লিওনেল মেসি

এত অর্জনেও তার এক অপ্রাপ্তি যেন সোনালী ছোঁয়া

লিওনেল মেসি
লিওনেল মেসি  © সংগৃহীত

মেসি যেন এক আশ্চর্য প্রতিভার নাম। এই শতাব্দীতে ফুটবলের কথা বললে লিওনেল মেসির নামটি আসবে বারবার ফিরে। মেসিকে এই সময়ের সেরা এবং সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার হিসেবে গণ্য করে থাকেন। আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ না জেতা তার সবচেয়ে বড় অপ্রাপ্তি। ২০১৪ বিশ্বকাপে তো খুব কাছে গিয়েও হাতছাড়া হলো শিরোপা। তবে মেসির গল্পটা এখনো শেষ হয়নি।

আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরে ১৯৮৭ সালের ২৪ জুন জন্মগ্রহণ করেছিলেন লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। বাবা হোর্হে হোরাসিও মেসি কাজ করতেন রোজারিওর একটি স্টিল কারখানায়। আর মা সেলিনা মারিয়া কুচ্চিত্তিনি ছিলেন পার্ট-টাইম ক্লিনার। চার ভাইবোনের মধ্যে মেসি তৃতীয়। তার বড় দুই ভাই রদ্রিগো ও মাতিয়াস। ছোট বোন মারিয়া সল। ছোটবেলা থেকেই তাদের পরিবার ছিল ফুটবলপ্রেমী। বড় দুই ভাই ও দুই মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে ফুটবল খেলেই বাল্যকাল কেটেছে তার।

মেসির পরিবারে খুব বেশি আর্থিক সচ্ছলতা না থাকলেও তার পিতা চাইতেন তার সন্তানদের জীবন উজ্জ্বল হউক তার জন্য তিনি সবরকম কষ্টের সামনে করেন ও মেসি ও তার ভাইদের ফুটবলের প্রতি উৎসাহিত করতেন। ছোটবেলা থেকেই মেসি তার ভাইদের সাথে ফুটবল খেলতে মাঠে যেতেন।

মেসির দাদি চাইতেন মেসি বড় ফুটবলার হয়ে উঠুক। তার উৎসাহেই মেসির বাবা তাকে ফুটবল খেলার সরঞ্জাম কিনে দেয়। আর মাত্র চার বছর বয়সে মেসিকে ফুটবল ট্রেনিং ক্লাবে ভর্তি করে দেন।

১৯৯৩ সালে মাত্র ছয় বছর বয়সে ক্লাব নিওয়েল’স ওল্ড বয়েজে যোগ দেন মেসি। একই সময় স্থানীয় যুবশক্তি ক্লাব ‘দ্য মেশিন অব ’৮৭’-এর সদস্য হিসেবেও খেলেন তিনি। যার ফলে ওই ক্লাবটি পরবর্তী চার বছরে একটি মাত্র খেলায় পরাজিত হয়। কিন্তু মাত্র ১০ বছর বয়সেই গ্রোথ হরমোনের সমস্যা ধরা পড়ে মেসির। যার ফলে আর বেড়ে উঠবে না মেসি

তবে এই রোগ চিকিৎসায় সারিয়ে তোলা যাবে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থের। মাসে অন্তত এক হাজার ডলার। চিন্তিত হয়ে পড়েন মেসির বাবা-মা। অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তার ভবিষ্যৎ। অসহায় বাবা ধর্না দিতে থাকেন স্থানীয় বিভিন্ন ক্লাবগুলোতে। নিউওয়েলস ক্লাব প্রথমে রাজি হলেও আসলে অত অর্থ ব্যয় করার সামর্থ্য নেই তাদের। বাবা যান বুয়েনেস এইরেসে ক্লাব রিভার প্লেটে। কিন্তু সেখানেও একই সমস্যা। একজন খেলোয়াড়ের জন্য স্থানীয় ক্লবগুলোর আসলে এ বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয়ের সামর্থ্য নেই! দিশাহারা হয়ে যান বাবা-মা।

ওই সময়ে সামনে আসেন বার্সেলোনার তৎকালীন ক্রীড়া পরিচালক কার্লোস চার্লি রেক্সাস। এই ভদ্রলোকের তখনকার কাজ ছিল দেশ-বিদেশ ঘুরে ঘুরে বার্সার বিখ্যাত ‘লা মেসিয়া’ একাডেমির জন্য প্রতিভাবান ফুটবলার খুঁজে বের করা। সেবার ছোট-বড় বহু ক্লাব ঘুরেও আর্জেন্টিনার কিশোর ফুটবলারদের দেখে তেমন মন ভরছিল না তার। খুঁজছিলেন এমন কাউকে, যাকে নিয়ে ভবিষ্যৎ স্বপ্ন দেখতে পারবেন তিনি।

