কাতার বিশ্বকাপে আলো ছড়াবেন যে তরুণ ফুটবলাররা
বয়সের হিসাবে তারা ঠিক ঠিক আঠারো নন বটে, মোটামুটি সতেরো থেকে উনিশের মধ্যেই তাদের আনাগোনা। তাদের চোখে মুখে এখন বিশ্বকাপ মাতানোর স্বপ্ন। তরুণ বয়সে বিশ্বকাপ মাতিয়ে অনেক খেলোয়াড়ই পরবর্তীতে ফুটবলের মহাতারকা হয়েছেন। কাতারে অনুষ্ঠিতব্য আগামী বিশ্বকাপেও আলো ছড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে অনেক তরুণেরই। তাদের কেউ কেউ আবার এরই মধ্যে ক্লাব ফুটবলে নিজ দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আসন্ন বিশ্বকাপেও তারা হয়ে উঠতে পারেন দলের ট্রাম্পকার্ড।
জুলিয়ান আলভারেজ (আর্জেন্টিনা)
রিভারপ্লেটের হয়ে গেলো বছর দারুণ ছন্দে ছিলেন জুলিয়ান আলভারেজ। নিজে মৌসুমের সর্বোচ্চ গোলদাতা আর্জেন্টাইন ক্লাবটিকে জিতিয়েছেন ঘরোয়া লিগ। পরবর্তীতে বর্ষসেরা দক্ষিণ আমেরিকান খেলোয়াড়ের স্বীকৃতিও গেছে তারই ঝুলিতে।
২২ বছর বয়সী এ আর্জেন্টাইনের উত্থান দেখে সাড়ে ৫ বছরের চুক্তিতে তাকে দলে ভেড়ায় ম্যানচেস্টার সিটি। ২০২১-এ জাতীয় দলের হয়ে অভিষেকের কিছুদিন পরেই আর্জেন্টিনার হয়ে পেয়েছেন কোপা আমেরিকা জয়ের স্বাদ। ডি-বক্সে চাতুর্য, ক্ষিপ্রতা এবং সুযোগসন্ধানী জোরালো শট নেওয়ার ক্ষমতাই এ উইঙ্গারের শক্তির দিক। সুযোগ পেলে কাতারেও আকাশী-সাদা শিবিরের জন্য ভালো কিছু করতে সক্ষম আলভারেজ।
এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গা (ফ্রান্স)
২০২১ সালের গ্রীষ্মকালীন দলবদলের একদম শেষ দিনে ৪০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গাকে দলে টানে রিয়াল মাদ্রিদ। মাত্র ১৮ বছর বয়সী এক তরুণের জন্য এত অর্থ ব্যয় করাকে একরকম পাগলামি বলেই অ্যাখ্যা দিয়েছিল অনেকে। বয়সের তুলনায় দারুণ পরিণত এই মিডফিল্ডার প্রয়োজনীয় সময়ে জ্বলে উঠে রিয়াল মাদ্রিদকে চতুর্দশ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতাতে ভুমিকা রেখেছেন।
কামাভিঙ্গাকে জাতীয় দল এবং ক্লাব ফুটবলের মাঝমাঠের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। রিয়াল মাদ্রিদে প্রথম মৌসুমের মতো কাতারে নিজের অভিষেক বিশ্বকাপেও প্রয়োজনীয় সময়ে জ্বলে উঠতে পারলে হয়ত শিরোপা ধরে রাখতে সক্ষম হবে ফ্রান্স।
রদ্রিগো গোয়েস (ব্রাজিল)
তিন বছর আগে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দিয়েছিলেন রদ্রিগো গোয়েস। স্প্যানিশ ক্লাবটিতে এখনও নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করতে পারেননি। মূল পজিশন লেফট উইং হলেও সেখানে স্বদেশি ভিনিসিয়াস থাকায় রদ্রিগোকে খেলতে হয় রাইট উইংয়েই। তবে সুযোগ পাওয়ামাত্রই সামর্থ্যের পুরোটা নিংড়ে নিয়েছেন এ ব্রাজিলিয়ান।
