২৩ আগস্ট ২০২৩, ১২:১৫

সাফল্য-খ্যাতির ভিড়েও সাধারণ জীবনযাপন সাদিও মানের

বিলাসিতা বিসর্জন দিয়ে নিজের গ্রামকে শহরে পরিণত করছেন সাদিও মানে  © সংগৃহীত

সাদিও মানে একজন সেনেগালি পেশাদার ফুটবলার যিনি এখন খেলছেন সৌদি লিগের আল নাসরের হয়ে। সেনেগাল ফুটবলের পোস্টার বয় সাদিও মানে। ফুটবলের মাধ্যমে দারিদ্রতা দূর করেছেন মানে। সাফল্য-খ্যাতিতে ভরা তার জীবন। তবে মানে কখনোও নিজের অতীত ভুলে যাননি। বরং মানুষের পাশে থাকাটাকেই নিয়েছেন জীবনের ব্রত হিসেবে। বিলাসিতা বিসর্জন দিয়ে নিজের গ্রামকে শহরে পরিণত করছেন সাদিও মানে। তিনি শুধু নিজের জন্য নয়, কাজে লাগান নিজ দেশ ও গ্রামের মানুষদের কল্যাণেও।

ফুটবল ক্যারিয়ারে যশ, খ্যাতি ও ধন-দৌলত সবই ধরা দিয়েছে মানের হাতে। পেয়েছেন অগণিত সাফল্য। কিন্তু মাঠের বাইরে তিনি একেবারেই সাধারণ জীবনযাপন করেন। আসলে মানের হৃদয়ে সঙ্গে মিশে আছে সেনেগালের মানুষ। বিশেষ করে যে অঞ্চল থেকে উঠে এসেছেন তিনি, সেখানকার লোকজন। মানের জন্মশহর বাম্বালি ‍উত্তর আফ্রিকার পশ্চিমপ্রান্তের খুবই ছোট্ট একটি শহর। 

দারিদ্রপীড়িত এই শহরে মাত্র ২ হাজার মানুষের বাস। কাসামান্স নদীর তীরবর্তী মানের গ্রামটি রাজধানী থেকে ৭ ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত। মূলত এখানকার মানুষের পেশা মাছ ধরা। পাকা কোনো রাস্তা নেই, মানুষের মাঝেই গরু-ছাগল ঘুরে বেড়ায় সেখানে। শহরে একটা হাসপাতাল না থাকায় নারীরা নিজ ঘরেই সন্তান প্রসব করতেন। নিজের আয়ের বড় একটা অংশ তাদের পেছনেই খরচ করেন তিনি।

চ্যাম্পিয়নস লিগ ও আফ্রিকান ন্যাশন্স কাপজয়ী এই ফুটবলার নিজের গ্রামে হাসপাতাল, স্কুল, পোস্ট অফিস ও পেট্রোল স্টেশন নির্মাণ করে দিয়েছেন। সাদিও মানে একটি হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ২০২১ সালে ৪ লাখ ৫৫ হাজার পাউন্ড বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫ কোটি ৯ লাখ টাকা দিয়েছেন। হাসপাতালটিতে আশেপাশের প্রায় ৩৪ গ্রামের মানুষ চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে পারছেন। নিজ গ্রাম বাম্বালিতে আড়াই লাখ পাউন্ড বা প্রায় ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা খরচ করে মাধ্যমিক স্কুল নির্মাণ করে দিয়েছেন মানে। 

২ হাজার গ্রামবাসীর সুবিধার জন্য পোস্ট অফিস নির্মাণ করার কাজও শুরু করেছেন তিনি। এজন্য সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন সাবেক সাউদাম্পটন তারকা। এছাড়া গ্রামে একটি পেট্রোল পাম্পের উদ্বোধন করতেও দেখা গেছে তাকে। এছাড়া গ্রামে ফোর-জি ইন্টারনেট সুবিধার ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন তিনি।

