সুইডেনে স্কলারশিপ পাওয়ার কিছু কৌশল
আধুনিক সময়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরে পড়তে যাওয়া খুব স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই নিজস্ব ফান্ডিং বা টিচিং বা রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্স নিয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে যান। কিন্তু ইউরোপে অ্যাসিস্ট্যান্সশিপ পাওয়া বেশ কঠিন আর নিজস্ব ফান্ডিংও সবার পক্ষে ম্যানেজ করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যাওয়াটা সবচেয়ে সুবিধাজনক। আর স্কলারশিপের জন্য সুইডেন হতে পারে পছন্দের দেশ।
গত এক দশক ধরে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্যও এই হাতিয়ারের যোগান দিয়ে যাচ্ছে ইউরোপের অন্যতম আধুনিক দেশ সুইডেন। ৯৯% শিক্ষার হারের দেশটি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্কলারশিপের সুযোগ দিচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশিও এই সুযোগ নিয়ে সুইডেনে পড়াশোনা করছে। পড়াশোনা শেষে শুধু সুইডেনে স্থায়ীভাবে চাকরির সুযোগ-ই নয়, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন শিল্পে দেশটির গ্রহণযোগ্যতা থাকায় অন্যান্য উন্নত দেশগুলোতেও ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠায় এর শিক্ষাগত সনদ যথেষ্ট কার্যকরী। তাই আজকের ফিচারে আলোচনা হবে সুইডেনে স্কলারশিপ পাওয়ার উপায় নিয়ে।
সুইডেনে উচ্চ শিক্ষার জন্য স্কলারশিপ
অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর তুলনায় সুইডেনে পড়ালেখার খরচ কম হলেও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তা অনেক বেশি। স্বভাবতই বাংলাদেশিদের জন্য সুইডেনে উচ্চশিক্ষার সেরা উপায় হলো স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যাওয়া
সুইডেন মূলত দুই ধরণের স্কলারশিপের সুযোগ দিয়ে থাকে।
১. বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে
২. সুইডিশ সরকার কর্তৃক প্রদানকৃত
আরও পড়ুন: ফুল-ফ্রি স্কলারশিপে পড়ুন তাইওয়ানে, মাসে দেবে ৯০ হাজার পর্যন্ত
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপটি দেয়া হয় শুধুমাত্র প্রতি সেমিস্টারের টিউশন ফি-এর ওপর। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে স্কলারশিপের ধরণ আলাদা আলাদা হয়। এখানে বাড়তি কোন সুবিধা থাকে না।
কিন্তু সরকারি স্কলারশিপে টিউশিন ফি-এর পাশাপাশি অন্যান্য সুবিধাদির মধ্যে মাসিক ভাতাও দেয়া হয়। এই স্কলারশিপটির নাম সুইডিশ ইন্সটিটিউট বা সংক্ষেপে এস আই স্কলারশিপ।
সুইডিশ সরকার কর্তৃক পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তিন বছরের স্নাতক এবং দুই বছরের স্নাতকোত্তর করার সুযোগ রয়েছে। তার মধ্যে ইংরেজি ভাষায় স্নাতকোত্তর প্রোগ্রাম সংখ্যা প্রায় নয়শত।
এস আই স্কলারশিপটি স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের জন্য। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা সর্বোচ্চ চারটি বিষয়ে স্নাতকোত্তরের জন্য আবেদন করতে পারেন। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য এস আই স্কলারশিপের সুবিধাগুলোর মধ্যে আছে।
→ সম্পূর্ণ ফ্রি টিউশন ফি
→ পুরো অধ্যয়নের সময়কাল জুড়ে জীবনযাত্রার খরচ বহনের জন্য প্রতি মাসে ১০ হাজার সুইডিশ ক্রোনা বা ১,০৯৫.৯৪ মার্কিন ডলার অর্থ
→ অসুস্থতা এবং দুর্ঘটনার জন্য বীমা
→ এস আই-এর নেটওয়ার্ক ফর ফিউচার গ্লোবাল লিডারস (এনএফজিএল)-এর সদস্যপদ
এটি সুইডেনে থাকাকালীন নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে শিক্ষার্থীর ক্যারিয়ার উন্নয়নে সাহায্য করবে।
→ স্কলারশিপের মেয়াদ শেষে শিক্ষার্থী এস আই অ্যালামনাই নেটওয়ার্কের সদস্য হবেন। এটি শিক্ষা পরবর্তী বিভিন্ন চাকরীসহ ক্যারিয়ারের অন্যান্য বিকাশে সহায়তা করবে। বর্তমানে নেটওয়ার্কটি ১৪০ টিরও বেশি দেশ থেকে ১৫ হাজারেরও বেশি প্রতিভাবান প্রাক্তন শিক্ষার্থী নিয়ে গঠিত।
