ত্যাগের উৎসব প্রবাসে, মাহবুবের স্মৃতিতে বাংলার ঈদ
বছর ঘুরে আবার হাজির মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। আমাদের আশেপাশে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা দেশ ও পরিবার ছেড়ে শতশত মাইল দূর বিভুঁইয়ে ঈদের সময়টা নিভৃতে পার করেন। তাদেরই একজন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইইই বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মাহবুব উল ইসলাম খান।
বর্তমানে তিনি জার্মানির ফ্রাইবার্গ শহরে অবস্থিত পৃথিবীর প্রথম এবং সবচেয়ে প্রাচীনতম মাইনিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাথমেটিক্যাল ডেটা সায়েন্স বিষয়ে অধ্যয়নরত।
ঈদ হিসেবে দেশের বাইরে মাহবুবের দ্বিতীয় ঈদ এবং প্রথম কোরবানির ঈদ। তিনি জানান, এবারের ঈদে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) বন্ধু মাহেরের বাসায় যাবো এবং দুজনে মিলে ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা আছে। কারণ আমরা দুজনেই পরিবার থেকে দূরে একা ঈদ করবো। ঈদের আগে-পরে আমার দুইদিন ছুটি আছে, তাই আশা করি কোনো কর্মব্যস্ততা থাকবে না এবং ঈদ ভালোভাবে উপভোগ করতে পারবো।
ঈদুল ফিতর থেকে তো ঈদুল আযহা ব্যতিক্রম। এ ঈদের উদযাপনটা সম্পর্কে তিনি বলেন, ঈদুল ফিতর থেকে ঈদুল আযহা আলাদা কারণ এটি ত্যাগ ও সহনশীলতার উৎসব। ছোটবেলা থেকেই আমি কাজিনদের সাথে ঈদুল আযহা উদযাপন করে আসছি। ঈদুল ফিতরের তুলনায় এ ঈদে গৃহস্থালির কাজ ও দায়িত্ব অনেক বেশি থাকে। কোরবানির পশু দেখাশোনা, প্রসেস সব মিলিয়ে দুপুর গড়িয়ে যেত। এরপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে কাজিনদের সাথে ঘুরে বেড়ানো, সবার বাড়িতে যাওয়া, আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠা এটাই ছিল আমাদের ঈদের দিনের রুটিন।
সাংস্কৃতিক ভাবনায় জার্মানির চেয়ে দেশের ঈদ উপভোগ্য মাহাবুবের কাছে। তিনি জানান, সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, নিজ দেশের ঈদের উৎসব বিদেশের ঈদের চেয়ে অনেক বেশি উপভোগ্য। কারণ, জার্মানির সংস্কৃতিতে ঈদের ধারণা নেই। ঈদের দিন এখানে প্রতিদিনের মতোই একটি কর্মব্যস্ত দিন হিসেবে পালিত হয়। তবে, এবার ঈদুল আযহা রবিবারে পড়েছে, যা পাবলিক হলিডে। তাই আশা করছি মুসলিম সম্প্রদায় এবার ঈদকে একটু ভিন্নভাবে উদযাপন করতে পারবে। সামগ্রিকভাবে, নিজ দেশের ঈদের সাথে জড়িত রীতিনীতি, আবেগ, আনন্দ-উৎসব বিদেশের ঈদের চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ ও মনোমুগ্ধকর।
পরিবারকে রেখে বিদেশের মাটিতে ঈদ নিশ্চয়ই বেদনাদায়ক। তিনি বলেন, পরিবারকে রেখে বিদেশের মাটিতে ঈদ করা নিঃসন্দেহে বেদনাদায়ক। মাকে রেখে ঈদ করতে হবে এই চিন্তা মনের মধ্যে খারাপ লাগা তৈরি করে। হঠাৎ করেই মা একা হয়ে গেলেন। আমরা তিন ভাইবোন। বছরের শুরুতে আমার বোনের বিয়ে হয়েছে এবং সে তার শ্বশুরবাড়িতে ঈদ করবে। আমি চলে এসেছি জার্মানিতে। আমার মা এবং ছোট ভাই একাই ঈদ করবে। জন্মের পর থেকে কখনোই বাসার বাইরে ঈদ করিনি, আর এখন ছোট ভাইটাও আমাদের দুইজনকে ছাড়া একদম একা হয়ে গেল।
আমার বাবা যেদিন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, সেদিন থেকেই আমিই পরিবারে একমাত্র অবলম্বন। তারপর থেকে রাস্তা পার হতেও আমি অনেক সাবধানে চলতাম, কারণ আমাকে অবলম্বন করে আমার মা, ভাই এবং বোন আছে। সেই পরিবারকে কতটা মিস করব, তা বলে প্রকাশ করা যাবে না। তবে দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার জন্য আসাটা আমার নিজের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ ছিল এবং আমি তা সফলভাবে অতিক্রম করেছি। তাই আমার কোনো আক্ষেপ নেই।
শৈশবের ঈদ ছিল আনন্দের, উৎসবের, এবং নির্মল প্রত্যাশার এক অপূর্ব মেলবন্ধন। মাহাবুব বলেন, ঈদের আগের রাত, মানে চাঁদ রাত, ছিল সবচেয়ে রোমাঞ্চকর। সকল কাজিন মিলে আড্ডা দিতাম, গল্প করতাম, হাসি-খুশিতে রাত কাটাতাম। ঈদের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ঈদের নামাজ পড়তাম।
সবাই সবার বাসায় গিয়ে ঈদের খাবার খেতাম। আমাদের গণ্ডি ছিল তখন বাড়ির চত্বরে, এখন আমরা অন্য দেশে।এখন দেশ থেকে অনেক দূরে এসে থাকলেও, শৈশবের ঈদের স্মৃতি এখনো অমলিন। সেই আনন্দ, সেই উৎসব, সেই নির্মল প্রত্যাশা- সব যেন মনে হাতছানি দিয়ে ডাকে। মনে হয় যেন ফিরে যেতে পারলে আবার সেই সুন্দর দিনগুলোকে স্পর্শ করা যাবে।