লটারি ছাড়াও শিক্ষার্থী ভর্তি ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেলে
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভর্তির নীতিমালা অনুযায়ী দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোতে প্রথম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি সম্পন্ন করতে হবে। এর বাইরে শিক্ষার্থী ভর্তি সম্পূর্ণ অবৈধ। কিন্তু রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অবস্থিত স্বনামধন্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের নবম শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করানো হয়েছে। গত ৪ জানুয়ারি সকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয় বলে জানা গেছে। একইসঙ্গে তৃতীয়, ষষ্ঠ এবং নবম শ্রেণিতে অপেক্ষমান তালিকার বাইরে থেকেও ভর্তি করানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পদাধিকার বলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা সচিব (শিক্ষা সচিব) সোলেমান খান। বোর্ডের সর্বোচ্চ পদে খোদ শিক্ষা সচিব রয়েছেন- এমন প্রতিষ্ঠানে ‘অবৈধভাবে’ শিক্ষার্থী ভর্তির তথ্য জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অভিভাবকরা। আর ভর্তির লটারির তদারকের দায়িত্বে থাকা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) বলছে, নীতিমালার বাইরে গিয়ে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ নেই।
আরও পড়ুন: বেসরকারি স্কুলে সর্বোচ্চ ভর্তি ফি ৮ হাজার, নীতিমালা জারি
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বলছে, ১ জানুয়ারির আগে লটারির মাধ্যমে ভর্তি কার্যক্রম শেষ হয়েছে। তবে নবম থেকে দশম শ্রেণিতে উঠতে না পারা (অকৃতকার্য) কয়েকজন শিক্ষার্থী টিসি (ট্রান্সফার সার্টিফিকেট) নিয়েছে। তাদের আসন খালি হওয়ায় এই পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। এখানে লটারির সাথে সম্পর্ক নেই বলে দাবি তাদের।
গত বছরের ২৩ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ ২০২৪ সালের বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি নীতিমালাটি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছিল। শিক্ষা সচিব সচিব সোলেমান খান স্বাক্ষরিত ওই নীতিমালায় ভর্তির জন্য আবেদন এবং শিক্ষার্থী নির্বাচনের পদ্ধতির ৭.২ ধারায় বলা আছে, “ঢাকা মহানগরীর ভর্তি কমিটি কেন্দ্রীয়ভাবে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের ভর্তি প্রক্রিয়া ডিজিটাল লটারির যাবতীয় প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সম্পাদন করবে। বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের ভর্তির আবেদন ও আবেদনের ফি গ্রহণ এবং ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ ও প্রকাশ কেন্দ্রীয়ভাবে অনলাইনের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে। ডিজিটাল লটারি অনুষ্ঠানের পূর্বে অন্য একটি টেকনিক্যাল প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রস্তুতকৃত সফটওয়্যারের যথার্থতা যাচাইকরণ নিশ্চিত করতে হবে।
আরও পড়ুন: ২০২৪ সালেও মাধ্যমিক ভর্তিতে ডিজিটাল লটারি
ডিজিটাল লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত শিক্ষার্থীর তালিকা প্রস্তুত করার পাশাপাশি শূন্য আসনের সমান সংখ্যক অপেক্ষমাণ তালিকাও প্রস্তুত করতে হবে। ভর্তি কমিটি কর্তৃক নির্ধারিত তারিখে নির্বাচিত শিক্ষার্থী ভর্তি না হলে অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে তালিকার ক্রমানুসারে ভর্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রকাশিত ফলাফলের তালিকার ক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। শিক্ষাবর্ষের কোনো সময়ে আসন শূন্য হলে প্রকাশিত অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে ক্রমানুসারে ভর্তি করে আসন পূরণ করতে হবে। শিক্ষাবর্ষের কোনো সময়ই এন্ট্রি/প্রথম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের পরীক্ষা গ্রহণ করা যাবে না।”
ঢাকা মহানগরীর ভর্তি কমিটির সভাপতি মাউশির মহাপরিচালক আর সদস্য সচিব মাউশির বেসরকারি মাধ্যমিকের পরিচালক। আর ৮ জন রয়েছে সদস্যের দায়িত্বে। তারা সবাই মাউশি ও ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তা।
এই নীতিমালা অনুযায়ী, ডিজিটাল লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী নির্বাচিত করে তালিকা প্রস্তুত করার পাশাপাশি শূন্য আসনের সমান সংখ্যক অপেক্ষমাণ তালিকাও প্রকাশ করে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল। লটারির মাধ্যমে ভর্তি কার্যক্রম গত ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হয়েছে বলে দাবি প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের।
তবে গত ৪ জানুয়ারি সকালে হঠাৎ করে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন শিক্ষক ও অভিভাবক জানান, লটারি ছাড়া অন্য মাধ্যমে ভর্তি নেওয়ার সুযোগ নেই। যদি কাউকে ভর্তি করানো হয় অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে ভর্তি করানোর কথা। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার হঠাৎ করেই ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থী ভর্তির পরীক্ষা নিয়ে কোনো বিজ্ঞপ্তি পত্রিকা, তাদের ওয়েবসাইটে কিংবা কলেজের কোনো নোটিশ বোর্ডেও প্রকাশ করা হয়নি বলে অভিযোগ তাদের।
৪ জানুয়ারি দুপুরে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী শামিম ফরহাদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী বই উৎসবের আগে জানুয়ারির ১ তারিখের আগে নবম শ্রেণির লটারির মাধ্যমে আমাদের ভর্তি কার্যক্রম শেষ হয়েছে। কিন্তু এবার যারা নবম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণিতে উঠছে তাদের মধ্যে ২-৩ জন পাশ করতে না পারায় দশম শ্রেণিতে উঠতে পারেনি। তারা টিসি নিয়েছে।
“সেই ২-৩টি সিটের জন্য আজ একটি পরীক্ষা নিয়েছি। এখানে লটারির সাথে সম্পর্ক নেই। লটারির ভর্তি আগে শেষ হয়েছে। ২-৩ জন টিসি নেওয়ায় সে শূন্য আসনে ভর্তির জন্য পরীক্ষা নিয়েছি।”
আজকে যে ভর্তি পরীক্ষা হবে এটা কীভাবে জানানো হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “যেহেতু ২/৩টি সিট। যারা নিয়মিত অফিসে যোগাযোগ রেখেছে, তারা সবাই জানতো। আজকে একটি সিটের বিপরীতে ১০ জনের উপর ক্যান্ডিডেট ছিল। অনেকেই জানতো।” যারা এরকম কথা ছড়াচ্ছে তারা বাজে করছে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
এদিকে, ৪ জানুয়ারি দুপুর পর্যন্ত কলেজের ওয়েবসাইটে ভর্তির বিজ্ঞপ্তির কোনে নোটিশ দেয়া হয়নি। পরে ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে নবম শ্রেণিতে কিছু সংখ্যক শূন্য আসনে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি’ নামে একটি জরুরি বিজ্ঞপ্তি ওয়েবসাইটে দেখা যায়।
জরুরি নোটিশটি ৩ জানুয়ারির হলেও প্রকাশ করা হয় পরদিন, অর্থাৎ ৪ জানুয়ারি
সেখানে বলা হয়, “ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের নবম শ্রেণির কিছু সংখ্যক ছাত্র অকৃতকার্য হওয়ার প্রেক্ষিতে ৩ জানুয়ারি টিসি নিয়ে চলে যাওয়ায় কিছু আসন শূন্য হয়। উক্ত শূন্য আসনসমূহ পূরণ করার জন্য ভর্তিচ্ছু আগ্রহী ছাত্রদের আগামী ৪ জানুয়ারি সকাল ৯টায় কলেজের শিক্ষাভবন-১ এ উপস্থিত হয়ে তথ্যাদি ও মেধা যাচাই এ অংশগ্রহণ করার জন্য বলা হলো। তবে, ইতিমধ্যে লটারিতে নির্বাচিত ছাত্রদের ভর্তি কার্যক্রম ৩১ ডিসেম্বর সম্পন্ন হয়েছে।”
মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) ও ঢাকা মহানগরীর ভর্তি কমিটির সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ভর্তি নীতিমালায় কিভাবে ভর্তি করাতে হবে তা নিয়ে সব বলা রয়েছে। পরীক্ষা নিয়ে ভর্তি না করানোর জন্যই তো লটারি। তাই বিষয়টি নিয়ে প্রশ্নই আসে না।
রেসিডেনসিয়াল বিষয়টি তাকে জানানো হলে, তিনি জানান, বিষয়টি তার জানা ছিল না। আমরা যদি জানতে পারি এমন হচ্ছে তাহলে কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাইবো। এ নিয়ে আমাদের কমিটি আছে তারা বিষয়টি দেখবেন।
জানতে চাইলে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরাও বিষয়টি জেনেছি। গত ৪ তারিখে সেখানে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। নীতিমালার বাইরে কিভাবে পরীক্ষা নিয়ে ভর্তি করানো হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। তাছাড়া ভর্তি করাতে তাদের তো বিশেষ কোনো আদেশ নেইও কিংবা হাইকোর্টেরও কোনো আদেশও নেই।
“তাই বিষয়টি নিয়ে আমরা সবাই উদ্বিগ্ন। কেননা সচিব যেখানে সভাপতি সেখানে যদি এমন অনিয়মের ঘটনা ঘটে তাহলে আর কিছু বলার থাকে না। তাই আমরা প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। যাতে উনারা বিষয়টি দেখেন।” তাছাড়া অভিভাবকরা এ নিয়ে অভিযোগ করলে তাদের উপর নানা ধরনের চাপ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ তার।
বিষয়টি জানতে শিক্ষা সচিব সোলেমান খানের মুঠোফোনে একাধিক বার কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এর ফলে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।