১৪ জুন ২০২৩, ২০:০৫

দেশে স্বেচ্ছায় রক্তদানে বেশি অবদান শিক্ষার্থীদের

লোগো  © টিডিসি ছবি

‘রক্ত’ মানবদেহের চালিকাশক্তি, যা ছাড়া মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। এই বেঁচে থাকার উপাদানটি অনেক সময় অসুস্থ রোগীর জন্য জরুরি হয়ে ওঠে। রোগীর অভিভাবকরা তখন পাগলের মতো রক্ত খুঁজতে থাকে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে এখন বছরে প্রায় ৬-১০ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়৷ এর ৯০ ভাগই পাওয়া যায় স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের কাছ থেকে৷ তাই পেশাদার রক্তদাতাদের দৌরাত্ম অনেকটাই কমে গেছে৷

বর্তমানে মানুষ সচেতন হয়েছে৷ চাইলেই রক্ত পাওয়া যায় বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছ থেকে৷ অনলাইনে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের গ্রুপ ও অ্যাপস রয়েছে৷ সেখানে রক্তের চাহিদার সাথে ডোনারদের সম্মীলন ঘটিয়ে দেয়া হয়৷ সরাসরি ডোনারের কাছ থেকে রক্ত নিয়ে রোগীদের দেওয়া হয়৷ বিভিন্ন সংগঠনের সাথে নিবন্ধিত এবং নিন্ধনের বাইরেও প্রচুর মানুষ এখন নিয়মিত সেচ্ছায় রক্ত দেন৷

আজ ১৪ জুন। বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। যারা স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদান করে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচায় তাদেরসহ সাধারণ জনগণকে রক্তদানে উৎসাহিত করাই এ দিবসের মূল উদ্দেশ্য। ১৯৯৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক রক্তদান দিবস পালন করা হয়।

জানা যায়, অনেক শিক্ষার্থী ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অসহায় মানুষের রক্ত ম্যানেজ করে দেন। বাংলাদেশে এই রক্তদানের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছেন বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা৷ তাঁদের রক্তদানের সংগঠনগুলোই স্বেচ্ছায় রক্তদানে বেশি ভূমিকা পালন করছে৷ বিভিন্ন সংগঠন ও হাসপাতালের প্যাথোলজিস্টদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন রক্তদানের ক্ষেত্রে এখন অনেক বড় ভূমিকা পালন করছে৷ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর কাছ থেকে রক্ত পেতে হলে হাসপাতালের স্লিপ লাগে৷ কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে রক্ত পেতে তা লাগে না৷ বিরল কোনো গ্রুপের রক্ত হলেও ফেরায় না সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম৷ এ ছাড়া যেকোন শিক্ষার্থীকে জানালেও খালি হাতে ফিরতে কাউকে।

আরও পড়ুন: 'রক্ত বেচার ঘোষণা' দিয়ে ভাইরাল ব্যবসায়ী পেলেন ৫ লাখ টাকা

সেই অভিজ্ঞতার কথা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন সবুজ। তিনি বলেন, আমি বেশ কিছুদিন আগে আমার মেয়ের জন্য রক্তের প্রয়োজন ছিল। কোথায় গেলে রক্ত পাব টেনশন হচ্ছিল। এ সময় কয়েকজন ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউকে চিনি না। এসে এক ছাত্রকে বললাম আমার মেয়ের জন্য রক্তের প্রয়োজন। তিনি কাকে ফোন রক্তের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

রক্তের জন্য কাজ করেন যাঁরা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘বাঁধন' গড়ে ওঠে ১৯৯৭ সালে৷ এখন ঢাকাসহ সারা দেশে ৫৭টি জেলায় ১২৭টি ইউনিটের মাধ্যমে তাদের স্বেচ্ছায় রক্তদানের কাজ চলছে৷ তাদের এই রক্তদান কার্যক্রম শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়েছে৷ তাদের সেন্টারগুলো করা হয়েছে হাসপাতালের কাছাকাছি৷ আর শিক্ষার্থীরা সেচ্ছাশ্রমে এইসব সেন্টারে পালা করে ২৪ ঘন্টা কাজ করেন। তাঁরা ব্লাড ব্যাংকে রক্ত সংগ্রহ করে রাখেন না৷ তাঁদের ডোনারদের অনলইন এবং অফলাইন তালিকা আছে৷ হাসাপতালের বৈধ স্লিপ নিয়ে এলে ওই তালিকা থেকে স্বেচ্ছা ডোনারদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়া হয়৷ তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যালে তাঁদের একটি ট্রান্সমিশন সেন্টার আছে৷ সেখানে সন্ধ্য ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ব্লাড নেয়া হয়৷

“অনেকে আছেন যারা কোথায় থেকে রক্ত সংগ্রহ করতে হবে এটাও জানেন না। এতে করে অনেকে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাদের সহজে রক্ত পেতে ‘বাঁধন’ কাজ করে যাচ্ছে। এমন বিপদে আমরা মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পেরে প্রশান্তি লাগে।”

বাঁধনের স্যার এ এফ রহমান হলের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, অনেকে আছেন যারা কোথায় থেকে রক্ত সংগ্রহ করতে হবে এটাও জানেন না। এতে করে অনেকে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাদের সহজে রক্ত পেতে ‘বাঁধন’ কাজ করে যাচ্ছে। এমন বিপদে আমরা মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পেরে প্রশান্তি লাগে। তখনই মনে হয় সৃয়টা অপচয় হয়নি। এ ছাড়া অ্যাপসের মাধ্যমে সেবা দিতে আমাদের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। খুব শিগগিরই অ্যাপসের মাধ্যমে সেবা দিতে পারব।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংগঠন ২০১৭ সালে গড়ে ওঠে রক্তিমা। রক্তিমা স্বেচ্ছায় রক্তদান একটি সংগঠন। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠা হয় সংগঠনটি। মূলত কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ ও আশপাশের জেলাগুলোতে রক্তের চাহিদা পূরণ করে আসছে। এসব অঞ্চলে রক্তিমা সংগঠনের মাধ্যমে দৈনিক ৪-৫ ব্যাগ রক্তের ব্যবস্হা করে দিচ্ছে পাশাপাশি বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাতে রক্তের চাহিদা মেটাতে রক্তিমার সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছে।

রক্তিমার সাধারণ সম্পাদক তুষার বলেন, রক্তিমা তার বর্তমান এবং সাবেক সদস্যদের মাধ্যমে সারাদেশে একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। রক্তিমার রক্তের ডোনাররা সকলেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশেসহ কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ জেলার সিংহভাগ রক্তের চাহিদাপূরণ হচ্ছে রক্তিমার মাধ্যমে। বিনামূল্যে রক্তদানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই এগিয়ে আসা দেশের যেকোন শ্রেণি-পেশার মানুষ থেকে বেশি বলে মনে করি।

‘রক্তবালক’ তৌফিক
পুরো নাম তৌফিক আহমেদ। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগ থেকে সদ্য পড়ালেখা শেষ করছেন। পড়ালেখার পাশাপাশি নিজে রক্ত দিয়ে ও রক্ত সংগ্রহ করে দিয়ে আর্তমানবতার সেবায় কাজ করে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত নিজে রক্ত দিয়েছে ২৩ বার। আর রক্ত সংগ্রহ করে দিয়েছে ৭ হাজারেরও বেশি বার। অথচ এই তৌফিক রক্ত সংগ্রহ সংশ্লিষ্ট কোনো সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নেই। তবে অনেক সময় বিভিন্ন সংগঠনের সহযোগিতা নিয়ে থাকেন তিনি। নিজের ফোনের টাকা খরচ করে সব সময় রক্ত সংগ্রহের কাজ করতে হয় তাকে। এজন্য শিক্ষক, সহপাঠী, বড় ভাই কিংবা ছোট ভাই সবার কাছে ‘রক্তবালক’ নামেই পরিচিত।

আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধুর বাংলায় রক্তের অভাবে কেউ মারা যেতে পারে না

তৌফিক বলেন, অনেক সময় ক্লাস চলাকালীন ফোন আসে, তখন শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে ফোন রিসিভ করতে হয়েছে। ফোনকলের অপর পাশ থেকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে রক্ত লাগবে কথাটি ভেসে আসে। তখন আর ঠিক থাকতে পারি না। যতদ্রুত সম্ভব বন্ধু, ক্যাম্পাসের ছোট ভাই, বড় ভাই, বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যদের কাছে ফোন করি। আর দোয়া করি, যাতে রক্তটা ম্যানেজ হয়ে যায়। ম্যানেজ হলেই আনন্দ আর উচ্ছ্বাস নিয়ে ফোনকলে রক্ত ম্যানেজ হয়েছে কথাটি জানিয়ে দেই। সেই সময় মনে হয়, আমি পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষ। পড়াশোনা শেষ করলেও এখনও কল আসে রক্ত লাগবে। আমিও চেষ্টা করি সহযোগিতা করার।

স্বেচ্ছায় ১২ বার রক্ত দিয়েছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুনজুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি বলেন, আমরা সমাজের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে কোন প্রাপ্তি ছাড়াই আমরা রক্ত দিয়ে থাকি। মানুষের সহজাত সভাব মানুষের বিপদে মানুষ এগিয়ে আসবে এটাই স্বাভাবিক। তবে রক্তদাতাদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক আচরণ করা উচিত।

“স্বেচ্ছায় রক্তদাতারা নীরবে তাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ রক্ত দান করে যান। রক্তদানের সময় তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জানেনও না, এ রক্ত কোন মানুষটির শরীরে বইবে। একইভাবে রোগীদের কাছেও অচেনা থেকে যান রক্তদাতারা। সংশ্লিষ্টদের আশা, দাতা-গ্রহীতার আনন্দ আর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের এমন মেলবন্ধনে উদ্বুদ্ধ হবেন নতুন রক্তদাতারা।”

সাতক্ষীরার টি জি পি ব্লাড ব্যাংকের সদস্য আশরাফুল ইসলাম বলেন, আমাদের সংগঠনের মাধ্যমে অসুস্থ মানুষের রক্ত দিয়ে থাকি। আসলে একটা মানুষের উপকার করতে পারলক আর কিছু না হোক প্রশান্তি মেলে। তবে আমাদের বেশিরভাগ ডোনাররা স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রী।

কুষ্টিয়ার একটি ক্লিনিকের প্যাথোলজিস্ট শাহীন তালুকদার বলেন, এখন সিজার, অপারেশনসহ নানা কারণে ইমার্জেন্সি রোগীর রক্ত লাগে। রোগীর পরিবারের লোকজনও বিনামূল্যে রক্ত ম্যানেজ করে ফেলে। তবে রক্তদাতাদের বেশিরভাগ দেখি ছাত্র-ছাত্রী।

প্রসঙ্গত, আজ ১৪ জুন। বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। যারা স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদান করে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচায় তাদেরসহ সাধারণ জনগণকে রক্তদানে উৎসাহিত করাই এ দিবসের মূল উদ্দেশ্য। ১৯৯৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক রক্তদান দিবস পালন করা হয়, তবে ২০০০ সালে ‘নিরাপদ রক্ত’-এই থিম নিয়ে পালিত বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০০৪ সালে প্রথম বিশ্ব রক্তদান দিবস পালিত হয়েছিল। ২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য অধিবেশনের পর থেকে প্রতিবছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ দিবস পালনের জন্য তাগিদ দিয়ে আসছে।