পাকিস্তানকে হারিয়ে শত বছরের ঘুম থেকে জেগে উঠেছে আমেরিকার ক্রিকেট
ক্রিকেটে আমেরিকার জেগে ওঠার জন্য বিশেষ কিছুর দরকার ছিল। দরকার ছিল নাটকীয়তা, বিনোদন, উঁচুমানের দক্ষতা এবং কিছুটা শোরগোলের মধ্যে পড়ে যাওয়া। সুতরাং টেক্সাসে সুপার ওভারের নাটকীয়তায় যখন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সহ-আয়োজক দেশটি সাবেক চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তানকে বিস্মিত করে হারিয়ে দিলো, তখন ক্রিকেট আসলে এগুলোই পেলো।
যুক্তরাষ্ট্র তার আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছে ২০১৯ সালে। এখন প্রথমবারের মতো খেলছে বিশ্বকাপ এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও ছিল এটা তাদের প্রথম ম্যাচ।
বিশ্ব ক্রিকেটে র্যাংকিংয়ে তাদের অবস্থান ১৮তম, নেপাল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতেরও পেছনে। অন্যদিকে পাকিস্তান এই প্রতিযোগিতার ফাইনালে শেষবার গিয়েছিলো ২০২২ সালে আর শিরোপা জিতেছিলো ২০০৯ সালে। এটা হওয়ার কথা ছিল না কিন্তু এটা সুযোগের জায়গা। এবং এটি ছিল টেক্সাস, যেখানে সব কিছুই বড়।
“পাকিস্তানকে হারানো একটি বড় অর্জন,” বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের অধিনায়ক মোনাঙ্ক প্যাটেল। “এটা যুক্তরাষ্ট্র দলের জন্য বড় একটি দিন। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই নয়, বরং দেশটির ক্রিকেট কমিউনিটির জন্যও”।
নিউইয়র্কে টুর্নামেন্টের অন্য ম্যাচ গুলো হচ্ছে। সেখানে আলোচনায় এসেছে স্লো পিচ, লো-স্কোরিং ম্যাচ আর নানা অযৌক্তিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু টেক্সাস দেখিয়েছে আলোর ঝলক; যুক্তরাষ্ট্রে এখন ক্রিকেট কাজ করছে এবং এটা দারুণ হতে পারে সেই নীলনকশার প্রদর্শনই হয়ে গেছে। আর এটা হয়েছে এনএফএল-এর সবচেয়ে মূল্যবান দল দ্যা ডালাস কাউবয় এর আঙ্গিনায়।
অ্যারন জোনস দশটি ছক্কা দিয়ে কানাডার বিপক্ষে টুর্নামেন্ট শুরু করেছিলেন নিজের স্টাইলে। আর এটি হয়েছিলো দলগত ঐক্য, চেতনা ও নার্ভ যা পাকিস্তানের বিপক্ষে সহায়তা করেছে তার আগেই।
“আমার মেরুদণ্ড কাঁপছিল,” বিবিসি টেস্ট ম্যাচ স্পেশালে বলছিলেন নেদারল্যান্ডসের সাবেক অল-রাউন্ডার রায়ান টেন ডেসকাট।
“আমি নিজে সহযোগী থেকে ওঠে আসা, আমি জানি এটা কতটা কঠিন। একটা চিরস্মরণীয় দিন ও যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেটের হাত থেকে আসা শট। আপনি যদি আমেরিকানদের দেখাতে চান যে এই মহান খেলা সম্পর্কে, তাহলে এটা সেটাই”।
“পাকিস্তানকে বিশ্বকাপে হারানো আমাদের জন্য অনেক দরজা খুলে দেবে,” বলছিলেন মোনাঙ্ক।
“যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বকাপের আয়োজন এবং দল হিসেবে পারফর্ম করা- এটি যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে”।
পাকিস্তান বার সদস্যের আইসিসির পূর্ণ সদস্য যেখানে যুক্তরাষ্ট্র এখনো সহযোগী সদস্য। এর মানে হলো অন্য ৯৩টি দেশের মতো খেলাটি স্বীকৃতি পেয়েছে স্পোর্টস গভর্নিং বডির কিন্তু তারা টেস্ট ম্যাচ খেলতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্র দলের জন্য ম্যাচের রেজাল্ট নিয়ে আবেগ এবং এর প্রভাব সুপার ওভারের পরের উদযাপনেই ছিল স্পষ্ট। পুরো ৪০ ওভার তারা চোখে চোখ রেখে খেলে গেছে।
“যেভাবে খেলেছি তাতে আমি গর্বিত,” বলছিলেন মোনাঙ্ক, যিনি পাকিস্তানের রান তাড়া করার পথে গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্ধশতক করেছেন।
“এটা ছিল পুরোপুরি দলগত চেষ্টা। টস জেতা, আমরা জানতাম যে আমাদের কন্ডিশনের সুবিধা নেয়া নিশ্চিত করতে হবে এবং বোলাররা সেটি করেছে”।
পাকিস্তানের জন্য টুর্নামেন্টে এখনো শেষ হয়ে যায়নি বরং মাত্র একটি ম্যাচ গেলো। কিন্তু শুরুতেই এমন লজ্জাজনক হার বাবর আজমের দলে নিরানন্দই নিয়ে এসেছে। তারা ২০২২ এর বিশ্বকাপে ফাইনাল খেলেছে। “আপনি ম্যাচ হারলে অবশ্যই হতাশ হবেন,” বলছিলেন বাবর। “আমরা ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং কোনোটাই ভালো খেলিনি”। যুক্তরাষ্ট্র এখন এ গ্রুপের শীর্ষে এবং তারা এখন সুপার এইটে পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখবে।
১০০ বছর পর জেগে ওঠা
যুক্তরাষ্ট্রে বিবিসি স্পোর্টসের টিমোথি আব্রাহাম লিখেছেন যে এই ম্যাচের ফল যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিকেট ইতিহাসের জন্য একটি মাইলফলক। ১৯০৪ ও ১৯০৮ সালে যুক্তরাজ্য সফরে কাউন্টি টিমের বিপক্ষে জয় পেয়েছিলো দ্যা জেন্টলম্যান অফ ফিলাডেলফিয়া। তারা ল্যাঙ্কাশায়ার, কেন্ট ও সারের মতো প্রথম শ্রেণীর মর্যাদাপ্রাপ্ত দলকে হারিয়েছিল।
১৯৩২ সারে আর্থার মালে ব্যক্তিগত ট্যুরের আয়োজন করেছিলেন নর্থ আমেরিকায়, যাতে ডন ব্রাডম্যানও ছিলেন। সেসময় অস্ট্রেলিয়া একাদশ যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে কয়েকটি ড্র করেছিল। ওই সফরে ব্রাডম্যান নিউইয়র্কে শূন্যতেই আউট হয়েছিলেন।
টনি গ্রেইগের নেতৃত্বে বিশ্ব একাদশ হেরে গিয়েছিলো আমেরিকানদের বিরুদ্ধে। অথচ বিশ্ব একাদশে ছিলেন গ্যারি সোবার্স, অ্যালান নট, গ্রেগ চ্যাপেলের মতো খেলোয়াড়রা। অন্যদিকে আমেরিকান টিমে বেশিরভাগই ছিল ক্যারিবিয়ান বংশোদ্ভূত। আট হাজার ভক্তের সামনে শেয়া স্টেডিয়ামে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলেছেন তারা।
ফিলাডেলফিয়ার কাছে হ্যাভারফোর্ড কলেজের ইউনাইটেড স্টেটস ক্রিকেট মিউজিয়ামের কিউরেটর জো লিন বলছেন এ দেশের ক্রিকেটের জন্য এই ম্যাচের ফল ‘বিশাল’ কিছু।
“যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এর চেয়ে ভালো শুরু আর কিছু হতে পারতো না এই টুর্নামেন্টে। কানাডার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ জয় একটি বিষয়ক কিন্তু পাকিস্তানের মতো একটা পূর্ণাঙ্গ সদস্য দেশকে হারানো ভিন্ন বিষয়,” বলছিলেন লিন।
“সম্ভবত বেসবলের হাতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিকেটের মৃত্যু হয়েছে এটা বলা হবে ভুল। আমি মনে করি এটা ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। এখন মেজর লীগ ক্রিকেট ও এবারের বিশ্বকাপ হলো আবার জেগে ওঠার মতো”। [বিবিসি]