কর্মক্ষমতা হারিয়ে ‘পরিবারের বোঝা’ হয়ে বেঁচে আছেন আহত আরিফ

আরিফ হোসেন
আরিফ হোসেন  © সংগৃহীত

আরিফের স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শেষ করে ভাল একটা চাকুরি করবেন। তারপর পরিবারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনবেন। সেই আশায় বুক বেঁধে প্রবল আগ্রহ নিয়ে লেখাপড়াও চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু বিধি বাম একটি বুলেট। সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে তাঁর।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পিঠে পুলিশের বুলেটে গুরুতর আহত হয়ে এক রকম অচল অবস্থায় জীবনযাপন করছেন আরিফ হোসেন (২০)। বর্তমানে নিজের চিকিৎসা ও সংসারের খরচের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে চোখেমুখে যেন অন্ধকার দেখছেন। কবে সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবেন তাও জানেন না আরিফ।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেয়ার পর পুলিশের ছোঁড়া গুলি পিঠে বিদ্ধ হয় তার। বুলেট বুকের পাঁজর ভেদ করে বাম হাতের ডানা ছিদ্র করে বেরিয়ে যায়। খাদ্য নালীও ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার। সেদিন আরিফ ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেছেন। কিন্তু  ৫০দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে  তাকে। শেষ করে এখন বাড়ি ফিরেছেন। খাবার খাওয়ার পরেই পেটে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে হয় তাকে। এ ব্যথা প্রায় দুই ঘন্টা স্থায়ী হয়।

এখনও তিনি শঙ্কামুক্ত নন। আরিফ হোসেনের বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নের শালিয়াবহ গ্রামে। মৃত আবুল কাশেম ও আন্না খাতুনের দুই ছেলের মধ্যে ছোট ছেলে আরিফ। তিনি এ বছর ধলাপাড়া কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ (৪.০৮) পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। আরিফের বাবার মৃত্যুর পর তার মা অসুস্থ থাকার কারণে তাকে বিয়ে করতে হয়েছে। বিবাহিত জীবনে আরিফের স্ত্রীসহ দেড় মাসের একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান রয়েছে।
 
টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নের শালিয়াবহ গ্রামে গিয়ে আরিফ হোসেনের বাড়ি কোনদিকে জানতে চাইলে এলাকার লোকজন তার বাড়িতে নিয়ে যায় এ প্রতিবেদককে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, একটি টিনের ঘরে আরিফের পরিবারের বসবাস। সাংবাদিক এসেছেন শুনে তিনি খুবই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। যদিও পুরো মুখে ছড়িয়ে রয়েছে বিষণ্নতার ছাপ। এদিকে মুর্হুুতের মধ্যে এলাকার লোকজন তার বাড়িতে এসে ভীড় জমাতে শুরু করে।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আরিফ হোসেন বলেন, শুরু থেকেই আমি ঘাটাইলে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেই। গত ১৯ জুলাই চাচাতো ভাই রায়হান সিঙ্গাপুর চলে যাবে বিধায় তাকে নিয়ে ঢাকায় এয়ারপোর্টে পোঁছে দেই। এরপর আমি সেই দিন ঢাকায় থেকে যাই। পরের দিন বন্ধুদের সাথে উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এলাকায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে অংশ নেই। সেদিন আমরা বিভিন্ন স্কুূল-কলেজের প্রায় ৬০ ছাত্র-ছাত্রী ছিলাম। আমরা যখন মিছিল করতে শুরু করি তখন হঠাৎ দেখি তিনটি পুলিশের গাড়ি আসে ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। আমাদের মিছিল লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে থাকে। হঠাৎ একটি গুলি আমার পিঠে বিদ্ধ হয়ে বুকের পাঁজর ভেদ করে হাতের ডানা ছিদ্র করে বেরিয়ে যায়। এর পর আমি আর কিছুই জানি না।

তিনি বলেন, কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানতে পারি গুলিটি ফুসফুসের কিছু অংশ ছিদ্র হয়ে বেরিয়ে গেছে। যার কারণে অপারেশনের মাধ্যমে ফুসফুসের কিছু অংশ কেটে ফেলতে হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দীর্ঘ ৫০ দিন  চিকিৎসা শেষে  গত ৯ সেপ্টেম্বর বাড়ি ফিরি। এখন বাড়ি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছি। ডাক্তার বলেছে, আরো তিন বছর চিকিৎসা করাতে হবে। আমি শুধু মাত্র ১৪ আগস্ট থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারি খরচে চিকিৎসা সুবিধা পেয়েছি। আমার পরিবারে মা, নানী, স্ত্রী-সন্তানসহ ৫ জন রয়েছে। সংসারের খরচ বহন করে পরিবারের পক্ষে আমার চিকিৎসা খরচ আর বহন করা সম্ভব হচ্ছে না।

