২৯ জুন ২০১৮, ১৭:৩৬

‘আমরা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানাই, শ্রমের মূল্য পাই না’ 

আমরণ অনশনরত শিক্ষক-কর্মচারীরা  © তুহিন রহমান

আমরা মানুষ গড়ি। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, রাজনীতিবিদসহ সকল পেশার মানুষ তৈরি করি। কিন্তু নিজেরাই বৈষম্যের শিকার। শ্রমের মূল্য পাই না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, তাই খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবণ-যাপন করছি। প্রয়োজনে জীবন দিব, এবার তবুও খালি হাতে বাড়ি ফিরবো না।

শুক্রবার দুপুরে অনশনস্থলে এসব কথা বলেন নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ড. বিনয় ভূষণ রায়।

জানা যায়, দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি করার দাবিতে গত সোমবার থেকে জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকায় আমরণ অনশনে নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীরা। শুক্রবার ৫ দিনের মাথায় অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রায় শতাধিক অনশনকারীরা। এদের মধ্যে ১৩ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৬ জন এখনও হাসপাতালে রয়েছেন। বাকীরা অনশনস্থলে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের ব্যানারে গত ১০ জুন থেকে তারা একই স্থানে টানা অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। টানা ১৫ দিন অবস্থানের পরও সুনির্দিষ্ট কোনো আশ্বাস না পেয়ে সোমবার থেকে আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করেন। 

শুক্রবার দুপুরে অনশনস্থলে দেখা যায়, খোলা আকাশের নিচে জাতীয় প্রেসক্লাবের বিপরীতে রাস্তার পাশে দুইভাগ হয়ে অনশন পালন করছেন তারা। একপাশে যারা অসুস্থ তারা স্যালাইন নিয়ে শুয়ে-বসে অনশন পালন করছেন। আরেক পাশে বসে বসে অনশন পালন করছেন এখনও যারা সুস্থ তারা। মাঝে মধ্যে তারা স্লোগানও দিচ্ছেন।

তাদের স্লোগানের মধ্যে রয়েছে ‘একদফা একদাবি এমপিও দিতে হবে’, ‘প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন চাই’, ‘দাবি আদায় না করে ঘরে ফিরে যাব না’। দুই থেকে তিনশত অনশনকারী সেখানে অবস্থান করছেন।

তবে ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার বলেন, অনশনে অংশ নিতে সারাদেশ থেকে দুই থেকে তিন হাজার শিক্ষক-কর্মচারী রাজধানীতে এসেছেন। তবে তারা অনশনস্থলের আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন। তাছাড়া অসুস্থের সংখ্যা দিনদিন বাড়াতে তাদের চিকিৎসার জন্য সাহাজ্য-সহযোগিতার প্রয়োজন।

সারাদেশ থেকে বেশি শিক্ষক-কর্মচারীর ঢাকায় আসলে, আর্থিক সমস্যায়ও পড়তে পারি। তাই কম লোকজন আসতে অনুমতি দেয়া হচ্ছে। অনশনকারীদের চিকিৎসার দেখাশুনার দায়িত্বে রয়েছেন বরিশাল আনছার উদ্দীন মল্লিক কলেজের প্রভাষক প্লাবন মজুমদার।

তিনি বলেন, অনশনে অংশ নিয়ে হঠাৎ খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হওয়াতে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তারা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছেন। এজন্য অনেককেই অনশনস্থলে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। যারা বেশি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছেন তারা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।

এ পর্যন্ত মোট ১৩ জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬ জন এখনো ভর্তি রয়েছেন। বাকীরা চলে এসেছেন।

কুষ্টিয়া থেকে আগত আব্দুর রাজ্জাক নামে এক শিক্ষক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৭০১নং ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন। তার বরাত দিয়ে দিয়ে প্লাবন মজুমদার বলেন, ‘অনশনে অংশ নিয়ে রাজ্জাক স্যার শারীরিকভাবে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েন। কথা বলার মতো শক্তি ওনার ছিল না। যখন হাসপাতালে ভর্তি করাই তখন ঔষদ খাওয়ার জন্য স্যার পানি খেতে চাননি। উনি বলেছিলেন, বেতন-ভাতা না পেলে বেঁচে থেকে কি লাভ। পরে ডাক্তাররাসহ আমরা অনুরোধ করে ওনাকে ঔষধ খাওয়াই।’

ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার বলেন, আমাদের দাবি ন্যায্য দাবি। দাবি একটাই। দাবি আদায় করেই আমরা বাড়ি ফিরবো। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত কেউ যোগাযোগ করেনি বলে তিনি জানান।

জানা যায়, সারা দেশে সোয়া পাঁচ হাজার নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রয়েছে প্রায় ৮০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। যাদের অধিকাংশই বেতন পাননা। অথচ এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদেরকে সরকার কর্তৃক সনদ দেয়া হয়। বছরের পর বছর ধরে বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষকতা করতে করতে তারা আজ ক্লান্ত।

নন-এমপিও এসব স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২৫ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছেন। এই বিপুল সংখ্যাক শিক্ষার্থীদের পড়ানোর মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেও শ্রমের মূল্য পাচ্ছেননা। তাই তারা শ্রমের মূল্যের জন্য আন্দোলনের নেমেছেন।

জানা যায়, তাদের এ আন্দোলন শুরু হয়েছে ২০০৬ সাল থেকে। এ পর্যন্ত মোট ২৭ বার আন্দোলন করেছেন শিক্ষকরা। প্রতিবারই সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়। তবে তা আর বাস্তবায়ন হয়না। চলতি বছরের শুরুর দিকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান ও অনশন কর্মসূচিতে যায় তারা। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তাদের দাবি মেনে নেয়ার ব্যাপারে আশ্বাস দিলে আন্দোলন প্রত্যাহার করে তারা। তবে আসন্ন অর্থবছরের বাজেটে এ আশ্বাসের প্রতিফলন না পাওয়ায় ফের আন্দোলনে তারা।

এদিকে, আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেন, দীর্ঘ ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে শিক্ষকতা করে এখনও বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। পরিবারের মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারেন না। সমাজে তাদের কোনো সম্মান নেই। টিউশনি করিয়ে যা অর্থ আয় হয় তা দিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতে হয়।

তারা বলেন, আমারা বেতন-ভাতার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে চলছি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী এমপিওকরণের ঘোষণা দেয়ায় আমরা আন্দোলন স্থাগিত করে বাড়ি ফিরে যাই। বলা হয়েছিল, চলতি বছরের বাজেটে এমপিওভুক্তির বিষয়ে বরাদ্দ দেয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। উল্টো এমপিও নীতিমালার নামে আমাদের বিভক্ত করার চেষ্টা চলছে।

অনশনে অংশ নিতে ৯ জুন থেকে বরগুনা সদরের উত্তর খাজুরা ইছহাকিয়া আলিয়া মাদ্রাসার আরবী প্রভাষক মো: নুরুল আলম রাজধানীতে আছেন। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বেতন-ভাতা না পাওয়ায় পরিবার-পরিজনকে নিয়ে জীবন-যাপন করা কষ্ঠসাধ্য হয়েছে। তাই সবাইকে ছেড়ে অনশনে যোগ দিয়েছি। এবার ঈদ ঢাকাতে করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে দেশের নতুন এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকার কাজ করছে। তবে বিষয়টি মানতে নারাজ শিক্ষক-কর্মচারীরা। তারা সুস্পষ্ট ঘোষণা চান।

বিষয়টিতে সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, বাজেটে আলাদাভাবে উল্লেখ না থাকলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি করতে এটা কোন বাধা হবে না। বাজেটে থোক বরাদ্দ রয়েছে। এমপিওভুক্তির ব্যাপারে সরকার কাজ করছে।

তিনি বলেন, নন এমপিওদের এমপিওভুক্ত করার জন্য আগেই আমি প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। অর্থমন্ত্রী নিজেও কথা দিয়েছেন, আমরা এমপিওভুক্তি করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছি। বাজেটে অনেক বিষয়ে উল্লেখ করে দেওয়া নেই, কোন টাকা কোন খাতে বরাদ্দ দেওয়া বলা নেই।