→ সমগ্র অধ্যয়নের সময়ের মধ্যে ভ্রমণের জন্য এককালীন ১৫ হাজার সুইডিশ ক্রোনা বা ১,৬৪৩.৯১ মার্কিন ডলার অর্থ।
সুইডেনে স্কলারশিপ-এর জন্য যোগ্যতা
সুইডেনের ব্যাচেলর প্রোগ্রামগুলোর জন্য ১২ বছরের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং মাস্টার্স প্রোগ্রামের জন্য দেখাতে হয় ১৬ বছরের শিক্ষা যোগ্যতা। অন্যান্য দেশের স্কলারশিপগুলোর মত এখানেও স্কলারশিপের জন্য সিজিপিএ’র প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়।
স্নাতকের জন্য আইইএলটিএস স্কোর ৬ এবং স্নাতকোত্তরের জন্য ৬.৫ থাকা উত্তম। আইইএলটিএস ছাড়া ভর্তির আবেদনের ক্ষেত্রে শিক্ষার মিডিয়াম অফ ইন্ট্রাকশন অবশ্যই ইংরেজী হতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে, আইইএলটিএস ছাড়া আবেদন করা গেলেও ভিসা পাওয়ার সম্ভবনা কমে যায়। তাছাড়া পিএইচডি’র আবেদনকারীদের জন্য আইইএলটিএস দিয়ে আবেদন করা আবশ্যক।
এস আই স্কলারশিপের আবেদনের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি খেয়াল রাখা জরুরি তা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে ভর্তি নিশ্চিত হবার পরে আবেদন করতে হয় এই স্কলারশিপের জন্য। ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য আবেদন গ্রহণ চলবে ২০২২ এর ১০ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
এই স্কলারশিপে আবেদনের ক্ষেত্রে কাজের অভিজ্ঞতা দেখাতে হবে তিন হাজার কর্মঘণ্টা। এই সময়কে ফুলটাইম চাকরিতে পরিবর্তন করলে দাঁড়ায় প্রায় দেড় বছরের অভিজ্ঞতা।
আরও পড়ুন: কম খরচে নিউজিল্যান্ডে উচ্চশিক্ষা, রয়েছে নাগরিকত্ব লাভের সুযোগ
স্কলারশিপের জন্য আবেদন
সিজিপিএ’র জন্য সাধারণত ব্যাচেলর এবং মাস্টার্সের ট্রান্সক্রিপ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সত্যায়িত হার্ড কপি পাঠাতে হয়। এটি সরকারি ডাক বিভাগ বা ডিএইচএল এর মাধ্যমে পাঠানো যেতে পারে। এছাড়া স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপের ওয়েবসাইট অথবা এস আই স্কলারশিপের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যে ডকুমেন্ট্সগুলো আপলোড করতে হয় সেগুলো হলো-
১. আইইএলটিএস স্কোর
২. মোটিভেশন লেটার
৩. পাসপোর্টের কপি
৪. সিভি
৫. রেফারেন্স লেটার
যে বিষয়টি সুইডেনে স্কলারশিপ পাবার ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি তা হলো, বিশ্ববিদ্যালয় ও এস আই-এর স্কলারশিপ উভয় ক্ষেত্রে আবেদন প্রক্রিয়াগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাস্টার্স বা পিএইচডি’র ক্ষেত্রে ইন্টারভিউয়ের জন্য সঠিক প্রস্তুতি প্রয়োজন। আর এস আই-এর ক্ষেত্রে কোন ইন্টারভিউ হয় না তাই এক্ষেত্রে সিভি, রেফারেন্স এবং মোটিভেশন লেটার ডকুমেন্টগুলো তৈরির ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যতা বজায় রাখার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
এসআই স্কলারশিপের বিস্তারিত
সুইডেনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় রয়েছে ইংরেজি ভাষায় প্রায় ৯০০ স্নাতকোত্তর প্রোগ্রাম। এসআই স্কলারশিপে আবেদনের জন্য প্রথমে সুইডেনে মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তির আবেদন করতে হবে। প্রায় সব বিষয়েই ভর্তির আবেদন করতে পারবেন। এ জন্য লাগবে ব্যাচেলর ডিগ্রি এবং আইইএলটিএস। একটি অ্যাপ্লিকেশনে চারটি বিষয়ে ভর্তির জন্য আবেদন করতে পারবেন। আপনার পছন্দের কোর্স এবং এ–সংক্রান্ত সব তথ্য খুঁজে পাবেন www.universityadmissions.se সাইটে। এসআই স্কলারশিপে আবেদনের জন্য বাড়তি হিসেবে লাগবে তিন হাজার কর্মঘণ্টা কাজের অভিজ্ঞতা, ফুলটাইম কাজ করলে যা প্রায় দেড় বছরের কাজের অভিজ্ঞতার সমতুল্য। এসআই স্কলারশিপপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে অনেক সুযোগ-সুবিধা। স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামের পুরো টিউশন ফির পাশাপাশি প্রতি মাসে পাওয়া যাবে ১০ হাজার সুইডিশ ক্রোনার বা ১ হাজার ২০০ মার্কিন ডলার। রয়েছে এককালীন ১৫ হাজার ক্রোনারের ভ্রমণ অনুদান এবং স্বাস্থ্যবিমা, ভিসা ফিসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণের সুযোগ। সঙ্গে পাবেন নেটওয়ার্ক ফর ফিউচার লিডার্সের মেম্বারশিপ, যা আপনাকে শক্তিশালী একটি নেটওয়ার্ক গঠন করার সুযোগ করে দেবে।