এখানেই শেষ নয়, নিজ গ্রামের প্রতি পরিবারকে মাসিক ৭০ মার্কিন ডলার (প্রায় ৬ হাজার ৩০০ টাকা) সমমূল্যের সহায়তা প্যাকেজের ব্যবস্থাও করেছেন মানে। ওই গ্রামের হাই স্কুলের সেরা শিক্ষার্থীদের ৪০০ মার্কিন ডলার (৩৬ হাজার টাকার বেশি) করে উপহারও দিয়েছেন তিনি। এর বাইরে আফ্রিকার সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের মধ্যে ফুটবলের প্রতি আগ্রহ তৈরিতেও তার ভূমিকা আছে। লিভারপুলে নিজের জার্সি তিনি কয়েক শ এতিম শিশুকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন আফ্রিকার দেশ মালাউইয়ে। 

২০১৮ সালে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালের আগে নিজ গ্রাম তথা দক্ষিণ সেনেগালের বাম্বালি গ্রামে লিভারপুলের ৩০০ জার্সি উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন মানে। তার নামে সেনেগালে একটি ফুটবল স্টেডিয়ামও আছে।

মানে একজন আপাদমস্তক 'ডাউন টু আর্থ' প্রকৃতির মানুষ। এর আগে লিভারপুলে এক স্থানীয় মসজিদের অযুখানা পরিস্কার করতে দেখা গেছে তাকে। প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১ লাখ পাউন্ডের মতো বেতন (বছরে ১২ মিলিয়ন পাউন্ডের বেশি) পাওয়া সত্ত্বেও দামি ফোন, দামি গাড়ি এসব কিছুর প্রতিই তার মোহ নেই। 

২০১৯ সালে ঘানাইয়ান একটি আউটলেটেও মানের সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই বলেছিলেন, দশটি ফেরারি গাড়ি, ২০টি দামি ঘড়ি আর বিলাসবহুল বাড়ি, এসব দিয়ে কী হবে! বিলাসবহুল বাড়ির পরিবর্তে অসংখ্য স্কুল তৈরি করেছি আমি। দামি পোষাকে ওয়ারড্রব না সাজিয়ে অসংখ্য বস্ত্রহীন মানুষকে বস্ত্র দিয়েছি। নিজে দামি গাড়ি চালানোর পরিবর্তে অগণিত শিক্ষার্থীর জন্য স্কুল বাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। নিজে দামি রেস্টুরেন্টে না খেয়ে হাজার হাজার ক্ষুধার্ত শিশুর খাবারের ব্যবস্থা করেছি। এতেই আমার শান্তি।

‘আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম এবং একসময় মাঠে কাজ করতাম। কঠিন সময়ে আমাকে টিকে থাকতে হয়েছে, আমি ফুটবল খেলেছি খালি পায়ে। আমার লেখাপড়ার সুযোগ এবং আরও অনেক কিছু ছিল না। কিন্তু আজ ফুটবলের মাধ্যমে যা উপার্জন করি তা দিয়ে মানুষের সাহায্য করতে পারি।’- বলেন মানে।

জার্মান জায়ান্ট বায়ার্ন মিউনিখ ছেড়ে সদ্যই সৌদি প্রো লিগের আরেক ক্লাব আল নাসরে যোগ দিয়েছেন মানে। সাদিও মানে ইউরোপ ছেড়ে এত তাড়াতাড়ি সৌদি আরবে পাড়ি জমাবেন, হয়তো কেউ ভাবেননি। সময়ের সেরা ফুটবলারদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় মানের নাম ওঠে আসবেই। ফুটবল খেলে অর্থ উপার্জন করছেন দুহাত ভরে। তবে এই তারকা কখনও বিলাসবহুল গাড়ি-বাড়ির দিকে ছোটেননি। সবসময় চেয়েছেন, তার আশপাশের মানুষ যেন মুখে হাসি নিয়ে থাকতে পারে।