৫৪৪ দিন পর শিক্ষাঙ্গনে ফিরছে প্রাণচাঞ্চল্য
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে দেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম এতো লম্বা সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। অবশেষে ৫৪৪ দিন পর খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দ্বার। আবারও শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠবে দেশের প্রতিটি বিদ্যাপীঠের আঙ্গিনা।
আগামী ১২ সেপ্টেম্বর থেকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পরদিন ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে খুলে দেওয়া হবে সব মেডিকেল কলেজ। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আগামী অক্টোবরে খুলে দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। কয়েক ধাপে এই ছুটির মেয়াদ বাড়ানোর পর চলতি বছরের ২৩ মে থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে বলে গত ২৫ মার্চ জানান শিক্ষামন্ত্রী।
তবে, দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালে সেই ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে ২৯ মে পর্যন্ত করা হয়। সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে না আসায় পুনরায় ছুটি ৩১ জুলাই পর্যন্ত বাড়ানো হয়। পরবর্তীতে সেটি আবারও বাড়িয়ে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত করা হলো।
সর্বশেষ ২৬ আগস্ট এক ঘোষণায় প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ২৩ দফায় এই ছুটি বেড়েছে। দেশে করোনা সংক্রমণ করে আসায় সেই ছুটি আর বাড়ানো হবে না বলে জানিয়ে আজ শুক্রবার (৩ সেপ্টেম্বর) শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, ১২ সেপ্টেম্বর থেকে খুলবে সারাদেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এছাড়া নভেম্বরে এসএসসি ও ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে এইচএসসি পরীক্ষা।
এর আগে বৃহস্পতিবার (২ সেপ্টেম্বর) যত দ্রুত সম্ভব স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একাদশ জাতীয় সংসদের চতুর্দশ অধিবেশনের দ্বিতীয় সেশনে বৃহস্পতিবার সংসদ সদস্য হাসিবুর রহমান স্বপনের মৃত্যুতে আনা শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। মূলত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার তোড়জোর শুরু হয়।
এদিকে, দীর্ঘদিন পর বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সংবাদে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে উচ্ছ্বাস কাজ করছে। দেড় বছরের পুরনো স্কুলপোশাক পরে ট্রায়াল দেওয়া শুরু করেছে অনেক শিক্ষার্থী।
গৃহবধূ রোজিফা আকতার বলেন, আমার দুই মেয়ের একজন সেন্টফিলিপস হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজে দশম শ্রেণিতে, অন্যজন প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। তারা প্রায় দেড় বছর স্কুলে যায়নি। টিভিতে দেখলাম ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল খুলবে। তাই মেয়েদের স্কুলের পোশাকগুলো ঠিক আছে কি-না দেখছিলাম। তবে ছোট মেয়ের পোশাক ঠিকমতো হচ্ছে না। এজন্য তার মন খারাপ
এর আগে গত ২৬ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সভায় পরিকল্পনা করা হয়েছিল, টিকা দেওয়া সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেরা আগামী ১৫ অক্টোবরের পর থেকে খুলতে পারবে। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, ১৫ অক্টোবরের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেটি আলোচনা সাপেক্ষে পরিবর্তিতও হতে পারে। অর্থাৎ এগিয়ে আসতে পারে। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষা বিষয়ে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয়।
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কত শতাংশ শিক্ষার্থী টিকা গ্রহণ করেছেন তার তথ্য চেয়ে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে চিঠি দিয়েছে ইউজিসি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা সংক্রান্ত বিগত বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বুধবার নির্দেশনা পাঠিয়েছে ইউজিসি। ওই নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় তথ্য ৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পাঠাতে হবে। এতে যেসব তথ্য চাওয়া হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে কতজন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারী টিকা নিতে নাম নিবন্ধন করেছেন; কতজন প্রথম ডোজ নিয়েছেন কিন্তু দ্বিতীয় ডোজের তারিখ পাননি; কতজন টিকা নেননি, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নেই। পাশাপাশি এতে বিদেশি শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং কর্মকর্তার নাম-পদবিসহ জানাতে বলা হয়।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিন্ডিকেট এবং অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল চাইলে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলো খুলে দিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ১২ সেপ্টেম্বর থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অর্থাৎ প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিতে পারবো। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিষয়ে আমরা আবারও বসবো। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর সিন্ডিকেট এবং অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল নেবে। আমরা উপচার্যদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তারা চেয়েছিলেন যে, অন্ততপক্ষে সব শিক্ষার্থী প্রথম ডোজ টিকা নিতে পারলে ভালো হয়। সে অনুযায়ী অক্টোবরের মাঝামাঝি বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এখন আবার তাদের সঙ্গে কথা বলবো। তারা যদি অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একই সঙ্গে খুলতে রাজি হলে খুলবেন কিংবা ওনারা ভিন্ন কোনও তারিখও নির্ধারণ করে নিতে পারেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে ইতিবাচক মত পরামর্শক কমিটির: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে ইতিবাচক মত দিয়েছে কভিড -১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি।কমিটির সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুলতাহ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। আজ তিনি বলেন, কারিগরি কমিটি মতামত দিয়েছে। আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পক্ষে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে কমিটির সদস্যরা মতামত দিয়েছেন।
নির্দেশনা পেলেই খুলে দেয়া হবে: মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে সব ধরনের প্রস্তুতি আছে, নির্দেশনা পেলেই খুলে দেয়া হবে। আজ দুপুরে মানিকগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে তিনি এ কথা বলেন।
অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, আমাদের সকল ধরনের প্রস্তুতি নেয়া আছে... সরকার চাইলে যেকোনো সময় স্কুল খুলে দিতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের যে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়েছিল এবং যে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয়া হয়েছে, সেগুলো নকল করে নাকি জ্ঞানের মাধ্যমে করেছে, সেগুলো ভালো করে দেখার জন্য বলা হয়েছে।
“প্রতিটি বিদ্যালয় ক্লাস শুরু করার আগে যা যা করণীয় সে বিষয়গুলো মাথায় রেখে কাজ করার জন্য আগেই জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং শিক্ষকদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। কাজেই আমরা আশা করি বিদ্যালয় খুলে দিলে আমাদের কোনো সমস্যা হবে না।”