ওর বয়স ছিল ১৭, এখনও অবশ্য ১৭-ই, কারণ ও তো ১৭-তেই আটকে থাকবে...
শহীদ ফারহান ফাইয়াজের বোন সাইমা ফারিন বলেছেন, আমার ভাইয়া, শহীদ ফারহান ফাইয়াজ, এখন এই নামেই পরিচিত। ভাইয়ার পুরো নাম মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া ফাইয়াজ। গত বছরের ১৮ জুলাই ভাইয়া ‘শহীদ ফারহান ফাইয়াজ সড়ক’ (পুরনো ধানমন্ডি ২৭) এ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে স্বৈরাচারী বাহিনীর গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়। আর সেসময়েই তার জীবনের আলো নিভে যায়। ভাইয়া ছিল ঢাকার প্রথম শহীদ।
বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে এসব কথা বলেন তিনি।
ফেসবুক পোস্টে সাইমা ফারিন বলেন, ‘আমার ভাইয়া ছিল আমার থেকে ১ বছর ১০ মাসের বড়। ওর বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। এখনো অবশ্য ১৭ ওর বয়স, কারণ ও তো ১৭-তেই আটকে থাকবে...। ভাইয়া ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল। আমরা ছিলাম এক ভাই এক বোন...। আর এখন?। আমি তো একা….খালি হাহাকার জীবনে…। আমার একমাত্র ফুলের মতো জলজেন্ত ভাইকে স্বৈরাচারী বাহিনী টার্গেট করে ঠিক বুক বরাবর গুলি করে মেরেছে।
শহীদ ফারহান ফাইয়াজ মেধাবী ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার ভাই ছোট থেকেই ছিল খুব মেধাবী..। তার ছোট একটা উদাহরণ আপনাদেরকে দেই। ভাইয়াকে যখন ঢাকা রেসিডেনশিয়াল মডেল কলেজে ৩য় শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়, তখন হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মাঝে ভাইয়া ভর্তি পরীক্ষায় দশম স্থানের অধিকারী হয়। শুধু এটা না ওর স্কুলের শিক্ষকদের কাছে কিংবা যত শিক্ষক এখন পর্যন্ত ভাইয়াকে পড়িয়েছে প্রত্যেকের কাছেই ওর বেশ সুনাম রয়েছে। প্রত্যেক শিক্ষকই বলত ভাইয়াকে কোনো পড়া একবার দেখিয়ে দিলে দ্বিতীয়বার তা আর দেখানো লাগত না।
আরও পড়ুন: ‘ও সেদিন আমার জামা পড়ে বের হয়েছিল’—মুগ্ধকে নিয়ে ভাই স্নিগ্ধর বেদনাঘন লেখা
শহীদ ফারহান ফাইয়াজ সারাদিন বই নিয়ে বসে থাকতেন না জানিয়ে সাইমা ফারিন বলেন, আমার ভাইয়া কখনো বই নিয়ে সারা দিন বসে থাকত না। তবে যে সময়ই পড়ত খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ত আর খুব অল্পতেই কোনো পড়া ক্যাপচার করে ফেলতে পারত ব্রেইনে।
মেধা যেমন ছিল ঠিক তেমনি দেখতে শুনতেও ছিল খুব নম্র, ভদ্র, উদার ও মানবিক। ভাইয়া যেখানেই যেত সবাই তাকে পছন্দ করত।করবেই না বা কেন? আমার যেই ভাই কখনো করো সাথে ঝগড়া তো দূরে থাক গলা উঁচু করেও কোনো দিন কথা বলেছে…। এরকম মন্তব্য পাওয়া অসম্ভব।
তিনি বলেন, ‘নিজের ভাই বলে আমি বলছি না, আমার ভাই না আসলে একটা ফেরেশতা ছিল বটে। কেননা ওর চেহারাতে একটা নূর দেখতে পেতাম আমরা সবসময় আর নূর হবেই না বা কেন ও তো ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত তাহাজ্জুদসহ। আর ছিলইতো নিষ্পাপ একটা বাচ্চা। ভাইয়ার বন্ধু-বান্ধবরা আর টিচার ভাইয়ার সৌন্দর্যের জন্য তাকে দুষ্টমি করে ধলা বলেই ডাকত।
শহীদ ফারহান ফাইয়াজ ছোট থেকেই স্কুলের সাইন্স ফেস্টের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন জানিয়ে সাইমা ফারিন বলেন, ভাইয়া ছোট থেকেই তার স্কুলের সাইন্স ফেস্টের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। সে প্রত্যেক বছর ফেস্টে পার্টিসিপেট করত আর অনেক ক্রিয়েটিভ জিনিস বানাত। কখনো কখনো কোনো কিছুর হেল্প ইউটিউব থেকে নিত আর সেভাবেই বহু আকর্ষণীয় জিনিস বানাত। আর গত বছর (ফেব্রুয়ারিতে) ভাইয়া নিজে সাইন্স ফেস্টের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েছিল ফেস্টটাকে পরিপূর্ণভাবে ম্যানেজ করার জন্য। ও ছিল সাইন্স ক্লাবের একটিভ মেম্বার, ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার আলাপও চলছিল। বড় হয়ে হতে চাইত সায়েন্টিস্ট কিংবা গবেষক তো কখনো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার।
