নরওয়েতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের বিনাখরচে পড়ার সুযোগ
নিশীথ সূর্যের দেশ নামে পরিচিত স্কান্ডিনেভিয়ান একটি দেশ নরওয়ে। ইউরোপের ৪ টি নর্ডিক দেশের মধ্য অন্যতম নরওয়ে বিশ্বের শান্তির সূচকে আছে এক নম্বরে। এদেশের জীবন যাত্রার খরচ একটু বেশি হলেও অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত নরওয়েতে রয়েছে ভবিষ্যত গড়ার অপার সম্ভবনা। কারণ, বিজ্ঞান- প্রযুক্তি-শিক্ষার দিক দিয়ে বিশ্বে এ দেশের জুড়ি মেলা ভার। এই দেশের রাজধানী অসলো, ভাষা নরওয়েজিয়ান আর মুদ্রা নরওয়েজিয়ান ক্রোনা।
কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বাদে নরওয়ের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার খরচ একদম ফ্রি। প্রতি সেমিস্টারের শুরুতে যে রেজিস্ট্রেশন ফি দেওয়া লাগে তা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাড়ে তিন থেকে সাত হাজারের মতো।
স্কলারশিপের কোটা প্রকল্প বর্তমানে না থাকলেও, বিদেশি মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে স্নাতকোত্তরের সুবিধা রেখেছে নিশীথ সূর্যের দেশ নরওয়েজিয়ান সরকার। অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাও অধ্যয়নের সুযোগ নিতে পারবে।
নরওয়ের বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশ্বের সবচেয়ে চাহিদাপূর্ণ বিষয়গুলোতে দুই বছর মেয়াদী মাস্টার্স করার সুযোগ আছে। এর জন্য নরওয়ের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব ওয়েবসাইট থেকে যাবতীয় তথ্য পাওয়া যাবে।
আরও পড়ুন: আইইএলটিএস ছাড়াই মালয়েশিয়াতে পড়ার সুযোগ
তবে সমস্যা হলো- অন্যান্য দেশগুলোর মত এখানে শুধু ব্যাংক সল্ভেন্সি দেখালেই হয় না। ভিসা হওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার লেটার পাবার পর পরই বিশ্ববিদ্যালয়র একাউন্টে প্রায় ১২ লাখ টাকা পাঠাতে হয়। নরওয়েতে এক বছরের শিক্ষার্থীর থাকার খরচ বাবদ অগ্রিম এই টাকাটা নেওয়া হয়। এটা আসলে কোনো ব্যাংক সলভেন্সি দেখানো না বা কোনো ব্লক্ড একাউন্ট না।
জার্মানির ক্ষেত্রে যেটা হয়- বিশ্ববিদ্যালয়র একাউন্টে টাকা পাঠানোর পর সেই টাকা ১২ মাসে ভেঙে ভেঙে ফেরত দেওয়া হয়। আর নরওয়েজিয়ান ইউনির্ভাসিটিগুলো টাকাটা একবারেই দিয়ে দেয়। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে নরওয়েতে যাওয়ার পর নিজের একটি ব্যাংক একাউন্ট খুলতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় সর্বোচ্চ এক মাসের মধ্যে সেই ১২ লাখ টাকা শিক্ষার্থীর ব্যাংক একাউন্টে ফেরত দিয়ে দেয়। এই বিষয়গুলো পরিকল্পনার সময় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।
নরওয়েতে পড়ার ন্যূনতম যোগ্যতা
নরওয়েতে পড়ার জন্য একাডেমিক পরীক্ষায় কমপক্ষে আপনাকে ৬০% নম্বর পেতে হবে। আপনি যদি যেতে চান ব্যাচেলর ডিগ্রীর জন্য তাহলে আপনাকে HSC + ১ বছর বাংলাদেশি যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে হবে। অন্যদিকে মাস্টার্স করতে আগ্রহী প্রার্থীদের অব্যশই ৩ বছরের ব্যাচেলর কোর্স কমপ্লিট থাকতে হবে। পক্ষান্তরে ২ বছরের মাস্টার্স কোর্স বাধ্যতামুলক যদি আপনি পিএইচডি কোর্সে পড়তে যেতে চান।
নরওয়েতে আপনি পেয়ে যাবেন বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে মোট ৯ টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও এর অধীনে রয়েছে ১৫০টির মত কলেজ এবং ২ টি পাবলিক আর্টস ইন্সটিটিউট।
কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়-
University of Oslo
Norwegian University of Science & Technology
University of Bergen
University of Stavanger
আইইএলটিএস
