২৫ নভেম্বর ২০২২, ২৩:৪৯

৫৭ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কম্পিউটার নেই, পাঠ্যবইয়ে সীমাবদ্ধ প্রযুক্তি শিক্ষা

ডিজিটাল বাংলাদেশে কম্পিউটার ল্যাব নেই প্রায় ১২হাজার বিদ্যালয়ে  © ফাইল ফটাে

তথ্য-প্রযুক্তিতে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া বিশ্বে কম্পিউটার জ্ঞান অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় স্কুল পর্যায় থেকেই শিশুদের প্রযুক্তিতে দক্ষ করে তোলার উদ্যোগ নিচ্ছে বিভিন্ন দেশ। এ জন্য পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি হাতে-কলমে শেখারও ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে দেশের শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ কম্পিউটার শিক্ষা হাতে-কলমে পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু পাঠ্যবইয়ে পড়ে শিক্ষাজীবনের বড় অংশ পার করছে তারা। ফলে প্রযুক্তি জ্ঞানেও পিছিয়ে পড়ছে।

পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে কম্পিউটার ল্যাব নেই ১১ হাজার ৯৩৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। শতাংশের হিসেবে যে হার ৫৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এ তথ্য জানানো হয়েছে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) এর বার্ষিক প্রতিবেদনে। তাদের তথ্য বলছে, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে কম্পিউটার ল্যাব রয়েছে ৯ হাজার ২৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে; যা দেশের মোট বিদ্যালয়ের ৪৩ দশমিক ছয় শতাংশ।

২০১০ সালে বর্তমান সরকার ঘোষণা দিয়েছিল ডিজিটাল বাংলাদেশের। একই বছরে নতুন শিক্ষানীতিও প্রণীত হয়েছিল দেশে। কিন্তু কম্পিউটার ল্যাবের অভাবেই দেশের মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৫৭ শতাংশ অর্থাৎ ৫৮ লাখ  ২ হাজার ১৯৯ জন শিক্ষার্থীকে হাতে-কলমে শেখানো যাচ্ছে না তথ্য-প্রযুক্তির আদ্যোপান্ত।

প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, দেশে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২০ হাজার ৯৬০টি। এরমধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান ৬৮৪টি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২০ হাজার ২৭৬টি। এসব প্রতিষ্ঠানে পাঠদানে কর্মরত আছেন ২ লাখ ৬৬ হাজার ৫৬৮ জন। পাশাপাশি দেশে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক কোটি এক লাখ ৯০ হাজার ২২জন। এদের মধ্যে ছাত্রী সংখ্যা ৫৫লাখ ৭১ হাজার ৩৪৮ জন।

দেশের সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কম্পিউটার ল্যাব সুবিধা পায় ৪৩ লাখ ৮৭ হাজার ৮২৩ জন এবং এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ৫৮ লাখ দুই হাজার ১৯৯ জন শিক্ষার্থী। আর বর্তমানে দেশে মাধ্যমিক (নবম ও দশম) পর্যায়ে শিক্ষার্থী রয়েছে মোট ৩৭ লক্ষ ৯৮ হাজার ৮শত ২৬ জন।

ব্যানবেইসের প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়েছে, গত এক বছরে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে কম্পিউটার ল্যাব বেড়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৮০ শতাংশ। যা ২০২০ সালে ছিল ৪২ দশমিক ২৬ শতাংশ। এর আগের বছরগুলোতে যা ছিল যথাক্রমে ২০১৯ সালে ৩১ দশমিক ২০ শতাংশ ও ২০১৮ সালে যা ছিল ৩০ দশমিক ৭৭ শতাংশ। সে হিসেবে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাড়ছে কম্পিউটার ল্যাবের সংখ্যা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রযুক্তিভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে বাধা হিসেবে কাজ করছে বড় সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব না থাকা। 

