সুইডেনে উচ্চশিক্ষা: প্রয়োজনীয় তথ্য ও নির্দেশনা
সুইডেন।আ তনে উত্তর ইউরোপের বৃহত্তম, ইউরোপীয় ইউনিয়নের তৃতীয় বৃহত্তম এবং অঞ্চল অনুসারে ইউরোপের পঞ্চম বৃহত্তম দেশ। জনসংখ্যা প্রায় দশ মিলিয়ন। মাথাপিছু জিডিপি ৪৫ হাজার ইউরো। কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের যে সমস্ত দেশে গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার এবং আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত; সুইডেন তাদের অন্যতম।
ওয়ার্ল্ড রুল অব ইনডেক্স ২০২০, ডেমোক্রেসি ইনডেক্স ২০১৯ এবং করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স ২০১৯ অনুসারে সুইডেন বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি দেশের অন্তর্ভুক্ত। বসবাস ও উচ্চশিক্ষার জন্য সুইডেন একটি উন্নত, আধুনিক এবং প্রযুক্তি নির্ভর রাষ্ট্র। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের জন্য সুইডেন খুব নিরাপদ দেশ। সাম্প্রতিক প্রকাশিত সিইও ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন অনুসারে সুইডেন নারীদের জন্য বিশ্বের সর্বোত্তম দেশ।
এবার আসি সুইডেনের উচ্চশিক্ষা প্রসঙ্গে। সুইডেন তার জিডিপির প্রায় ৩.৪% ব্যয় করে গবেষণা এবং উদ্ভাবনে; যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। সুইডেনে রয়েছে ১৪টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এবং একাধিক স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দেশটির প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে ৫৪৩ বছরের পুরানো উপসালা ইউনিভার্সিটি এবং ৩৫৪ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত লুন্ড ইউনিভার্সিটি। এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বিশ্বের সেরা একশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় রয়েছে একাধিক সুইডিশ বিশ্ববিদ্যালয়।
সুইডেনের সরকারি ভাষা হচ্ছে সুইডিশ। প্রধান বিদেশি ভাষা হলো ইংরেজি। বিদেশি ভাষা হিসেবে ইংরেজির সর্বাধিক ব্যবহারের দিক থেকে বিশ্বে নেদারল্যান্ডসের পরেই সুইডেনের অবস্থান। স্নাতকোত্তর স্তরের প্রায় বেশির ভাগ বিষয়ই ইংরেজিতে পড়ানো হয়। বিদেশী শিক্ষার্থীর জন্য সুইডেনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে রয়েছে ইংরেজি ভাষায় প্রায় নয়শ স্নাতকোত্তর প্রোগ্রাম। দেশ হিসেবেও সুইডেনকে ট্রুলি ইন্টারন্যাশনাল বলা হয়। এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, একজন বিদেশি শিক্ষার্থী ইংরেজি ভাষায় পড়াশোনার পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনের কথোপকথন সাবলীলভাবে চালিয়ে নিতে পারেন। এক্ষেত্রে কোন ধরনের ভাষাগত সমস্যায় পড়তে হয় না। তবে চাকরির ক্ষেত্রে এই চিত্র কিছুটা ভিন্ন। পড়াশোনা শেষে কারো যদি সুইডেনে দীর্ঘমেয়াদী কর্মজীবনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা নির্দিষ্ট পেশাগত লক্ষ্য থাকে, তবে সুইডিশ ভাষা জানা থাকলে তা বিশালভাবে উপকৃত করবে। এছাড়াও ভাষাগত দক্ষতা একজন ভিনদেশি শিক্ষার্থীকে সুইডিশ সমাজে সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে একীকরণে সাহায্য করে।
সুইডিশ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে মূলত অটাম এবং স্প্রিং সেমিস্টারে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করানো হয়। তবে আবেদন প্রক্রিয়া, সাক্ষাৎকার, ভিসা (সুইডিশ রেসিডেন্স পারমিট) এবং ভর্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন ধাপে পর্যাপ্ত সময় লাগে বিধায় নন-ইউরোপিয়ান শিক্ষার্থীরা সাধারণত অটাম সেমিস্টারেই ভর্তি হয়। ১৬ অক্টোবর ২০২০ থেকে অটাম ২০২১ সেমিস্টারের প্রথম রাউন্ডের ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অনলাইনে আবেদনের সময়সীমা ১৫ জানুয়ারি ২০২১। আবেদন ফি (৯০০ সুইডিশ ক্রোনার) জমা দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আপলোড করার সময়সীমা ১ ফেব্রুয়ারি ২০২১।
ভর্তির জন্য সুইডিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদাকরে আবেদন করতে হয় না। হাতেগোনা কয়েকটি প্রোগ্রাম ব্যতীত সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ভর্তি পোর্টালের মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। সুইডিশ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ভর্তি প্রক্রিয়া ওয়েবভিত্তিক সমন্বিত পদ্ধতিতে হওয়ার ফলে, চেষ্টা আর ন্যুনতম যোগ্যতা থাকলে কারো সাহায্য ছাড়াই নির্ভুলভাবে আবেদন করা সম্ভব। সুইডিশ হায়ার এডুকেশন কাউন্সিল এ বছর ভর্তি পোর্টাল নতুনভাবে সাজিয়েছে, যার ফলে আবেদন প্রক্রিয়া আরও সহজ হয়েছে।