সাধারণত এ দেশে পড়তে আপনাকে IELTS এ তুলতে হবে কমপক্ষে ৬.০ স্কোর। আর মাস্টার্স প্রোগ্রামে যেতে তুলতে হবে ৬.৫ – তবেই আপনি Safe Zone এ থাকবেন। সুতরাং পরিকল্পনার পর নরওয়েতে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতির জন্য করণীয় হিসেবে প্রথম কাজ হলো আইইএলটিএস দেওয়া। নরওয়েতে পরিবার নিয়েও যাওয়া যায়। সেক্ষত্রে আবেদনকারীর আইইএলটিএস হলেই হবে। পরিবারের আর কারও লাগবে না।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
এসএসসি, এইচএসসির ও নূন্যতম তিন বছরের স্নাতক ডিগ্রির সনদ ও ট্রান্সক্রিপ্ট। (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরাও আবেদন করতে পারবেন। স্টাডি গ্যাপ সর্বোচ্চ চার বছর গ্রহণযোগ্য)। পাসপোর্ট। আইইএলটিএস সনদ। স্টাডি প্ল্যানসহ মোটিভেশন লেটার। দুটি রিকমেন্ডেশন লেটার (যে বিষয়ে নরওয়েতে পড়তে যাওয়া হচ্ছে সে বিষয়ের ওপর অধ্যাপকের কাছ থেকে একটি, আর আরেকটি ব্যাচেলর করা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টের ডিনের কাছ থেকে)। ব্যাংক সলভেন্সি পেপার।
সেমিস্টার ফি / টিউশন ফি
নরওয়েতে সাধারণত কোন টিউশন ফি লাগে না। তবে আপনাকে সেমিস্টার ফি দিতে হবে এবং তা হল প্রায় ৩০০ থেকে ৬০০ নরওয়েজিয়ান ক্রোনা। তবে, কিছু প্রোগ্রাম বা কোর্সের ক্ষেত্রে এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে টিউশন ফি নেওয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে প্রতি সেমিস্টারে ৫১-১০১ মার্কিন ডলার ফি খরচ হয়।
কোর্স বাছাই
নরওয়েতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ইংরেজী কোর্স অফার করা হয়। তাই, আপনি আগে থেকে দেশের জব মার্কেট, আর যদি নরওয়েতেই থাকতে চান তাহলে সে দেশের জব মার্কেট বুঝে সাবজেক্ট বাছাই করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
আরও পড়ুন: রাশিয়ায় পড়তে যেতে লাগবে না আইইএলটিএস, ব্যাংক বিবরণী
যেসব বিষয়ে পড়া যায়: এডুকেশন, অডিওলজি, আর্লি চাইল্ডহুড এডুকেশন, লাইব্রেরি সায়েন্স, বায়োটেকনোলজি, অকুপেশনাল থেরাপি প্রোগ্রাম, ফুড সায়েন্স, স্পেশালাইজড টিচার এডুকেশন, ফার্মাসি, ফিশারিজ, ফিজিওথেরাপি, হিউম্যানিটিজ, ইঞ্জিনিয়ারিং, জার্নালিজম, ল, আর্ট অ্যান্ড ডিজাইন, অ্যাগ্রিকালচার সায়েন্স, মেরিটাইম সায়েন্স, মেডিকেল সায়েন্স, ডেনটিস্ট্রি, অর্থোপেডিকস, রেডিওলজি, ন্যাচারাল সায়েন্স, সোশ্যাল সায়েন্স, আর্কিটেকচার, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, বিজনেস স্টাডিজ, ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স, সোশ্যাল ওয়ার্ক প্রোগ্রাম, নার্সিং, থিওলজি, ভেটেরিনারি মেডিসিন, ম্যাথমেটিকস, বিবিএ, এমবিএ ইত্যাদি।
আবেদন
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা স্টাডি ইন নরওয়ে ওয়েবসাইটে ভিজিট করে খুব সহজেই আবেদন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে পারবেন। এই সাইটের মাধ্যমে আলাদা আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়তে নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর আবেদনের ব্যবস্থা রয়েছে। নিজের কাঙ্ক্ষিত বিষয়টির পাশে দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়র নামের ওপর ক্লিক করে বিশ্ববিদ্যালয়তে আবেদনের পেইজে প্রবেশ করা যাবে। অতঃপর এই অনলাইন আবেদনে যা যা নথি চাওয়া হবে সেগুলো সব আপলোড করে সংযুক্তি হিসেবে দিতে হবে। এই প্রক্রিয়াতে কোথাও কোনো ধরনের ফি প্রয়োজন হবে না।
প্রতি বছরের আগস্টে সেশন শুরু হয়। আর এই সেশন ধরার জন্য আবেদন করতে হয় ঠিক তার এক বছর আগে সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে। যদিও এটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ভিন্নতা আনে, তাই আপনাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েব সাইটে গিয়ে সঠিক ভাবে তথ্য উপাত্ত ঘেটে দেখতে হবে। আবেদনের পর সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আবেদনকারীকে একটা কনফারমেশন মেইল দেওয়া হবে। এ সময় অতিরিক্ত কোনো কাগজ লাগলে সেটা মেইল করে জানানো হবে।
