খবরটা বাবাকে না দিতে পারার আক্ষেপ আমাকে সারাজীবন তাড়িয়ে বেড়াবে। যাই হোক, কথাগুলো এজন্যই বলা যে, আজকে হয়তো কেউ আপনার চেষ্টাকে ব্যঙ্গ করছে, তাচ্ছিল্য করছে। সাফল্য আসলে দেখবেন এরাই আপনাকে সাধুবাদ জানানোর জন্য এগিয়ে আসবে। পৃথিবীতে অযোগ্যরা শারীরিক-মানসিক দুই দিক দিয়েই পড়ে পড়ে মার খায়।
আমেরিকার ৩০তম প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কলিজ বলেছিলেন ‘কোন কিছু করার মূল হাতিয়ারই হলো কাজ করা।’ অর্থাৎ কোনকিছুই আপনি করতে পারবেন না, যদি তা করার জন্য আপনার চেষ্টা না থাকে। কোনকিছুই আপনি বানাতে পারবেন না, যদি আপনি তা গড়তে না চান। চেষ্টার আরেক নামই হলো পরিশ্রম, পরিশ্রম এবং পরিশ্রম। বিশৃঙ্খল জীবনকে বেধে ফেলুন শৃঙ্খলার শিকলে। পথটা সে যেমনই হোক লক্ষ্যে থাকুন স্থির। কী হয়েছে তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ আপনি কি ঘটাতে চলেছেন।
সবকিছু ঝেড়ে ফেলে নতুন করে শুরু করুন। আরও একবার বলীয়ান হোন স্বপ্ন পূরণে। আরও একবার জীবনটাকে সাজান নতুন করে। আরও একবার ভুলে যান পিছনের অতীত। নতুন করে আবার শুরু করুন। গতকালের ইতিহাস যেমনই হোক আগামী ইতিহাসটা বদলে যাবে। (পুনঃপ্রকাশিত)
লেখক: দিদার নূর, সহকারী পুলিশ সুপার(৩৭ তম বিসিএস)। মেধাক্রম-৮
আরো খবর:৪০তম প্রিলি নিয়ে চার পুলিশ ক্যাডারের পরামর্শ: কনফিউশন উত্তর না দাগানোই প্রিলির প্রধান কৌশল