তাদের মতে, তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক জ্ঞান দুটোই সমান অপরিহার্য প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার ক্ষেত্রে। শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের মাধ্যমে তত্ত্বীয় বিষয়গুলো পড়ানো হলেও কম্পিউটার ল্যাব না থাকলে কোনোভাবেই পড়ানো বা শেখানো সম্ভব নয় ব্যবহারিক বিষয়গুলো। আর, দেশের ৫৭ শতাংশ শিক্ষার্থী সে জ্ঞান অর্জন ছাড়াই পাস করছে এবং উচ্চশিক্ষার জন্য আসছে। যার প্রভাব তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে পড়বে বলে আশংকা তাদের।

আরও পড়ুন: অপরিকল্পিত উচ্চশিক্ষা: মেধা আর অর্থ দুটোরই অপচয়

অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ ‘মাস্টার প্ল্যান ফর আইসিটি ইন এডুকেশন ইন বাংলাদেশ (২০১২-২১)-প্রগ্রেসিভ রিভিউ রিপোর্ট ২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তারা বলছে, দেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর ৪০৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কম্পিউটার ল্যাব আছে মোট ৪৬২টি। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশে কম্পিউটার ল্যাব নেই ৬০ শতাংশের বেশি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।

দেশের ১৫ হাজার ৭৫৪টি বেসরকারি বিদ্যালয়ের মধ্যে কম্পিউটার ল্যাব আছে মাত্র ৬ হাজার ১০৬টি প্রতিষ্ঠানে। এতে মাধ্যমিক স্তরে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষার্থী সরকারের হিসেবেই তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে বাস্তবিক জ্ঞান না নিয়েই বেড়ে উঠছে।  

জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছিল, দেশের শিক্ষার্থীদের তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষায় আন্তর্জাতিক মান ও গুণ সম্পন্ন শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির প্রচেষ্টা চালানো হবে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার মাধ্যমে। সেজন্য তথ্যপ্রযুক্তিকে শুধুমাত্র কম্পিউটার বিজ্ঞানের মাঝে সীমিত না রেখে মোবাইল ফোন, রেডিও, টেলিভিশন, নেটওয়ার্কিং কিংবা সকল তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করার জন্য শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখানো হবে প্রযুক্তিমাধ্যম। 

জাতীয় শিক্ষানীতিতে আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রবেশের আগেই সকল শিক্ষার্থীকে কম্পিউটার বিষয়ে শিক্ষিত করা হবে। একইসঙ্গে, বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ের সঙ্গে কম্পিউটার বিষয় নিয়ে পড়াশোনা সুযোগ করে দেয়া হবে। কিন্তু, তা কম্পিউটার ল্যাব না থাকা, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক না থাকাসহ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সম্ভব হচ্ছে না শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা।

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন চিন্তাবিদ ও জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিজ্ঞান শিক্ষায় হাতেকলমে শেখানোর ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ে বিজ্ঞানাগার থাকাটা অপরিহার্য। আমাদের কাছে বিভিন্ন বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানাগার না থাকার বিষয়টি একটি বড় সীমাবদ্ধতা। একইসঙ্গে বিজ্ঞানাগার আছে কিন্তু যন্ত্রপাতি ও উপকরণ নেই। এ সমস্যারও সমাধান করা দরকার।

তিনি মনে করেন, এতে শিক্ষায় বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি প্রচলিত শিক্ষায় সুবিধা না পাওয়া একজন শিক্ষার্থী শিক্ষিত হতে পারছে না পরিপূর্ণভাবে। তিনি বলেন, আমরা প্রচলিত শিক্ষায় প্রয়োজনভিত্তিক দক্ষ জনবল তৈরি করতে পারছি না। একজন শিক্ষার্থী কোনও কিছু না শিখতে পারলে সে অদক্ষ হয়ে বা না শিখে বড় হবে। যার প্রভাব তার পরবর্তী জীবন ও কর্মে পড়বে।

এই অর্থনীতিবিদের মতে, শিক্ষা এবং দক্ষতার সম্মিলন ঘটাতে হলে অবশ্যই আমাদের প্রযুক্তি শিক্ষার উপর জোর দিতে হবে। সেজন্য এ ধরনের বৈষম্য দূর করতে হবে- যুক্ত করেন ড. কাজী খলীকুজ্জমান।