অধ্যক্ষ পদ নিয়ে আইনি লড়াই, দেড় বছর বেতন-ভাতা বন্ধ শিক্ষকদের
কমলাপুর শেরে বাংলা রেলওয়ে স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ পদ নিয়ে জটিলতা কাটছেই না। এ নিয়ে প্রায় দেড় বছর ধরে চলছে আইনি লড়াই। এতে কলেজটিতে বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি হয়েছে। ১৬ মাস ধরে বেতন-ভাতা বন্ধ ১১ জন শিক্ষকের। আর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না কোনো শিক্ষকই। এতে এসব শিক্ষক পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা এ বিষয়ে অবগত রয়েছে। জটিলতা নিরসনে সংশ্লিষ্ট দপ্তর কাজ করছে।
কমলাপুর শেরে বাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজে এসএসসি (ভোকেশনাল), জেনারেল, কলেজ পর্যায়ে উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ ও বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজে পাঠদান চলমান রয়েছে। এ তিন শাখায় শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছেন ৪০ জন শিক্ষক। এর মধ্যে কয়েকজন খণ্ডকালীন শিক্ষকও রয়েছেন। আর কলেজটিতে শিক্ষার্থী রয়েছে ৯০০ জন।
শিক্ষকদের দাবি, অধ্যক্ষ পদে থাকাকালীন মো. আব্দুল আলিম কলেজটিতে পাঠদানের চেয়ে ব্যবসায়ে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। তিনি প্রশ্নফাঁসসহ বিভিন্ন ‘অপকর্মের’ সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এর সুবিধাভোগী তিনি একাই। তিনি দায়িত্বে থাকাকালীন কোনো শিক্ষক তার ‘অপকর্মের’ বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস করেননি।
কেউ মুখ খোলার চেষ্টা করলেই তাদের বিভিন্ন কায়দায় বহিষ্কার করতেন অভিযোগ করে তারা বলছেন, তার ৬০ বছর পূর্ণ হওয়াতে শিক্ষকরা বেঁচে গেছেন। এখন কলেজটিতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীবান্ধব বলে দাবি শিক্ষকদের। যদিও আব্দুল আলিম এসব অভিযোগ অস্বীকার করে উল্টো বিভিন্ন অভিযোগ তুলেছেন অপর পক্ষের বিরুদ্ধে। এসব নিয়েই চলছে জটিল আইনি লড়াই।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কলেজটির অধ্যক্ষ পদে মো. আব্দুল আলিমের ৬০ বছর পূর্ণ হয় গত বছরের ২২ এপ্রিল। তবে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্কুল-কলেজের এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামোর ১১.১১ অনুচ্ছেদের সুযোগ কাজে লাগিয়ে তার দায়িত্ব আরও পাঁচ বছর বর্ধিত করতে চান। কিন্তু কলেজটির শিক্ষকরা তার বর্ধিত মেয়াদের সুযোগের বিপক্ষে। তারা আব্দুল আলিমের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন। তারা বলছেন, তিনি দায়িত্বে থাকাকালীন শিক্ষকদের কল্যাণে কোনো কাজ করেননি।
কলেজটির জটিলতার বিষয়ে বোর্ড অবগত রয়েছে। তবে শিক্ষকদের বেতন-ভাতার বিষয়টি বোর্ডের আওতাধীন নয়। এ সমস্যা সমাধানে মাউশি কাজ করছে। -অধ্যাপক তপন কুমার সরকার
মন্ত্রণালয়ের এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী, বেসরকারি স্কুল-কলেজে চুক্তিভিত্তিক প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষ নিয়োগের সুযোগ নেই। তবে ঐতিহ্যবাহী ও মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে শর্ত সাপেক্ষে ৬৫ বছর পর্যন্ত এ নির্দেশনায় শিথিলতা রয়েছে।
চুক্তিভিত্তিক প্রধান শিক্ষক-অধ্যক্ষ নিয়োগ সংক্রান্ত চলতি বছরের শুরুতে জারি করা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে বলা হয়েছে, স্কুল-কলেজের এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামোর ১১.১১ অনুচ্ছেদে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছিল। এমপিও নীতিমালা অনুসারে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরিতে প্রথম প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ বছর।
সমপদে বা উচ্চতর পদে (উচ্চতর পদ বলতে শুধু প্রতিষ্ঠানপ্রধান ও সহকারী প্রধান বোঝাবে) নিয়োগের ক্ষেত্রে ইনডেক্সধারীদের জন্য বয়সসীমা শিথিলযোগ্য। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার সরকারি অংশ ৬০ বছর পর্যন্ত পাবেন। এমপিওভুক্ত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের চুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানপ্রধানের মেয়াদ সরকারের আর্থিক সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও কোনোক্রমেই ৬৫ বছরের বেশি হতে পারবে না। নীতিমালা ১১.১১ অনুচ্ছেদের এ অংশটুকুর কার্যকারিতা স্থগিত করা হলো।
শর্ত সাপেক্ষে মেয়াদ বর্ধিত করার সুযোগের কথা জানিয়ে এতে আরও বলা হয়, ঐতিহ্যবাহী ও মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে এবং সরকারের কোনো আর্থিক সুবিধা বা এমপিও না নেওয়ার শর্তে সরকারের অনুমোদনক্রমে শুধু প্রতিষ্ঠানপ্রধানের ক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানকে আর্থিকসহ সব দায়ভার বহন করতে হবে এবং সরকার এর কোনো দায় বহন করবে না।
মো. আব্দুল আলিম অধ্যক্ষ পদে তার মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য ৬০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তৎপরতা শুরু করেন। তিনি গেল বছরের ১৩ মার্চ তৎকালীন গভর্নিং বডির সভার সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ২৯ মার্চ অধ্যক্ষ পদে তার পাঁচ বছর মেয়াদ বর্ধিত করতে কমিটির একটি সুপারিশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেন। পরে ২০ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক চিঠিতে তার পক্ষে গভর্নিং বডির সুপারিশে অসস্মতি প্রকাশ করে। এতে ক্ষুব্ধ আব্দুল আলিম ২০২৩ সালের ৩০ আগস্ট একটি রিট করেন। শুনানি শেষে গত ৩০ আগস্ট আদালত মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে ছয় মাসের স্থগিতাদেশ দেন।
আদালতের আদেশ নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই এডহক কমিটি গাজী নাজনীন আক্তারকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে বসিয়েছে। আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে এডহক কমিটির এ সিদ্ধান্ত মাউশি অনুমোদন করে, যা আইনে অবৈধ। -মো. আব্দুল আলিম
এ আদেশ মানতে নারাজ রাষ্ট্রপক্ষ। তারা হাইকোর্টের এ আদেশের বিপক্ষে ওই বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করেন। আদালত রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন গ্রহণ না করে হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশনা বহাল রেখে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। পরে অবশ্য পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ বিষয়টি আইন অনুযায়ী নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ফের হাইকোর্টকে নির্দেশনা দেন।
এর মধ্যে অবশ্য আব্দুল আলিমের অধ্যক্ষ পদে আরও পাঁচ বছর বৃদ্ধির বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের যে অসম্মতি ছিল, সে সিদ্ধান্তের ওপর হাইকোর্টের ছয় মাসের যে স্থগিতাদেশ ছিল— সেটির মেয়াদ আরও দু’মাস বাড়িয়ে আদেশ দেন হাইকোর্ট বিভাগ। এরপর গত বুধবার (১৫ মে) আদালত এ আদেশ আগামী আরও এক বছরের জন্য বর্ধিত করেন। এতে হাইকোর্টের সর্বশেষ আদেশ অনুযায়ী আব্দুল আলিম কমলাপুর শেরেবাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বৈধতা পান।
মো. আব্দুল আলিম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আদালতের আদেশ নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই বর্তমান এডহক কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হোসেন হেলালের একক সিদ্ধান্তে বিধিভঙ্গ করে নন-এমপিও অস্থায়ী শিক্ষক (বাংলা বিভাগ) গাজী নাজনীন আক্তারকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে বসিয়েছে। আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে গত ২৭ মার্চ এডহক কমিটির একক সিদ্ধান্ত গত ৯ এপ্রিল মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর অনুমোদন করে, যা আইনে অবৈধ। পরে আমরা ২৪ এপ্রিল বিষয়টি অবহিত করলে আদালত ওইদিনই এ নিয়োগ কেন অবৈধ হবে না মর্মে রুল জারি করেন। একইসঙ্গে আদালত এ নিয়োগের কার্যক্রম আগামী ছয় মাসের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, এডহক কমিটির সভাপতি মোজাম্মেল হোসেন, গাজী নাজনীনসহ আরও বেশ কয়েকজন বহিরাগতদের নিয়ে আমার কক্ষের তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। রমজানের ছুটিতে গত ৪ এপ্রিল তারা এ কাজ করেছেন। তারা কলেজের নিরাপত্তা কর্মকর্তার থেকে জোরপূর্বক চাবি নিয়ে অভ্যন্তরে প্রবেশ করে আরও বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। পরবর্তীতে নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে কলেজ থেকে বের করে দিয়ে নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। এর মাধ্যমে আমাকে কলেজে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। এখন অবৈধ গাজী নাজনীনকে দিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে গাজী নাজনীন আক্তারের নিয়োগের এক মাস আগে ভোকেশনাল শাখার (বরখাস্তকৃত) ট্রেড ইনস্ট্রাকটর মো. মোসাব্বেরুজ্জামানকে গত ২১ ফেব্রুয়ারি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। চলতি বছরের গত ৫ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা অধ্যক্ষ-প্রধান শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা উপেক্ষা করে প্রথমে মোসাব্বেরুজ্জামান ও পরে গাজী নাজনীনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বন্ধ রয়েছে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা
কমলাপুর শেরেবাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ পদে আব্দুল আলিমের মেয়াদ গত বছরের ২২ এপ্রিল পূর্ণ হওয়ার পর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড তাকে ২৭ এপ্রিল অবসরে পাঠিয়ে দেয়। চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি কলেজটির গভর্নিং বডি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়। পরে বোর্ড কলেজটিতে ২৪ জানুয়ারি একটি এডহক কমিটি দেয়। এরপর আব্দুল আলিম গত ২৯ জানুয়ারি এডহক কমিটির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট করেন। এসব আইনি জটিলতায় এমপিওভুক্ত হওয়ার পরও বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না কলেজের কোনো শিক্ষক।
কলেজটির ভোকেশনাল শাখার ট্রেড ইন্সট্রাক্টর মো. জসিম উদ্দিন। তিনি আব্দুল আলিমের অধ্যক্ষ থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে কথা বলে বহিষ্কার হয়েছিলেন। তিনিসহ আরও পাঁচ শিক্ষক অধ্যক্ষ আলিমের দায়িত্বে থাকাকালীন বিভিন্ন সময় বহিষ্কার হয়েছেন। তাদের মধ্যে আছেন- কলেজটির তিন সাধারণ শিক্ষক মতিউর রহমান, মোখলেসুর রহমান, আবুল বাশার ও ট্রেড ইনস্ট্রাকটর মো. মোসাব্বেরুজ্জামান।
সবকিছুর আগে আমাদের এখন মুখ্য বিষয় শিক্ষকদের বেতন-ভাতা সচল করা। কীভাবে সব শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কার্যক্রম চালু করা যায়, আমরা সে বিষয়ে কাজ করছি। -গাজী নাজনীন আক্তার
মো. জসিম উদ্দিন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ গাজী নাজনীন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে একটা স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। আমাদের বহিষ্কারাদেশও তুলে নেওয়া হয়েছে। এখন বড় সমস্যা হলো- আমাদের দেড় বছর থেকে অনেক শিক্ষকের বেতন-ভাতা আটকে আছে। বেতন-ভাতা ছাড়া আমরা শিক্ষকরা মানবেতর জীবনযাপন করছি। সাবেক অধ্যক্ষ আব্দুল আলিম মামলা-হামলা করে আমাদের বেতন-ভাতা আটকে রেখেছেন। তিনি আবার পাঁচ বছর দায়িত্বে আসলে আমাদের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। কলেজটিও তিনি বিক্রি করে দেবেন।
অধ্যক্ষ আলিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে শিক্ষক জসিম আরও বলেন, প্রতিষ্ঠানের টাকা দিয়ে তিনি এসব মামলা পরিচালনা করছেন। মামলার কিছু ভাউচারও আমাদের কাছে আছে। এর মধ্যে তিনি শুধু একটি মামলা পরিচালনা করেছেন ৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকায়। তিনি টাকার বিনিময়ে আইনজীবী কিনে এসব সমস্যা জিইয়ে রেখেছেন। শিক্ষকদের মাঝে এখন একটাই হাহাকার, কবে আমরা বেতন পাব? আমাদের পরিস্থিতির কথা আমরা বোর্ড, অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছি। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের স্বাক্ষরে বেতন-ভাতার নির্দেশনা থাকলেও ব্যাংক সেটা শুনছে না।
কলেজটির জেনারেল শিক্ষক মো. মতিউর রহমান। তিনিও বহিষ্কার হয়েছিলেন। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ অধ্যক্ষ আব্দুল আলিম আইন-আদালতকে ব্যবহার করে আমাদের বেতন-ভাতা বন্ধ করে রেখেছেন। প্রতিষ্ঠানটির কোনো শিক্ষক এখন বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। তিনি আমাদের বিপদে ফেলে আলোচনার প্রস্তাব দিচ্ছেন। তার সাথে কোনো আলোচনা হতে পারে না। আইনি প্রক্রিয়ায় আমরা সঙ্কটের সমাধান করব। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও এ পরিস্থিতি উত্তরণে আমরা যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছি। শিগগিরই এ সমস্যার সমাধান হবে।
কলেজটির এক অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কলেজটিতে পাঠদানের অবস্থা আসলেই ভালো নয়। এখন সেটার আরও অবনতি হচ্ছে। দু’পক্ষের আইনি জটিলতায় আমাদের ছেলে-মেয়েরা ভুক্তভোগী হচ্ছে। সাবেক অধ্যক্ষ আইন নিয়ে খেলছেন। বর্তমান যারা দায়িত্বে আছেন, তারা প্রতিনিয়ত দৌঁড়ের উপর থাকছেন। আজ অধিদপ্তরে তো কাল মন্ত্রণালয়- প্রতিদিন কারো না কারো সাথে তাদের বৈঠক থাকেই। আমরা যেটা দেখছি, প্রতিষ্ঠানে পাঠদানের চেয়ে আইনি জটিলতা মোকাবিলা করা এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়া জরুরি।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
কমলাপুর শেরেবাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২৫টি দোকান ও একটি মোবাইল টাওয়ার রয়েছে। এ খাতের আয়ের টাকা দিয়ে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের অর্থের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়ে রয়েছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। আব্দুল আলিমের বিরুদ্ধে বর্তমান শিক্ষকদের অভিযোগ, তিনি এসব প্রতিষ্ঠানের ১ কোটি লাখ ৪৫ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। আর আব্দুল আলিমের ভাষ্য, স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের অর্থ ভোগ করছে। তারা কলেজকে কোনো অর্থই দিচ্ছে না।
দুপক্ষের আইনি জটিলতায় আমাদের ছেলে-মেয়েরা ভুক্তভোগী হচ্ছে। সাবেক অধ্যক্ষ আইন নিয়ে খেলছেন। বর্তমান যারা দায়িত্বে আছেন, তারা প্রতিনিয়ত দৌঁড়ের উপর থাকছেন। প্রতিদিন কারো সাথে না কারো সাথে তাদের বৈঠক থাকেই। -অভিভাবক, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
দোকানগুলো ঘুরে দেখা গেছে, ছোট-বড় আকারে তৈরি করা হয়েছে এসব দোকান। এর মধ্যে চা, গাড়ির গ্যারেজ, ইলেক্ট্রনিক্সসহ বিভিন্ন ধরনের দোকান রয়েছে। কলেজের দেয়াল ঘেঁষে রাস্তার পাশে এসব দোকানের অবস্থান। এসব থেকে মাসে প্রায় ২ লাখ টাকা ভাড়া উত্তোলন করা হয়। এছাড়া এক টি মোবাইল ফোন অপারেটরের টাওয়ার বছরে ভাড়া হিসেবে কলেজকে পরিশোধ করে আরও ২ লাখ টাকা।
কলেজের সঙ্কটের বিষয়টি দোকান মালিকদেরও অনেকে অবগত। তাদের ভাষ্য, কলেজের দায়িত্বে কে আসলেন আর কে গেলেন— সেটা মুখ্য বিষয় নয়। তারা যেহেতু কলেজের জায়গায় ভাড়া আছেন, সেক্ষেত্রে তারা কলেজকে ভাড়া পরিশোধ করতে বাধ্য। তবে কলেজের বর্তমান শিক্ষকরা বলছেন, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত কোনো ভাড়া তারা পাননি। সাবেক অধ্যক্ষ আব্দুল আলিম এসব দোকান থেকে অতিরিক্ত টাকা আগেই নিয়ে রেখেছেন। এখন ভাড়া চাইতে গেলে তারা এডভান্স থেকে কেটে রাখার কথা বলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দোকান মালিক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, অধ্যক্ষ হিসেবে মো. আব্দুল আলিমের ৬০ বছর পূর্ণ হওয়ার পরও তিনি আরও পাঁচ বছর দায়িত্বপালন করতে চেয়েছেন। কিন্তু তিনি সেটার অনুমোদন না পাওয়ায় কলেজে একটা ঝামেলা চলছে। তবে এখানে আমাদের কারো কোনো ভূমিকা নেই। প্রশাসনিক জটিলতা কলেজের দায়িত্বশীলরা বসে সমাধান করতে পারেন। এতে উভয় পক্ষের জন্যেই মঙ্গল।
আব্দুল আলিমের বিরুদ্ধে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ
প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে ২০১৭ সালের ১ মার্চ কলেজের ইংরেজি শিক্ষক রফিকুল ইসলামসহ ৮ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর কয়েকদিন পর শিক্ষক, কোচিং সেন্টারের স্টাফ ও অন্য মিলে একই অভিযোগে আরও ১৬ জন গ্রেপ্তার হন। তারা তখন দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন। তাদের জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে কমলাপুর শেরেবাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল আলীমও ওই বছরের ৭ মার্চ গ্রেপ্তার হন। তাদের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ গঠন করা হয়।
আরো পড়ুন: বেসরকারি স্কুলের ভর্তি ফি সরকারি কোষাগারে জমার নির্দেশ, ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা
জানতে চাইলে আব্দুল আলিম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, প্রশ্নফাঁসের অভিযোগের শুনানির জন্য একাধিক তারিখ ঠিক করা হলেও রাষ্ট্রপক্ষ কোনো তারিখে অভিযোগের বিষয়ে একজন সাক্ষীকেও ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করতে পারেননি। এমনকি এজহারকারী নিজেই সাক্ষ্য দিতে ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হননি। রাষ্ট্রপক্ষের মামলা পরিচালনার এমন অনীহায় দায় থেকে আমাদেরকে গত বছরের জুলাইয়ে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এদিকে গত সোমবার (১৩ মে) মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের (বেসরকারি মাধ্যমিক-১) সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়েছে, কমলাপুর শেরে বাংলা রেলওয়ে স্কুল এন্ড কলেজের অবসরোত্তর মো. আব্দুল আলিম অধ্যক্ষ পদে কর্মরত থাকার বিষয়ে আবেদন করেছেন। আবেদনে মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগের নির্দেশনার আলোকে কী করণীয় রয়েছে, তা আইন বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে প্রয়োনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ বিভাগকে অবহিত করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
এ চিঠির অনুলিপি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের বেসরকারি মাধ্যমিক অধিশাখা ও কমলাপুর শেরে বাংলা রেলওয়ে স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ আরও একাধিক দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
কলেজটিতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ গাজী নাজনীন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে একটা স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। আমাদের বহিষ্কারাদেশও তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে এখন বড় সমস্যা হলো দেড় বছর থেকে অনেক শিক্ষকের বেতন-ভাতা আটকে আছে। -মো. জসিম উদ্দিন
জানতে চাইলে মাউশির অনুমোদনপ্রাপ্ত কলেজের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ গাজী নাজনীন আক্তার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সবকিছুর আগে আমাদের এখন মুখ্য বিষয় শিক্ষকদের বেতন-ভাতা সচল করা। কলেজের একাধিক শিক্ষককে অন্যায়ভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। আমি দায়িত্বগ্রহণের পর এডহক কমিটির সিদ্ধান্তের আলোকে তাদের বহিষ্কারাদেশ তুলে চাকরিতে ফিরিয়ে এনেছি। তবে তারা এখনো বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। কীভাবে সব শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কার্যক্রম চালু করা যায়, আমরা সে বিষয়ে কাজ করছি।
শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যানদের সমন্বয় কমিটির প্রধান ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, কলেজটির জটিলতার বিষয়ে বোর্ড অবগত রয়েছে। তবে শিক্ষকদের বেতন-ভাতার বিষয়টি বোর্ডের আওতাধীন নয়। এ সমস্যা সমাধানে মাউশি কাজ করছে। আমরা যতটুকু শুনেছি, মাউশি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করে দেওয়ার জন্য বলেছে। তবে কিছু আইনি জটিলতায় এখনো বিষয়টি সমাধান হচ্ছে না। মাউশি এবং ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আদালতের মাধ্যমে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা পরিশোধে উদ্যোগ নেবেন।