রদ্রিগোর বিশেষত্বের মধ্যে মাঠে নিজের গতি, ড্রিবলিং এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতার কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সব মিলিয়ে তার উপস্থিতি দলের আক্রমণভাগে বৈচিত্র্য আনতে সক্ষম। কোচ তিতে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে ব্রাজিলের হেক্সা জয়ের মিশনে ২১ বছর বয়সী এ উইঙ্গার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।
গাভি (স্পেন)
বার্সেলোনার অ্যাকাডেমি লা মাসিয়ার এই গ্যাজুয়েটকে দুই স্প্যানিশ কিংবদন্তি জাভি-ইনিয়েস্তার সংমিশ্রণ বলে অভিহিত করে থাকেন অনেকে। বয়স মাত্র ১৭ হলেও এরই মধ্যে বার্সেলোনার মতো ক্লাবের মাঝমাঠের বড় ভরসা হয়ে উঠেছেন তিনি।
এল ক্ল্যাসিকোয় সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে নামার কীর্তিধারী গাভিকে তার ভিশন, বল কন্ট্রোল, ফুটবলীয় আইকিউর মতো দক্ষতার কারণে কাতালান ক্লাবটির নতুন যুগের বড় তারকা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
১৮ বছর বয়সী এ মিডফিল্ডার ব্যতিক্রমী পাসিং-ড্রিবলিং দিয়ে যেমন আক্রমণ শানাতে পারেন, তেমনি নিখুঁত ট্যাকলিংয়ে প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে রক্ষণভাগেও ভূমিকা রাখতে সক্ষম। মাঝমাঠের এ পরিপূর্ণ প্যাকেজকে গত বছর জাতীয় দলে ডাকতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি কোচ লুইস এনরিকে।
জুডে বেলিংহাম (ইংল্যান্ড)
বয়স মাত্র ১৯ হলেও ইতোমধ্যেই ইংল্যান্ড কোচ গ্যারেথ সাউথগেটের ভরসার পাত্র হয়ে উঠেছে জুডে বেলিংহাম। এ বয়সেই জাতীয় দলের জার্সি গায়ে ১৯টি ম্যাচ খেলে ফেলা সেই নির্ভরতারই প্রমাণ দেয়।
শারীরিকভাবে শক্ত-সমর্থ এবং নিখুঁত স্কিল সম্পন্ন বেলিংহাম ক্লাব ফুটবলে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের হয়ে খেলে থাকেন। স্বীয় নৈপুণ্যে ইতোমধ্যে ইউরোপের অনেক বড় বড় ক্লাবের নজরেই পড়েছেন এই মিডফিল্ডার।
মার্সেলো ফ্লোরেস (মেক্সিকো)
ক্লাবের মূল দলে খেলার আগেই জাতীয় দলে ডাক পেয়েছিলেন তরুণ মিডফিল্ডার মার্সেলো ফ্লোরেস। মেক্সিকোর কোচ জেরার্ডো ‘টাটা’ মার্টিনো অবশ্য তাতে একেবারেই অবাক নন, এর আগে আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি হাভিয়ের মাশ্চেরানোকেও তো একইভাবে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়াতে দেখেছেন তিনি!