সুইডেনে স্কলারশিপে গুরুত্ব সিজিপিএর
এসআই স্কলারশিপ ছাড়াও সুইডেনের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় নন-ইউরোপিয়ান ছাত্র-ছাত্রীদের আলাদাভাবে স্কলারশিপ দিয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ বৃত্তি সাধারণত টিউশন ফি বহন করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি পেলে বিশাল অঙ্কের টিউশন ফি দেওয়া লাগবে না, যা একটা বড় প্রাপ্তি। যেহেতু টিউশন ফির চিন্তা নেই, সে ক্ষেত্রে শুরুতেই থাকা-খাওয়া বাবদ কয়েক মাসের টাকা সঙ্গে করে নিয়ে এলে পরবর্তী সময়ে একটা খণ্ডকালীন কাজ জোগাড় করে মাসিক খরচ চালিয়ে নেওয়া সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপের জন্য সাধারণত আপনার সিজিপিএর ওপরই সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়।
বৃত্তির জন্য কী কী দরকার
একটা বিষয় মাথায় রাখবেন, এসআই স্কলারশিপের জন্য আপনার কোনো পরীক্ষা বা ইন্টারভিউ দিতে হবে না। তাই আপনি যে ডকুমেন্টগুলো পাঠাবেন (সিভি, মোটিভেশন, রেফারেন্স ইত্যাদি), সেগুলোর কনটেন্ট এবং প্রেজেন্টেশন হতে হবে প্রথম শ্রেণির। আমার মতে, নিচের ফ্যাক্টরগুলো আপনাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তুলে ধরতে পারে।
১. Relevance of Track
পড়াশোনা, কাজ এবং মাস্টার্সের সাবজেক্ট চয়েসের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করা। হতে পারে আপনি এক সাবজেক্টে অনার্স করেছেন, অন্য বিষয় নিয়ে কাজ করছেন, সে ক্ষেত্রে মোটিভেশন লেটারে এগুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।
২. Motivation and Connection With the UN Sustainable Development Goals
এই পার্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখবেন, অথরিটি অবশ্যই মোটিভেটেড ক্যান্ডিডেট খুঁজবে। কিন্তু আপনার মোটিভেশন হতে হবে আপনার দেশ বা রিজিওনের উন্নয়নের জন্য এবং তা অবশ্যই এক বা একাধিক জাতিসংঘের (ইউএন) সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। আমার উপদেশ হলো ইউএনের সাইটে গিয়ে গোলগুলো অ্যানালাইসিস করুন এবং আপনার পড়াশোনা ও কাজের সঙ্গে রিলেটেড গোলগুলো খুঁজে বের করুন।
৩. Reference and CV
রেফারেন্স লেটার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চেষ্টা করবেন একটা লেটার নেটওয়ার্ক বা সোশ্যাল এনগেজমেন্ট থেকে নিতে। এটা আপনাকে ডিরেক্ট অ্যাডভান্টেজ দেবে। সিভি লেখার সময় ওয়ার্ক এক্সপেরিয়েন্স আর সোশ্যাল এনগেজমেন্ট সেকশনে বেশি গুরুত্ব দেবেন। খেয়াল রাখবেন রেফারেন্স ও সিভি যেন আপনার মোটিভেশনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
৪. Subject Choice
চেষ্টা করবেন ইউনিভার্সিটিতে আবেদন করার সময় একই ধরনের সাবজেক্ট চয়েজ করতে। এটা প্রমাণ করে আপনি জানেন যে আপনি কী করতে চান এবং আপনি হাইলি মোটিভেটেড।
৫. Be Realistic
মোটিভেশন লেটার লেখার সময় দুনিয়া উদ্ধারের প্ল্যান দেবেন না। আপনার প্ল্যান যেন বাস্তবসম্মত হয় এবং বিশেষ করে আপনার দেশ আর রিজিওনের উন্নয়ন যেন আপনার প্রধান উদ্দেশ্য হয়।
৬. Compatibility of Documents
আপনাকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে আপনার সব ডকুমেন্টস সামঞ্জস্যপূর্ণ। আপনার সব ডকুমেন্টস যেন আপনার মোটিভেশনকে সাপোর্ট করে।