শতকরা ২০ তরুণই মানসিক রোগী: বাড়াচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া
বিশ্বে প্রতি ৫ জন তরুণের মধ্যে একজন মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন। সে হিসেবে প্রতি শতকে এই সংখ্যা ২০ জন অর্থ্যাৎ ২০ শতাংশ। তথ্যমতে, ফেসবুকসহ সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের ৯০ ভাগই ১৮-২৯ বছর বয়সী তরুণ। যাদের মধ্যে বিভিন্নভাবে প্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে এর ঝুঁকি উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
অপর এক বেসরকারি সমীক্ষায় দেখা গেছে, তরুণ প্রজন্মের বড় একটি অংশের মানসিক চাপের একমাত্র কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। রাত জেগে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারের কারণে ৯০ শতাংশ মানুষের ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়। সে থেকে একাধিক শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মানসিক চাপ বাড়ে। ফলে মানিসিকভাবে ভাঙতে শুরু করেন তারা। অনেকেই অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছবি বা তথ্য শেয়ার করে সোশ্যাল মিডিয়াতে।
এতে করে ৬০ শতাংশ ব্যবহারকারী, সম্পর্ক বা সামাজিক সম্মান হারানোর মতো বিভিন্ন আশঙ্কায় ভোগেন। এদের মাঝে ১৪ শতাংশ ব্যবহারকারী আবার মানসিক চাপ কমাতে তামাকজাত দ্রব্যে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। সোশ্যাল মিডিয়ার অভিশাপ চক্রাকারে ঘুরতে থাকে জীবনের নানা স্তরে। শুধু ব্যক্তি জীবনেই নয়, নেতিবাচক প্রভাব পরে পারিবারিক জীবনেও।
তরুণ প্রজন্মের জন্য এমন সব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়েই আজ ১০ অক্টোবর, বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালিত হচ্ছে। প্রতিবছরের ন্যায় এবারও দিবসটি পালিত হবে নানা আয়োজনে। স্বাস্থ্যে তরুণদেরকে গুরুত্ব দিয়ে এবারের স্লোগান ‘পরিবর্তনশীল বিশ্বে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য’।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বায়নের প্রভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক, অথৈর্নতিক, প্রযুক্তি- সবখানেই পরিবতর্ন হচ্ছে। যার ছোঁয়ায় তরুণরা বেশি প্রভাবিত হচ্ছেন। আর প্রযুক্তিতে মগ্ন থাকার এই প্রবণতা এক ধরনের আসক্তিতে পরিণত হচ্ছে। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আহম্মেদ হেলাল বলছিলেন, সাইবার বুলিং হলো ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহার করে কাউকে বিরক্ত, ক্ষতিগ্রস্ত, ট্রমাটাইজ বা কারও কোনো খারাপ ছবি প্রকাশ করা। এতে করে তরুন ও শিশুদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যেটাই তরুণদের ট্রমা বা মানসিক ও শারীরিক আঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তার ভাষ্য, বতর্মানে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় সবোর্চ্চ কারণ সুইসাইড। এ কারণেই তরুণদের মানিসক স্বাস্থ্যের বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রমক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের আথির্ক সহায়তায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ৫ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের জুন মাস পযর্ন্ত দেশের সাতটি বিভাগের ১২টি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ২ হাজার ১৫৮ জন মানসিক রোগীর ওপর একটি সমীক্ষা চালানো হয়। জরিপে দেখা যায়, গুরুতর মানসিক রোগীদের মধ্যে বিভিন্ন শারীরিক রোগের হার শতকরা ৪২ ভাগ। ১৮ বছরের নিচে নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅডার্র রোগীদের বিভিন্ন শারীরিক রোগের হার ৩২ শতাংশ এবং মাদকাসক্ত রোগীদের ২১ ভাগ বিভিন্ন রোগে ভুগছেন।