আরিফের মা আন্না খাতুন (৫০) জানান, গত ২০ জুলাই ঢাকার উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এলাকায় বন্ধুদের সাথে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেয় আরিফ। সেখানে মিছিলে থাকা আরিফ পুলিশের ছোঁড়া গুলি পিঠে বিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পরে তাকে প্রাথমিক অবস্থায় ১৩ নম্বরে উত্তরা স্পেশালিস্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রথম দফায় অপারেশন শেষে আইসিইউতে রাখা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে পরের দিন আরিফকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে দ্বিতীয় দফায় অপারেশন করা হয়। তখন ডাক্তারা জানায়, গুলি লাগার কারণে আরিফের ফুসফুসের একট অংশ ছিদ্র হয়ে গেছে। এ জন্য কিছু অংশ কেটে ফেলতে হয়। এ ছাড়াও খাদ্য নালি ছিঁড়ে গেছে। এর পর তৃতীয় দফায় অপারেশন করা হয়। তখন আমরা সবাই ভেবেছিলাম ও আর বাঁচবে না। সকলের দোয়ায় আল্লাহ ওকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এ জন্য আল্লাহর কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া।

তিনি আরও জানান, ঢাকায় চিকিৎসার সময়ে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এ খরচ আমার পরিবারের একার পক্ষে বহন করা সম্ভব ছিল না। এ পরিস্থিতিতে আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার কর্য করতে হয়েছে। এই ঋণই এখনো শোধ করতে পারিনি। তারপর আরিফের চিকিৎসা, ঔষধপত্র কেনা, সংসারের খরচ বহন করে আমি এখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। বড় ছেলে আল-আমিন কে ঋণ করে সাত বছর আগে বিদেশে পাঠিয়েছি ভাগ্য বদলের আশায়। সেখানে গিয়েও তেমন সুবিধা করতে পারেনি ও। এখনও ঋণের টাকা পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। এখন প্রতি মাসে যা টাকা দেয় তাতে আমাদের সংসার চলে না। আমাদের কোন আবাদি জমি নেই, সবই কিনে খেতে হয়। সর্বোপরি আমার ছেলে আরিফ সুস্থ হয়ে ফিরলে সরকার যদি একটা চাকুরির ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে খুবই ভাল হয়।

আরিফের ফুফা মোঃ শাহ আলম জানান, আরিফকে এলাকায় লোকজন খুবই বিনয়ী ও পরোপকারী বলে জানে। এ পরিবারটি খুবই দরিদ্র ও অসহায়। সকলের সাহায্য ও সহযোগিতায় তাদের সংসার চলে। আরিফ বর্তমানে কর্মক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে। আরিফের বাবার মৃত্যুর পর ওর মা দীর্ঘ দিন অসুস্থ ছিল। ওর মায়ের দেখাশুনা ও সংসারের কথা ভেবে ২০২২ সালে এসএসসি পাস করার পর আরিফকে বিয়ে করতে হয়। তার ঘরে একটি মেয়ে রয়েছে। তাদের খরচও চালাতে হয়। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকার অনুদান ছাড়া ওরা আর কিছুই পায়নি।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘাটাইলের অন্যতম সমন্বয়ক রাকিবুল হাসান রাকিব বাসসকে জানান, আরিফের চিকিৎসা বাবদ অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। পুরোপুরি সুস্থ হতে এখন আরো অর্থের প্রয়োজন। পরিবারের পক্ষে এ অর্থের যোগান দেয়া খুবই কষ্টকর ব্যাপার। আমরা বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে আরিফের বিষয়ে আবেদন পত্র জমা দিয়েছি। এ ছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে কেউ যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত তাহলে আরিফকে সুস্থ করতে অনেক সহজ হতো। সেও তার স্বপ্ন পূরণের পথে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যেতে পারতো।

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক শরিফা হক বাসসকে জানান, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যেসব পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে আমরা তাদের সামন্য কিছু সহযোগিতা করতে সক্ষম হয়েছি। ভবিষ্যতে এ ধারা অব্যাহত থাকবে। তাছাড়া সরকারিভাবে ঘোষণা আছে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে আহতদের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে দেয়া হবে।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence