কাঠমিস্ত্রি থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার রুয়েটের রাকিবুল বিশ্বাস
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করেছেন মো. রাকিবুল বিশ্বাস। তবে রাকিবের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আসার পথটা মোটেও সহজ ছিল না। কাঠমিস্ত্রি বাবার একার আয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবারে নুন আনতে যেন পান্তা ফুরায় অবস্থা। দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবনের কঠিন বাস্তবতায় পরাজিত হয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনায় ছেদ টানতে হয়।
পড়াশোনা ছেড়ে বাবার বোঝা কিছুটা হালকা করতে তার সঙ্গে গ্রামে গ্রামে শুরু করেন কাঠমিস্ত্রির কাজ। মাঝে কিছুদিন খাদ্যের বিনিময়ে বিনা বেতনে মুদি দোকানে কাজ করেছেন তিনি। দোকানে থাকতেই মনে মনে স্বপ্ন দেখতেন একদিন নিজের একটা দোকান হবে। অবশ্য কিশোর মনে সেই স্বপ্ন ডানা মেলার আগেই ফের পড়াশোনার ইচ্ছেটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
ভাবনায় আসে-কাজের ফাঁকে পড়ালেখাটাতো চালিয়ে যাওয়া যায়। ইচ্ছের কথা বাবাকে বললে তিনি আর না করেননি। তার বাবা ছিলেন স্কুলের ফাস্ট বয়, অভাবের কারণে তিনিও পঞ্চম শ্রেণির পর আর লেখাপড়াটা চালিয়ে নিতে পারেননি।
রাকিবের বাড়ি সুন্দরবন সংলগ্ন খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপের সত্যপির গ্রামে। তার পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার সাড়ে তিন বছরের জুনিয়রদের সঙ্গে আবারও ক্লাস সেভেনে ভর্তি হন তিনি। রাকিব যখন স্কুলে পুনরায় ভর্তি হলেন, ততদিনে তার সহপাঠীরা স্কুল ছেড়ে চলে গেছেন। অনেকে নানা কথা শোনালেও অভয় দিয়ে পাশে ছিলেন শিক্ষকরা। দ্বিতীয়বার স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর রাকিবুলের আর পেছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই। সংগ্রামী জীবনে চলতে থাকে পড়াশোনা পাশাপাশি কাঠমিস্ত্রির কাজও।
তিনি জেএসসিতে মেধাবৃত্তি আর এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে তিনি তার কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে গ্রাম থেকে খুলনা শহরে আসেন। ভর্তি হন পলিটেকনিকের কোচিং। এরমধ্যে প্রকাশ হয় এসএসসি পরীক্ষার ফল।
রাকিবুল বিশ্বাস বলেন, একদিকে খুশির আনন্দ, অন্যদিকে অভাবের কারণে সায়েন্সে না পড়তে পারার দুঃখ তাড়া করছিল। ঠিক এ সময়ে একজন মানুষের সাথে পরিচয় হয়, যার কথা শুনে সায়েন্সে পড়ার সাহস পাই। উনি তখন একটা টিউশনির ব্যবস্থা করে দিলেন। টিউশনি ছিলো সপ্তাহে পাঁচ দিন। টিউশনি থেকে নাস্তা দিতো, এই নাস্তাও যে আমাকে কি পরিমাণ হেল্প করেছে বুঝানো সম্ভব না।
এসএসসি শেষ করে রাকিবুল ভর্তি হন খুলনার বঙ্গবন্ধু কলেজে। এখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন রুয়েটে। তিনি বলেন, কলেজে পড়ার সময় কত বেলা যে খেয়ে না খেয়ে কাটিয়েছি, তার হিসাব নেই। পুরো কলেজ লাইফ অনেক কষ্টে পার করেছি। সাড়ে তিন বছরের ব্রেক অফ স্ট্যাডি থেকে কামব্যাক করাটা কতটা দুরূহ কতটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার ছিল, যারা কাছের তারাই দেখেছেন।
উচ্চমাধ্যমিক শেষে রাকিবুল প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসে ভর্তি হন রুয়েটে। রাকিবুলের গ্রামে তিনিই প্রথম ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটা ধাপই ছিল রাকিবের জন্য চ্যালেঞ্জিং। তবে বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে কলেজ জীবনে।
রাকিবুল উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত কাঠমিস্ত্রির কাজ করে নিজেই নিজের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছেন। শিক্ষকতাও করেছেন তিনি। রুয়েটে ভর্তি হওয়ার খুলনায় একটি বেসরকারি কলেজের পার্টটাইম লেকচার হিসাবে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। এছাড়াও ‘আহরণ’ নামে নিজের একটা ছোট প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অবস্থায় করোনাকালীন সময়ে আহরণের যাত্রা শুরু। আহরণের নিজস্ব মৌয়ালদের মাধ্যমে সরাসরি সুন্দরবন থেকে প্রাকৃতিক চাকের মধু সংগ্রহ করে প্রাকৃতিকভাবে তা সংরক্ষণ করি। কোনোরকম প্রক্রিয়াজাত করা ছাড়াই গ্রাহকের কাছে সেই মধু পৌঁছে দেই আমরা।
রাকিবুল বলেন, শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সিনিয়র ভাই-আপু ক্রেতা থাকলেও তাদের রেফারেন্সে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে সুনাম। পণ্যের গুণগত মানের কারণে এখন প্রতিদিনই অর্ডার আসে, প্রতিদিনই কুরিয়ারের মাধ্যমে ক্রেতাদের বাসায় পৌঁছে দিচ্ছি খাঁটি মধু। ৬৪ জেলায় প্রায় চার হাজারের মতো কাস্টমার আছে রয়েছে আমাদের।
সংগ্রামী রাকিবুল অর্থ কষ্টে দিনাতিপাত করলেও তিনি এখন অনেকে অনুপ্রেরণার নাম। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করেছেন কয়েকজনের। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় জন শিক্ষার্থী কমিশন এজেন্ট হিসেবে রাকিবের আহরণে যোগ দিয়েছেন।
রাকিব বলেন, আমার জীবন ব্যর্থতা সফলতায় পরিপূর্ণ। জীবনের প্রতিটি ধাপে শুরুতে ব্যর্থ হয়েছি। প্রতিটি ব্যর্থতার মাঝে লুকিয়ে আছে সফলতা। তবে কখনো হতাশ হইনি। লেগে থাকি, হাল ছাড়ি না, বাকিটা আল্লাহ ভরসা। মহান আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী। আমি জীবনে কি পাইনি! আল্লাহ আমাকে সব দিয়েছেন। দেখতে দেখতে এখন গ্র্যাজুয়েশনও শেষ হয়েছে।