আরও পড়ুন: টিকে থাকতে রাতে নামছে মেসিরা, সামনে যত সমীকরণ

মাঠের সব থেকে ছোটখাটো, সব থেকে দুর্বল ছেলেটা তার থেকে আধহাত লম্বা লম্বা খেলোয়াড়দের বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে একের পর এক গোল দিয়েই যাচ্ছে। বলটা মনে হচ্ছে চুম্বক দিয়ে ওর পায়ে লাগানো আছে। মুগ্ধ রেক্সাস তখনই খোঁজ করলেন তার বাবা-মার। মেসিকে তার চাই-ই চাই। 

বার্সেলোনার জার্সিতে লিওনেল মেসির অভিষেক হয় ১৬ অক্টেবর ২০০৪ সালে। মেসির বয়স তখন ১৭ বছর ৩ মাস ২২ দিন। অভিষেকের সাত মাস পর ২০০৫ সালের ১ মে ক্লাবের জার্সিতে প্রথম গোল পান এই ক্ষুদে জাদুকর। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। লা মাসিয়া থেকে উঠে আসা এই আর্জেন্টাইন ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় জুড়ে কাতালুনিয়ার দলটিকে দিয়েছেন মুঠোভরে, দিয়ে যাচ্ছেন এখনও। বিশ্বসেরা এই তারকার ফুটবলের আঙিনায় যত প্রাপ্তি

লা লিগার ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা (৩৪৯টি) মেসি। গোল বেশি। বার্সেলোনার সর্বোচ্চ গোলদাতাও তিনি, সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এরই মধ্যে ৫০৭ গোল করেছেন। ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের এক  ম্যাচে পাঁচ গোলের ‍কীর্তি গড়েন মেসি (২০১২ সালে, বায়ার লেভারকুজেনের বিপক্ষে)।

এল ক্লাসিকোর ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলও মেসির-সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ২৩টি। বার্সেলোনার হয়ে খেলেছেন ৫৮৩ ম্যাচ। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে বার্সেলোনার হয়ে মেসির গোল ৯৪টি। এক ক্লাবের হয়ে কোনো খেলোয়াড় এত গোল করতে পারেনি।

আরও পড়ুুন: বাংলাদেশে ফুটবল উন্মাদনা তৈরির অন্যতম কারিগর ম্যারাডোনার বিদায়ের দু’বছর

লিওনেল মেসি রেকর্ড সাতবার ব্যালন ডি অর জয় করেছেন, যার মধ্যে চারটি জিতেছেন টানা চার বছরে। পাশাপাশি রেকর্ড পাঁচবার ইউরোপীয় গোল্ডেন শু-ও জিতেছেন।

আর্জেন্টিনার ইতিহাসের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। দীর্ঘ ২৮ বছরের খরা কাটিয়ে দেশকে কোপা আমেরিকার ট্রফি এনে দিলেও আক্ষেপ রয়ে গেছে ৩৬ বছর আগে শেষবার স্বাদ নেয়া বিশ্বকাপ ট্রফির। ২০১৪ সালে স্বপ্নের অতি কাছে গেলেও শেষ পর্যন্ত ছোঁয়া হয়নি ৬.১৭৫ কেজি ওজনের সোনার ট্রফিটি। এরপর রাশিয়া বিশ্বকাপে নিজেদের ঠিকমতো মেলে ধরতে না পারলেও কাতার বিশ্বকাপে আলবিসেলেস্তেরা স্বপ্ন দেখছেন মেসির হাত ধরে তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়ের। ফুটবলের সাবেক তারকাদেরও অনেকে মনে করেন, এবারের বিশ্বকাপের বড় দাবিদার লিওনেল মেসি ও তার দল আর্জেন্টিনা। 

ফুটবল ক্যারিয়ারে মেসির প্রাপ্তি ও সাফল্যের শেষ নেই। অপ্রাপ্তি বলতে শুধু নিজ দেশ আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ শিরোপা জিততে না পারা। একইসঙ্গে দীর্ঘ ৩৬ বছর ধরে শিরোপা বঞ্চিত দেশটি।


সর্বশেষ সংবাদ