আর ১৮ বছরের উপরে বিভিন্ন মানসিক রোগের প্রকোপ যথাক্রমে মারাত্মক বিষণ্নতায় ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, ২ দশমিক ৩ শতাংশ শারীরিক বিষণ্নতা, ২ শতাংশ সাধারণ উদ্বিগ্নতা, শূন্য দমশিক ৭ শতাংশ সিজোফ্রেনিয়া, শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাইপোলার, শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ ওবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅডার্র, শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ কনভারশন ডিজঅডার্র ও শূন্য দশমিক ১ শতাংশ ডিমনেশিয়ায় (স্মৃৃতিভ্রংশ) আক্রান্ত।
তবে চিকিৎসা-সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করছেন, দিন দিন রোগটির প্রকোপ বাড়লেও চিকিৎসার জন্য দেশে মাত্র দুটি বিষেশায়িত হাসপাতাল আছে। সব মিলে দেশে প্রায় দুই কোটি মানসিক রোগাক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসায় সরকারি পযাের্য় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, পাবনা মানসিক হাসপাতাল, বিএসএমএমইউ ও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালসহ কয়েকটি মেডিকেল কলেজ ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মাত্র ৮১৩টি শয্যা রয়েছে। আর স্বাস্থ্য খাতের বাজেটের দশমিক ৪৪ শতাংশ মানসিক রোগ চিকিৎসা খাতে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে।
রোগটির চিকিৎসা শিক্ষা দিতে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে মাত্র পাঁচ, রাজশাহী মেডিকেলে একজন অধ্যাপক থাকলেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও মিডফোর্ডের পূর্ণ অধ্যাপকের পদ নেই। সব মিলে দেশে সরকারি ১০ থেকে ১৫ জন অধ্যাপকসহ ২৫০ জনের মতো চিকিৎসক আছেন।
এদিকে এ বছর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ২০১৮ উপলক্ষে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতালের উদ্যোগে সকাল ৯টায় এনআইএমএইচ প্রাঙ্গণ থেকে আসাদ গেট পযর্ন্ত র্যালি শেষে ইনস্টিটিউটের কনফারেন্স হলে আলোচনা সভা ও ১১ তারিখে একটি কমর্শালা অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টের (বিএপি) উদ্যোগে জাতীয় শহীদ মিনার থেকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ পযর্ন্ত সাইকেল র্যালি করা হবে।
কী করণীয়?
ডা. সাদিয়া তারান্নুম বলছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ন্ত্রণ করলেই তরুণদের মানসিক সমস্যা অনেকাংশে সমাধান হবে। এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে-
–দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় ফেসবুক ব্যবহার করা।
– কারো তথ্যে বিভ্রান্ত না হয়ে তা যাচাই করা।
– পরিবারকে সময় দেয়া ও তাদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়া।
– সপ্তাহে একদিন হলেও আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের সাথে সরাসরি দেখা করা।
– ফেসবুকে বেশি বন্ধু না বাড়িয়ে যাদের ভালোভাবে চিনেন, তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা।
– খেয়াল রাখা যে আপনার ব্যক্তিগত কর্মকান্ড বা পারিবারিক তথ্য অপরিচিতজনেরা যেন না জানতে পারে।
– সবাই কেন এত সুখী বা সফল সেটা নিয়ে সব সময় চিন্তা না করে নিজের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকা।
– ফেসবুক-এ পাওয়া দেশ ও দেশের বাইরের নানারকম তথ্য পড়ে পরিবারের সবার সাথে সামনাসামনি শেয়ার করা।
– ফেসবুকের তথ্যের সত্যতা যাচাই না করে কাউকে সন্দেহ করা বা ঝগড়া বিবাদের জড়িয়ে পড়া উচিত নয়।
– ফেসবুকের অচেনা বন্ধুকে বিশ্বাস করে জীবনের কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত না নেয়া।
– সব সময় মনে রাখা আমার সামনের মানুষটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ ফেসবুকের অচেনা বন্ধুটির থেকে।
– খেয়াল রাখা শুধুমাত্র ফেসবুকের কাছে যেন পারিবারি বা গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক শিথিল না হয়।
– কোন রকম মানসিক চাপ বা সমস্যা অনুভব করলে সরাসরি মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে দেখা করা।