ভিসার আবেদন
আবেদন প্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর ফলাফল আসবে পরের বছরের মার্চের শেষ নাগাদ কিংবা এপ্রিলের শুরুর দিকে। ঠিক এই সময়েই ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে। অফার লেটার পাওয়ার পর আবেদনের সময় জমা দেওয়া কাগজপত্রগুলো এবার অ্যাটাস্টেড করে গুলশানের ভিএফএস (ভিসা ফ্যাসিলিটেশন সার্ভিস) গ্লোবালে জমা দিতে হবে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়র দেওয়া একাউন্টে ১২ লাখ টাকা পাঠিয়ে দিতে হবে। এই টাকা পাঠানোর কনফারমেশন পেপারও সেই ভিএফএস গ্লোবালে অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হয়।
এখানে দরকারি কাগজপত্রগুলোর সঙ্গে পূর্ণ পূরণকৃত ভিসা আবেদন ফর্ম, শেঞ্জেন ফরমেটের (৩৫ মিলিমিটার বাই ৪৫ মিলিমিটার) ছবি, স্টেটমেন্ট অব পার্পাস, কভার লেটার, অ্যাম্বেসির মনোনীত প্রতিষ্ঠান থেকে হেলথ ইনসুরেন্স সনদ এবং পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সনদ অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। ভিসার যাবতীয় প্রক্রিয়ার জন্য সর্বোচ্চ ৬২ হাজার টাকা খরচ হবে। সবকিছু পাওয়ার পর ভিএফএসের পক্ষ থেকে ছোট্ট একটা ইন্টারভিউ নেওয়া হবে। ইন্টারভিউয়ের ১২ থেকে ১৪ কার্যদিবস পর কাঙ্ক্ষিত সেই নরওয়ে যাবার ভিসা হাতে পাওয়া যাবে।
নরওয়েতে ভিসা এপ্লিকেশনের জন্য যে ইন্সুরেন্স লাগে, তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দিয়ে দেয়। সঠিক তথ্যের জন্য চেকলিস্ট এম্বেসী ওয়েবসাইটে দেখে নিতে হবে
https://www.norway.no/en/bangladesh/
স্কলারশিপ পাওয়ার সুযোগ
বর্তমানে নরওয়েতে বাংলাদেশিদের জন্য কোন কোটা ভিত্তিক স্কলারশিপ নেই। তবে চিন্তিত হবার কোন কারণ নেই- এছাড়াও এখানে রয়েছে অনেক ধরণের স্কলারশিপ। স্কলারশিপ পেতে এই লিংকে আবেদন করতে পারেন।
https://www.studyinnorway.no/study-in-norway/find-available-scholarships-and-grants
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা আলাদা স্কলারশিপ রয়েছে। যদি আপনি স্কলারশিপ পেয়ে যান, তাহলে থাকা-খাওয়া থেকে শুরু করে সব ধরণের খরচের জন্য থাকবে অর্থ বরাদ্দ।
পার্ট টাইম জব এবং লিভিং এক্সপেন্স
নরওয়েতে থাকা খাওয়ার খরচ তুলনামূলক ভাবে বেশি। এখানে প্রায় ৪০০-৮০০ ইউরো গুনতে হবে এই খাতে। এখানে, ক্যাফে, বার, সামার জব, সিজোনাল জব, ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টর, হেলথ সেক্টর, ফিশিং সেক্টর, সোপ, ক্লিনার, ম্যানেজমেন্ট, কম্পিউটিং, এনজিও, সেলস, কল সেন্টার, ট্রাভেল, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদিতে কাজ করে ঘণ্টায় ৭-২২ মার্কিন ডলার আয় করা যায়।
হ্যা- আপনি নরওয়েতে গিয়ে পার্ট টাইম জবের সুযোগ পাবেন- তবে সেটা সপ্তাহে ২০ ঘন্টার বেশি নয়। তবে সামার ভ্যাকেশনে আপনি চাইলে ফুল টাইম জব করতে পারবেন। নরওয়েজিয়ান ভাষা জানা না থাকলে জব পেতে খুব কষ্ট হবে। তাই দেশ ছাড়ার আগে নরওয়েজিয়ান ভাষা শিখে যাওয়াই উত্তম।
নরওয়ের নাগরিকত্ব
নরওয়ের পিআর (পার্মানেন্ট রেসিডেন্স) ব্যবস্থা বেশ সহজ। দুবছর অধ্যয়নের পর যে বিষয়ে মাস্টার্স করা হয়েছে সে বিষয়ের ওপর কোনো চাকরি করতে পারলেই পিআর নিশ্চিত। তিন বছর মেয়াদী পিএইচডি করা অবস্থাতেও এই পিআর পাওয়া যায়। কারণ নরওয়েতে পিএইচডি”কে চাকরি হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। তার মানে পিআর-এ কোনো অনিশ্চয়তা নেই।