যেই বই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরে সেই বই সে কলেজে থাকতেই পড়ত উল্লেখ করে তিনি বলেন, যখন ভাইয়া কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে তখন থেকেই সে ফান্ডামেন্টাল ফিজিক্স অর্থাৎ যেই বই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরে সেই বই সে কলেজে থাকতেই পড়ত। এমন বহু একাডেমিক বই সে কলেজে থাকতেই পড়ত। এ ছাড়াও সে বিভিন্ন রকমের বই পড়ত।
আরও পড়ুন: ছাত্রলীগের বর্বর হামলার শিকার হয়ে পালানো শিক্ষার্থীদের জুলাইয়ের বিভীষিকার গল্প
ভাইয়ার ইচ্ছা ছিল এইচএসসি এক্সাম শেষ করে হায়ার এডুকেশন এর জন্য যুক্তরাজ্যেতে চলে যাওয়া যদিও বাবা প্রথমে রাজি হয়নি।পরে ভাইয়া যখন বাবাকে চ্যালেঞ্জ করে যে, সে এইচএসসির পর বুয়েটে এক্সাম (এর জন্যই ফান্ডামেন্টাল ফিজিক্স বইটা পড়ত) দিয়ে চান্স পেয়ে দেখাবে। তবে তাও সে যুক্তরাজ্যতেই পড়তে যাবে এবং পড়া শেষ করে আবার দেশে ফিরে এসে দেশের মানুষের জন্য কিছু করবে তখন বাবা রাজি হয়.. আর তারপর সেরকম প্রস্তুতিই নেয়া হচ্ছিল কিন্তু তারপর তো…..।
এবার ভাইয়ার উদারতার গল্প বলা যাক বলে সাইমা ফারিন বলেন, গত বছর যখন ভাইয়া সাইন্স ফেস্টে ভলান্টিয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে তখন ও নিজে না খেয়ে ওর নিজের খাবারের প্যাকেটটাই এক জুনিয়র ভাইকে দিয়ে দেয়। এমনকি কোভিড-১৯ এর সময়েও রাস্তার বহু অসহায় মানুষকে সে খাবার বিতরণ করে। এটাতো জাস্ট উদাহরণ দিলাম এরকম বহু বৈশিষ্ট্যে ভাইয়ার মধ্যে বিদ্যমান ছিল যা বলে শেষ করা যাবে না…। বলা যায় ভাইয়ার আদর্শে মানবতা ও উদারতার এক উজ্জল দৃষ্টান্ত ছিল। যেসব সময় নিজের কথা না ভেবে পরের কথা ভাবত আর ছিলই তো পরোপকারী। নিজের সর্বস্ব দিয়ে পরকে ভালো রাখতে চেষ্টা করত…। ঠিক যেমন পরকে ভালো রাখতে গিয়েই সেই অভিশপ্ত ১৮ জুলাই, ২০২৪ ভাইয়া শহীদ হয়!!।
তিনি বলেন, সেদিন ছিলো দূর্বিশহ ১৮ জুলাই যেদিন ভাইয়া সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জিদান ভাইয়ার (ভাইয়ার বন্ধু) ফোন কল পেয়ে ঘুম থেকে উঠে যায় আর তারপর তাড়াহুড়া করে গোসল করে রেডি হয়ে কলেজের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে আম্মুকে সালাম দিয়ে সাড়ে ১১টার দিকে বের হয়ে যায়। আম্মু অনেকবার বারণ করেছিল কিন্তু ও শুনেনি..। তারপর তো আম্মু আর আমি অনেক টেনশনে পড়ে যাই চারিদিক থেকে অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ শুনতে পাই। ভাইয়াকে আম্মু কল করে ১টার একটু পর তারপর ও কল রিসিভ করে বলে ও ধানমন্ডির রাপা প্লাজার ওখানে লুকিয়ে আছে আর আম্মু তখন বলে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসতে। তারপরেই কলটা কেটে যায়। আবারও আম্মু অনেকবার কল করে কিন্তু তারপর আর কল ধরে না ভাইয়া…।
আরও পড়ুন: ১৮ জুলাই: আন্দোলন দমাতে পুলিশের গুলি, নিহত ৩১— বন্ধ ইন্টারনেট সেবা
ভাইয়া নাকি ধানমন্ডি ২৭ জেনেটিক প্লাজার সামনে ওর জুনিয়র ভাইদেরকে সামনে থেকে সরাতে গিয়ে ১:৪৫ থেকে ২:১৫ টার মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয় আর আড়াইটার দিকে ভাইয়ার ফ্রেন্ড ওয়াসিফ ভাইয়া বাবাকে কল করে জানায় আর বাবা দ্রুত সিটি হসপিটালে ছুটে যায়।
তারপর আর তো পেল না বাবা ভাইয়াকে। ভাইয়ার নাম তখন শহীদের লিস্টে যোগ হয়ে যায়। ঢাকার প্রথম শহীদ ফারহান ফাইয়াজ!!!
তিনি আরও বলেন, ভাইয়া শহীদ হওয়ার পরপরই আমার আন্টি নাজিয়া খান ফেসবুকে একটি পোস্ট করে যেখানে লিখা ছিল যে, This is my Farhan Faiyaaz. He is dead now.I want justice.। এই পোস্ট ১৮ জুলাই যখন বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তখন সবার মনে প্রতিবাদের ঝড় উঠে।
কেউ আর নিজেকে ঘরে আটকিয়ে রাখতে পারে না নির্বিশেষে সবাই মা, বোন, ভাই, শিক্ষক, পেশাজীবীরা রাজপথে নেমে পরে বিচারের জন্য। ভাইয়ার মৃত্যুর পর আন্দোলনে যোগ হয় নতুন মাত্রা। কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নেয় জুলাই গণঅভ্যুত্থান হিসেবে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলি ভাইয়ার ঘটনার পরেই জানতে পারে বাংলাদেশের এই করুন পরিস্থিতি সম্পর্কে।তারপর তারা যখন খুনি হাসিনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তখনি খুনি হাসিনা ১০ দিনের জন্য ইন্টারনেটে অফ করে দেয় আর এরই মধ্যে সে গণহত্যা চালায় এমনকি অনেক লাশ গুম করে পুড়িয়েও ফেলেছিল।
আরও পড়ুন: ১৬ জুলাইয়ের উদ্যমই ছাত্র সমাজকে ৩৬ জুলাই অবধি নিয়ে গিয়েছিল
বিল, ঝিল ও নদিতে ফেলে দিয়েছিল। এইতো ১৮ জুলাই যখন আমরা ভাইয়াকে দাফন করার জন্য আমাদের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছিলাম তখনও আমাদের গাড়িতে হামলা করা হয় এবং কাঁচ ভেঙে দেয় আওয়ামী লীগের বাহিনীরা। আমার খালা আমার পাশেই বসেছিলেন আর আওয়ামী সন্ত্রাসীরা গাড়ি লক করা না থাকায় গেট খুলে আমার খালাকে গাড়ি থেকে নামানো শুরু করে। ওরা যদি জানত আমার ভাই একজন শহীদ তাহলে হয়ত কখনও ভাইয়াকে আর দাফন করতে পারতাম না।আমরা ওদেরকে ডেথ সার্টিফিকেট দেখিয়ে কোনো মতে যেতে পারি নারায়ণগঞ্জ।
সাইমা ফারিন বলেন, আর আমাদের দাফন করার টাইমও মাত্র ৪০ মিনিট দেয়া হয়ছিল আর দেখেন ইতিহাসের কি নির্মম পরিহাস হাসিনা যখন দেশ ছেড়ে পালায় তখন ও তাকে এই রকম সময়ই হাতে বেঁধে দেয়া হয়েছিল। আর ১৮ জুলাই যেহেতু আমার ভাইয়ার ঘটনা পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে তখন কিন্তু অনেকেই বাইরের দেশগুলোতে আমার ভাইয়ার ছবি নিয়ে প্রোটেস্ট করে ,যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশসহ বহির বিশ্বে হাসিনা সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি হয় এবং আন্দোলন বেগবান হয়, এরই ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়।
তিনি বলেন, পরিশেষে আমি বলতে চাই আমি আসলে জানি না যে দেশ আসলে এই শহীদের রক্তের ঋণ কখনো শোধ করেতে পারবে কিনা। আমার ভাই তো দেশের জন্য সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ ভাবে জীবন দিয়েছিল দেশের কথা ভেবে দেশের মানুষের কথা ভেবে। আর ওর ফেসবুক বায়োতেও লিখা ছিলো one day you will leave this world behind, so live a life you will remember.অর্থাৎ একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে তাই এমন জীবন গড় যাতে মৃত্যুর পরেও মানুষ তোমাকে মনে রাখে।
মানুষ কত দিন মনে রাখবে জানিনা কিন্তু আমাদের পরিবারের জন্য এই ক্ষত সরাজীবনের জন্য অপূরণীয়। আমি বলব আমার পরিবারই শুধু ভাইয়াকে হারায় নি এই পুরা জাতি একটা রত্ন কে হারিয়ে ফেলল এই দেশ থেকে!! এর বিচার দেখার জন্যই শুধু অপেক্ষা করি এখন প্রতিদিন জানিনা এই অপেক্ষা কবে শেষ হবে আর ভাইয়ার সাথে আবার কবে দেখা হবে..দেখা হবে জান্নাতের সিঁড়িতে। দেখা হবে আরশে আজিমের অভিমুখে। সেই অপেক্ষায়.....