অক্টোবরে প্রশিক্ষণ পাবেন ‘বাদ পড়া’ ১ লাখ ২০ হাজার শিক্ষক
দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান শুরু হয়েছিল চলতি বছরের প্রথমদিন। শুরুতে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম এবং বাকি শ্রেণিগুলোতে ২০২৪ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে এই শিক্ষাক্রম চালুর লক্ষ্যে কাজ করছেন সংশ্লিষ্টরা। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের প্রচলিত শিক্ষায় আমূল পরিবর্তনের মূল কারিগর শিক্ষকরা যাতে শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে পঠন-পাঠন সম্পন্ন করতে পারেন সেজন্য শুরুতেই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনার উদ্যোগ নেয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। আর এতে শিক্ষাক্রম ও অন্যান্য কার্যক্রমের তদারকি করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের শুরুতে চলতি বছরের গোড়ার দিকেই প্রশিক্ষণ শেষ করে মাউশি ও এনসিটিবি। বদলে যাওয়া শিখন ও মূল্যায়নের কাঠামোয় শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে সরকার। এতে প্রশিক্ষণের আওতায় আসে দেশের শিক্ষালয়গুলোর প্রায় ২ লাখ ৮০ হাজারেরও বেশি শিক্ষক। নতুন শিক্ষাক্রমের এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম থেকে বিভিন্ন কারণে তখন বাদ পড়েছিলেন প্রায় ১ লাখ ২০ হাজারের মতো শিক্ষক। এবার সে বাদ পড়া শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে এনসিটিবি ও মাউশি।
দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার তদারক সংস্থা মাউশি আগামী ১৮ থেকে ২২ অক্টোবরের মধ্যে এ প্রশিক্ষণ আয়োজনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। বাদ পড়া এসব শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে অধিদপ্তরের ব্যয় হবে ১‘শ ৬ কোটি টাকা। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বাজেট প্রস্তাবে এ ব্যয় ধরা হয়েছে ১’শ ৩২ কোটি ১৯ হাজার ২’শ টাকা। বাদ পড়া এসব শিক্ষকদের নতুন করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যসূচির ওপর।
এর আগে বিগত বছরের ডিসেম্বরে নতুন শিক্ষাক্রম চালুর আগে মাধ্যমিক স্তরের তিন লক্ষাধিক শিক্ষককে শুরুতে এক ঘণ্টা করে অনলাইনে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ডিসেম্বরের মধ্যে সব শিক্ষককে পাঁচ দিনের সশরীর প্রশিক্ষণ দেওয়ার পথরেখা ঠিক করে দিয়েছিল। এরপর শিক্ষকরা পাঁচদিন সশরীর প্রশিক্ষণ পান চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে।
যেহেতু নতুন শিক্ষাক্রমে শিখনভিত্তিক মূল্যায়ন এবং প্রথাগত ধারার বাইরে যাওয়া হয়েছে। ফলে সেখানে শিক্ষককে বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ দেয়া হয়েছে।
এবারের নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করেছে এনসিটিবি। আর মাধ্যমিকের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণসহ দক্ষতা উন্নয়ন ও বাস্তবায়নের কাজটি করছে মাউশি। নতুন শিক্ষাক্রমে জোর দেয়া হচ্ছে অভিজ্ঞতাভিত্তিক পাঠদানকে। এতে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিদ্যমান পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হওয়ার কথা রয়েছে।
এতে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রথাগত কোনো পরীক্ষা রাখা হয়নি। আর দুটিই থাকছে পরবর্তী শ্রেণিগুলোর মূল্যায়নের পদ্ধতি হিসেবে পরীক্ষা ও ধারাবাহিক শিখন কার্যক্রমে। পাশাপাশি বাদ দেয়া হয়েছে এখনকার মতো এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাও। যা শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে হবে এসএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে নতুন শিক্ষাক্রমে।
এর আগে গত বছরের মে মাসে নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুমোদন দেয় সরকার। এরপর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে পথরেখা দেয় এনসিটিবি। এতে বলা হয়, মাধ্যমিক স্তরে ৬৪ জেলায় প্রতি বিষয়ে তিনজন করে মূল প্রশিক্ষক বা মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করা হবে। তাঁরা আবার প্রতিটি উপজেলায় প্রতি বিষয়ে তিনজন করে শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেবেন।
গত ২০২১ সালের মে মাসে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন এনে প্রণয়ন করা শিক্ষাক্রমের রূপরেখাটি অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিদ্যমান পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হবে। এর মধ্যে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা হবে না, পুরোটাই মূল্যায়ন হবে সারা বছর ধারাবাহিকভাবে চলা বিভিন্ন রকমের শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে। পরবর্তী শ্রেণিগুলোর মূল্যায়নের পদ্ধতি হিসেবে পরীক্ষা ও ধারাবাহিক শিখন কার্যক্রম—দুটোই থাকছে।
বাদ পড়া এসব শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে অধিদপ্তরের ব্যয় হবে ১‘শ ৬ কোটি টাকা। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বাজেট প্রস্তাবে এ ব্যয় ধরা হয়েছে ১’শ ৩২ কোটি ১৯ হাজার ২’শ টাকা।
নতুন নিয়মে এখনকার মতো এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা হবে না। শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে হবে এসএসসি পরীক্ষা। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে। প্রতি বর্ষ শেষে বোর্ডের অধীনে এই পরীক্ষা হবে। এরপর এই দুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে।
এ ছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণির আগে কোনো পাবলিক পরীক্ষা রাখা হয়নি। একজন শিক্ষার্থী বিজ্ঞান, মানবিক নাকি ব্যবসায় শিক্ষায় পড়বে, সেটি ঠিক হবে উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে ১০টি অভিন্ন বিষয়ে পড়ানো হবে। এখন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সবাইকে অভিন্ন বিষয় পড়তে হয়। আর একজন শিক্ষার্থী বিজ্ঞান, মানবিক নাকি ব্যবসায় শিক্ষায় পড়বে, সেটি বর্তমানে ঠিক হয় নবম শ্রেণিতে গিয়ে।
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতি বছর থেকে প্রথম শ্রেণি ও ষষ্ঠ শ্রেণির জন্য নির্ধারিত কিছুসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাক্রম পরীক্ষামূলকভাবে (পাইলটিং) চালু করা হবে। বিভিন্ন শ্রেণিতে তা পর্যায়ক্রমে চালু হবে পরের বছর থেকে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি; ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণি; ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে চালু হবে নতুন শিক্ষাক্রম। এরপর উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে ২০২৬ সালে এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে ২০২৭ সালে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে।
এনসিটিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বিগত বছরের শেষ দিকে এবং চলতি বছরের শুরুতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের কাজ শেষ করেছে মাউশি। এতে নানা উদ্যোগ থাকার পরও বাদ পড়েছেন এক লাখেরও বেশি সংখ্যক শিক্ষক। যেহেতু নতুন শিক্ষাক্রমে শিখনভিত্তিক মূল্যায়ন এবং প্রথাগত ধারার বাইরে যাওয়া হয়েছে। ফলে সেখানে শিক্ষককে বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ দেয়া হয়েছে। তাই শিক্ষকরা যাতে প্রশিক্ষণের বাইরে না থাকেন—সেজন্য নতুন করে এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এবং এতে বাদ পড়া সকল শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
এ নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) স্কিম শাখার পরিচালক প্রফেসর সৈয়দ মাহফুজ আলী জানিয়েছেন, আমরা বাদ পড়া সকল শিক্ষককে এবারের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করছি, এবারের প্রশিক্ষণের ফলে আর কোনো শিক্ষক নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় প্রশিক্ষণের বাইরে থাকবে না। এছাড়াও যেহেতু আগামী বছর নতুন শিক্ষাবর্ষে আমাদের অষ্টম ও নবম শ্রেণি নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় আসছে। সেজন্য আমরা পরবর্তী ক্লাসগুলোর প্রশিক্ষণ চলতি বছরের মধ্যেই শেষ করব।