শিক্ষক সংকটে পর্যুদস্ত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আর মেরুদণ্ডের স্রষ্টা হলেন মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরা। কিন্তু বাস্তব হলেও সত্য— সারাদেশে এমপিওভুক্ত ৩০ হাজারেরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আজ এই কারিগরের অভাব। খোঁজে জানা যায়, বেসরকারি পর্যায়ের এই বিদ্যালয়গুলোতে প্রায় অর্ধলাখ শিক্ষক পদ ফাঁকা। এনটিআরসিএ’র আমলাতান্ত্রিক সমস্যা ও মামলা জটিলতায় গত দুই বছর ধরে নিয়োগ প্রক্রিয়া আটকে থাকায় ক্রমেই এই তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। যদিও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক অধিদপ্তর (মাওশি) বলছে, মামলা সংক্রান্ত সমস্যা গুছিয়ে এসেছে। শীঘ্রই বড় সংখ্যক পদের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে।
এদিকে শিক্ষক শূণ্যতায় ওইসব প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা যেমন জোড়াতালি দিয়ে চলছে, তেমনি নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতও বাড়ছে প্রায় জ্যামিতিক হারে। ব্যানবেইসের এক তথ্যে দেখা গেছে, বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় প্রতি একজন শিক্ষকের বিপরীতে ৩৫জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছেন; যেখানে পাশ্ববর্তী পাকিস্তানে পড়ছেন মাত্র ১৯জন। অন্যদিকে শ্রীলংকায় ১৭জন এবং ভারতে এই সংখ্যা ৩১জন। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাতে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ভুটান। দেশটিতে প্রতি একজন শিক্ষকের বিপরীতে মাত্র ১৪ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। গত বছর দেশের নয়টি শিক্ষা প্রশাসনিক অঞ্চলের ছয় হাজার ৫৯৪টি বিদ্যালয় ঘুরে এ প্রতিবেদন তৈরি করে ব্যানবেইস।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সারাদেশে শিক্ষক সংকটের অবস্থা এতই করুন যে, এর পরোক্ষ ফল সামগ্রিক শিক্ষাব্যস্থার উপর গিয়ে পড়ছে। আর প্রত্যক্ষভাবে তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলছে শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষাগুলোয়। এর মধ্যে এ বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার খারাপ ফলের পেছনে যেসব কারণ এসেছে, শিক্ষক সংকটও এর অন্যতম।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাবেক সদস্য ড. শরীফ এনামুল কবির মনে করেন, পিতামাতা কেবল সন্তানের জন্ম দিতে পারে কিন্তু সে সন্তানকে প্রকৃত মানুষ করা, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে দায়িত্ববোধ ও সচেতন করে সামাজিক জীব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি বলেন, পৃথিবীতে যতগুলো সম্মানজনক পেশা আছে তার মধ্যে শিক্ষকতা সর্বোচ্চ সম্মানিত পেশা। অথচ প্রাথমিক থেকে শুরু করে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন নিয়ে যে দ্বন্দ্ব চলছে, তা আজো নিরসন হয়নি। এজন্য শিক্ষক সংকটের বিষয়টিও চরমে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর মিরপুরের সিদ্ধান্ত উচ্চ বিদ্যালয়ে ২৯টি শিক্ষক পদের মধ্যে ছয়টিতে কোনো শিক্ষক নেই। প্রায় দুই সহস্রাধিক শিক্ষাথীর্র এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের তাই প্রতিদিনই বাড়তি ক্লাস নিতে হচ্ছে। ফাঁকা থাকা এসব পদের মধ্যে ইংরেজিতে দুটি, গণিতে দুটি, শারীরিক শিক্ষায় একটি এবং কৃষি শিক্ষায় একটি শিক্ষক পদ ফাঁকা রয়েছে। ইংরেজি-গণিতের মতো বিষয়ে শিক্ষক না থাকায় তা বিদ্যালয়টির শিক্ষার মানে বড় ধরনের ফাটল ধরিয়েছে বলে দাবি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।
রাজধানীর ইস্পাহানী উচ্চ বিদ্যাল্যয়ে শিক্ষক পদ ফাঁকা রয়েছে তিনটি। শহীদুল্লাহ স্কুল এন্ড কলেজে এমন ফাঁকা শিক্ষক পদ রয়েছে চারটি। এছাড়া ফাঁকা পদ রয়েছে বিয়াম মডেল স্কুল, সিদ্ধেশ্বরী বালক উচ্চ বিদ্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়সহ অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। অনুসন্ধান করা প্রায় অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন ফাঁকা শিক্ষক পদের তথ্য পাওয়া গেছে।
রাজধানীর পাশাপাশি উপজেলা ও মফস্বল এলাকার প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে কলেজগুলোতে শিক্ষক সংকটের চিত্র উঠে এসেছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, অনেক শিক্ষক আছেন যারা ‘অফ ডে’ অজুহাতে কলেজে নিয়মিত উপস্থিত থাকেন না। কোনো বিষয়ের একজন শিক্ষক কর্মরত থাকলেও তিন সপ্তাহে তিনদিন এবং একাধিক শিক্ষক কর্মরত থাকলে পালাক্রমে দুইদিন বা তিনদিন উপস্থিত থাকেন। বর্তমানে কলেজগুলোতে শিক্ষকদের ‘অফ ডে’ স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। এসব দেখার দায়িত্ব শিক্ষা প্রশাসনের কারোরই নয়। কেবল অধ্যক্ষ মহোদয়ই যথেষ্ট। সূত্র জানায়, কলেজে শিক্ষকদের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ২০১১ সালের ১২ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে যে নির্দেশ জারি করা হয়েছিল, তার সুফল আজও পাওয়া যায়নি। অথচ শিক্ষক সংকটের কারণে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হারও উদ্বেগজনক হারে কমে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকার চেয়ে প্রাইভেট বা কোচিং ক্লাসের প্রতি বেশি আগ্রহী। অভিভাবকদের মধ্যেও এ ধরনের প্রবণতা রয়েছে।
তবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, শিক্ষক সংকটের বিষয়টি সুরাহা করতে ইতোমধ্যেই অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়ে শূন্য পদের সংখ্যা জানতে চাওয়া হয়েছে। এখন পযর্ন্ত ৩৮ হাজার ৮০০ শূন্য পদের চাহিদাপত্র পাওয়া গেছে। আরও কয়েক হাজার পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সব চাহিদাপত্র হাতে পেলে আগামী এক থেকে দুই মাসের মধ্যেই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারির প্রস্তুতি নেওয়া হবে।
মাউশি’র মাধ্যমিক শাখার পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেন, স্বচ্ছতার ভিত্তিতে মেধাবীদের নিয়োগ দেয়ার জন্যই এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিছু আইনগত জটিলতায় দুই বছর নিয়োগ দেয়া সম্ভব না হলেও খুব শিগগিরই বড় ধরনের একটি নিয়োগের মাধ্যমে সব সংকট অতি দ্রুতই কাটিয়ে উঠা যাবে বলে আমরা আশা করছি।
সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা গ্রহণ ও যোগ্যদের সুপারিশ করতে ২০১৫ সালে এনটিআরসিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মূলত এরপরই মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর ম্যানেজিং কমিটির দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের ‘শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে’ দুর্নীতির পথ বন্ধ হয়ে যায়। যারাই পরবর্তীতে মামলা করে এনটিআরসিএকে নাজেহাল করে। ফলে গত দুই বছর কোনো শিক্ষক নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। তবে মামলার কাযর্ক্রম শেষ করে এনেছি। খুব শিগগিরই বড় আকারের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে।