৩ বছরে অতিরিক্ত ফি আদায় ২৯ লাখ, অর্থ-ব্যয়ে অস্বচ্ছতা
শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে দুটি খাত দেখিয়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে নেত্রকোনা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি ৩ বছরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২৯ লাখ টাকা আদায় করেছে। তবে বিদ্যালয়টির আয়ের সাথে ব্যয়ের কোনো স্বচ্ছতা ও সামঞ্জস্য নেই বলে অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। এর পাশাপাশি করোনা মহামারির মধ্যে অর্থ আদায়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন অভিভাবকরা— যা নিয়ে তাদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১ নভেম্বর প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষিকা শিবানী সাহা স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি। যেখানে কম্পিউটার ও অত্যাবশ্যকীয় নামে দুটি ভাগে প্রতিমাসে ২০ টাকা করে ৪০ টাকা আদায় করা হয়। অন্যদিকে প্রত্যেক শ্রেণিতে ভর্তির শুরুতে বিবিধ/আনুষাঙ্গিক বাবদ ২০০ টাকা আদায় করা হয়। যা চলতি বছরেও আদায় করা হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০১৭ সালের সর্বশেষ চিঠিতে বার্ষিক একবার অত্যাবশ্যকীয় নামে ৩০ টাকা আদায়ের কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি প্রতিমাসে আদায় করে যাচ্ছে ২০০ টাকা করে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষিকা শিবানী সাহা বলেন, এইখান থেকে আদায়কৃত অর্থ আমরা নেই না। এগুলো বেসরকারিভাবে কম্পিউটার অপারেটরসহ আটজন কর্মচারীর বেতন দেয়ায় ব্যবহৃত হয়। এছাড়া অভ্যন্তরীণ আপ্যায়নেও এই অর্থ ব্যবহার করা হয়। আর এই টাকা কেবল আমরাই নিচ্ছি না প্রায় সব স্কুলই নিচ্ছে।
তবে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে অন্যচিত্র। প্রতিষ্ঠান প্রধানের বক্তব্য অনুযায়ী আট কর্মচারীর বেতন ভাতার পরিমাণের দিকে তাকালে দেখা যায় প্রতিষ্ঠানটির খাতার অর্থনৈতিক হিসেবে প্রতিমাসে তাদের মোট বেতন দেয়া হয় ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা। এর বিপরীতে এ বাবদ ব্যয়ের জন্য প্রতি মাসে অর্থ আদায় করা হয় ৫৬ হাজার ৬০০ টাকা। চলতি মাসে আদায় করা হলে বার্ষিক সেই অর্থের পরিমাণ দাঁড়াবে ৬ লাখ ৭৯ হাজার ২শ টাকা।
মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট জারি করা বিধি অনুসরণ না করে প্রতিষ্ঠানটি ৩ বছর ধরে এই অতিরিক্ত ফি আদায় করে যাচ্ছে। যা টাকার অংকে প্রায় ২৯ লাখ। তবে বিধি অনুযায়ী, কম্পিউটার বাবদ ২০ টাকা করে নেয়ার বৈধতা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। অবশিষ্ট খাত বাবদ বার্ষিক একবার ৩০ টাকা নিতে পারবে সেই প্রতিষ্ঠান।
অন্যদিকে ভর্তির সময় বিবিধ/আনুষাঙ্গিক বাবদ প্রত্যেক শিক্ষার্থী থেকে এককালীন আদায় করা হয় ২০০ টাকা যা সব মিলিয়ে হয় প্রায় ২ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। এই টাকার ব্যয়ের খাত হিসেবেও প্রতিষ্ঠানটি বলছে নৈশপ্রহরী সহ বেসরকারি ব্যয়গুলোই এখান থেকে বহন করা হয়।
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষিকা বলছেন, ২০১৬ সালের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী তাদের অর্থ আদায় করছে কিন্তু ২০১৭ সালের সর্বশেষ চিঠি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি এভাবে অর্থ আদায় করতে পারে না। সরকারি নথি অনুযায়ী কম্পিউটার বাবদ ২০ টাকা নিতে পারবে এমন বিধান রয়েছে।
তবে বর্তমান সময়ে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় কম্পিউটার কেন্দ্রীক এই অর্থ আদায় নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন অভিভাবকরা।
প্রতিষ্ঠান প্রধানের বক্তব্য অনুযায়ী কম্পিউটার, অত্যাবশ্যকীয় এবং বিবিধ/আনুষাঙ্গিক বাবদ প্রাপ্ত অর্থের পুরো ব্যয়ই হয় বেসরকারি নিয়োগ প্রাপ্ত কর্মচারীদের বেতন ভাতায় এবং অভ্যন্তরীণ আপ্যায়নে। তিন খাতে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক আয় ৯ লাখ ৬২ হাজার ২০০ টাকা।
প্রাতিষ্ঠানিক দলিল অনুযায়ী, বেসরকারি কর্মচারীদের মাসে বেতন প্রদান করা হয় ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা যার বার্ষিক অংক দাঁড়ায় ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। সেই হিসেবে অবশিষ্ট থাকে ৫ লাখ ১২ হাজার ২০০ টাকা। প্রতিষ্ঠান প্রধানের বক্তব্য অনুযায়ী সেই টাকা দিয়ে অভ্যন্তরীণ আপ্যায়ন খরচ হওয়ার কথা।
অনুসন্ধানে বার্ষিক ব্যয় করার পর অবশিষ্ট ৫ লক্ষাধিক টাকা থাকলেও প্রধান শিক্ষিকা বলছেন, এই টাকা আদায় না করা হলে এই গরীব মানুষগুলোর চাকরি থাকবে না। আমাদের আরো জনবল দরকার। আমরা চাহিদাও জানিয়েছি কিন্তু জনবল পাচ্ছি না, সে কারণেই বেসরকারিভাবে নিয়োগ দিয়ে সাময়িক সংকট দূর করছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক বলেন, করোনার এই সময়ে সব বন্ধ কিন্তু কম্পিউটার সহ আরেকটি অজ্ঞাত খরচ নিচ্ছে প্রতিষ্টানটি। এটা আমাদের অনেকের জন্যে সমস্যার বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়েছে। আর করোনার জন্যে সরকার যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখছে তখন বেতন প্রদানে শিক্ষার্থী অভিভাবকদের
প্রতিষ্ঠানে টেনে আনাটাও অপ্রত্যাশিত। অথচ নোটিশের একদিন পর থেকেই এভাবে বেতন আদায় করা হচ্ছে, যা আমাদেরকে অবাক করে। আমাদের দাবি হচ্ছে- এই নামে-বেনামে ফি বন্ধ করা হোক।
বেসরকারি অতিরিক্ত ফি আদায় প্রসঙ্গে নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক কাজি আবদুর রহমান বলেন, এই বিষয়ে আমি অবগত নই। আমি আজই খোঁজ নিচ্ছি। অনিয়ম হয়ে থাকলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
উল্লেখ্য, ১৪১৫ শিক্ষার্থীর এই বিদ্যালয়টির ১৯টি খাতে বেসরকারিভাবে অর্থ আদায় করা হয়। তবে এর অধিকাংশ ক্ষেত্রে অর্থ-ব্যয়ে অস্বচ্ছতার অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।