লিওনেল মেসিকে আদর্শ মানা এই ফুটবলারের রক্তেই বইছে ফুটবল। মা রুবেন ফ্লোরেস ছিলেন মেক্সিকোর সাবেক ফুটবলার, বাবা ছিলেন ক্যায়ম্যান দ্বীপপুঞ্জের নারী ফুটবল দলের ম্যানেজার। ফ্লোরেসের দুই বোন সিলভানা আর তাতিয়ানাও খেলেন যথাক্রমে লন্ডনের দুই স্বনামধন্য ফুটবল ক্লাব টটেনহ্যাম আর চেলসির হয়ে।
ইউনুস মুসাহ (ইংল্যান্ড)
ইংল্যান্ড কোচ গ্যারেথ সাউথগেট ১৯ বছর বয়সী ইউনুসকে ইংল্যান্ডে দলে টানার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রকে। দেশটির হয়ে ১৯ ম্যাচ খেলেছেন। কাতার বিশ্বকাপে যুক্তরাষ্ট্র ম্যাসন মাউন্ট, ক্রিস্টিয়ান পুলিসিক, সের্গিয়ানো ডেস্টদের নিয়ে চমক দিতে চান। চমক হতে পারেন উইনুসও।
ফেলিক্স আফেনা-জিয়ান (ঘানা)
মাত্র আঠারো মাস আগের কথা। ফেলিক্স আফেনা-জিয়ান তখন বেরেকাম প্রেসবিটারিয়ান সিনিয়র হাই স্কুলে পড়ছিলেন। স্কুলের লেখাপড়া করতে করতে তার দূরতম কল্পনায়ও হয়তো আসেনি, কিছুদিন পরই তার নাম লেখা থাকবে সিরি-আ’তে রোমার শুরুর একাদশে, ভাবতেও পারেননি ঘানার বিশ্বকাপ দলে জায়গা পাওয়ার দাবিদার হবেন তিনি! অথচ আঠারো মাস পরে সেটাই কি না বাস্তব হলো!
শারীরিক শক্তি আর দারুণ ভারসাম্যের ফলে বল পুনর্দখলের লড়াইয়ে জিততে পারেন আফেনা-জিয়ান, এগিয়ে থাকেন প্রতিপক্ষের সাথে শারীরিক টক্করেও। দারুণ গতি, স্কিল, ট্যাপ-ইন এবং লং রেঞ্জ গোল করার সামর্থ্যও তাকে সমসাময়িক অনেকের চেয়ে এগিয়ে রাখে।
জামাল মুসিয়ালা (জার্মানি)
বয়সভিত্তিক পর্যায়ে খেলেছেন ইংল্যান্ডের হয়ে। অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-২১ পর্যায়ে গায়ে জড়িয়েছেন ‘তিন সিংহ’ সম্বলিত জার্সি, তবে জাতীয় দল হিসেবে বেছে নিয়েছেন জন্মভূমি জার্মানিকেই। বায়ার্ন মিউনিখের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় জামাল মুসিয়ালার ওপর বিশ্বকাপেও বাড়তি নজর রাখতেই হচ্ছে।
দারুণ ড্রিবলিংয়ের সাথে নিখুঁত ফিনিশিং-দক্ষতা, দুইয়ে মিলে জামাল মুসিয়ালার সামনে অপেক্ষা করছে চমৎকার ভবিষ্যৎ। জামালকে বাড়তি সুবিধা দিবে তার মাঠের বিভিন্ন পজিশনে খেলার সামর্থ্য। মূল স্ট্রাইকারের পেছনে, উইংয়ে, বা বক্স-টু-বক্স মিডফিল্ডার হিসেবে খেলতে পারেন জামাল।
ইউনুস মুসা (ইউএসএ)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে জন্ম, বাবা-মা ঘানার নাগরিক, বেড়ে উঠেছেন ইতালি ও ইংল্যান্ডে, বয়সভিত্তিক পর্যায়ে ইংরেজদের হয়ে ত্রিশোর্ধ্ব ম্যাচও খেলেছেন, তবে জাতীয় দলের প্রশ্নে ইউনুস মুসা বেছে নিয়েছেন জন্মভূমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই। ইংল্যান্ড জাতীয় দলের কোচ গ্যারেথ সাউথগেট অবশ্য মুসাকে ইংল্যান্ডের জার্সিতেই নিজের ভবিষ্যৎ খুঁজে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সোনালি প্রজন্মটাই মুসাকে বেশি আকর্ষণ করেছে।
এনগোলো কান্তে, পল পগবা, ক্রিস্টিয়ান পুলিসিচদের আদর্শ মানা এই তরুণের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সেই মেক্সিকোর বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র করে কাতার বিশ্বকাপের টিকেট নিশ্চিত করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বকাপের স্বপ্নযাত্রায়ও এই তরুণের স্বাপ্নিক পারফরম্যান্সই চাইবে মার্কিনরা!