স্নাতকোত্তর পর্যায়ে একজন আবেদনকারী সর্বোচ্চ চারটি বিষয়ে আবেদন করতে পারেন। এটি হতে পারে এক বা একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবেদনকৃত বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ক্রমানুসারে সাজাতে হয়, যা ভর্তির ক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আবেদনকারী তাঁর পছন্দের তালিকায় থাকা প্রথম বিষয়ের জন্য নির্বাচিত হলে বাকি বিষয়গুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যলয়ের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রতিটি বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া থাকে, যা প্রতিবছর হালনাগাদ হয়।
ভর্তির জন্য বিষয়ভিত্তিক বেশকিছু শর্ত (স্নাতক ডিগ্রি এবং প্রযোয্য ক্ষেত্রে মোটিভেশন লেটার/স্টেটমেন্ট অব পারপাস, রেফারেন্স লেটারস, সিভি, ইত্যাদি) পূরণের পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাগত যোগ্যতা, যেমন- ন্যুনতম আইইএলটিএস বা টোফেল স্কোরের বলা থাকে। সুইডিশ অ্যাডমিশন সাইটে দেশভিত্তিক কিছু আলাদা ভর্তিশর্ত উল্লেখ থাকে, যেগুলোর প্রতিটি অংশ একজন আবেদনকারী গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আবেদনকারীকে তাঁর স্নাতকের ট্রান্সক্রিপ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সত্যায়িত করে সুইডেনে বাধ্যতামূলক কুরিয়ার করতে হয়। পাশাপাশি স্নাতক ডিগ্রির সনদ, ইংরেজি ভাষাগত দক্ষতা সনদ এবং পাসপোর্টের স্ক্যান করা কপিসহ বিষয়ভিত্তিক ভর্তি শর্তানুসারে অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র অ্যাডমিশন সাইটে তৈরি নিজস্ব প্রোফাইলে আপলোড করতে হয়।
সুইডিশ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে সাধারণত অধিকাংশ স্নাতকোত্তর প্রোগ্রাম দুই বছরের হলেও বেশি কিছু এক বছরের প্রোগ্রাম রয়েছে। তবে বিশেষ উদ্দেশ্য বা নির্দিষ্ট কারণ ব্যতীত এক বছরের স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামে ভর্তি না হওয়াই ভালো। মাথায় রাখবেন, এক বছরের স্নাতকোত্তরে ভর্তি হয়ে সুইডেনে আসার পর বেশকিছু অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। সময় স্বল্পতার কারণে এক বছরের প্রোগ্রামের অভিসন্দর্ভ (থিসিস) অপেক্ষাকৃত ছোট এবং সীমিত। গবেষণার সময় ও সুযোগ কম থাকায় ভবিষ্যতে উচ্চতর গবেষণার (পিএইচডি) ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। আর এক বছরের প্রোগ্রামে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যবীমা থাকে না বিধায়, শিক্ষার্থী নিজেকেই তা ব্যবস্থা করতে হয়। সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো, এক বছরের স্নাতকোত্তরে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের রেসিডেন্স পারমিটের মেয়াদ তেরো মাসের কম হওয়ায় তাঁরা সুইডিশ পারসন নাম্বার পায় না। যার ফলে ব্যাংক হিসাব খোলা এবং খন্ডকালীন চাকরিসহ (হোয়াইট জব) অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে নানাবিধ ঝামেলা পোহাতে হয়।
পূর্বে সুইডেনে সবার জন্য অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু থাকলেও ২০১১ সালের অটাম সেমিস্টার থেকে নন-ইউরোপিয়ান ছাত্র-ছাত্রীদের উপর টিউশন আরোপ করা হয়। বিষয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে টিউশন ফির পরিমাণগত পার্থক্য আছে। একজন শিক্ষার্থীকে দুই বছরের একটি স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামের জন্য প্রায় আঠারো থেকে ত্রিশ লাখ টাকা বহন করতে হয়। তবে সুইডেনে উচ্চশিক্ষার জন্য রয়েছে বিভিন্ন বৃত্তির ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সুইডিশ গ্লোবাল প্রফেশনাল স্কলারশিপ, যা সংক্ষেপে এসআই স্কলারশিপ নামে সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে পরিচিত। এটি মূলত সুইডিশ ইনস্টিটিউট দ্বারা পরিচালিত সুইডিশ সরকারের শিক্ষাবৃত্তি। এ শিক্ষাবৃত্তি কর্মসূচির প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে জাতিসংঘের বৈশ্বিক লক্ষ্যসমূহে (এজেন্ডা ২০৩০) অবদান রাখার জন্য ভবিষ্যত নেতাদের বিকাশ সাধন।
এ বছর বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিয়াল্লিশটি অনুন্নত/উন্নয়নশীল দেশের ছাত্র-ছাত্রীরা এসআই স্কলারশিপের জন্য আবেদন করতে পারবে। আবেদন প্রক্রিয়া চলবে ৮-১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত। ফলাফল ঘোষণা হবে ২৮ এপ্রিল ২০২১। বেশ প্রতিযোগিতামূলক হওয়ায় আবেদনকারীদের মধ্যে মাত্র ৪-৬% কে এই বৃত্তি প্রদান করা হয়। দেশভেদে কোন কোটা না থাকলেও বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর সাধারণত ১৫-২০ জন এসআই স্কলারশিপ পেয়ে থাকেন।
এসআই স্কলারশিপ প্রাপ্তদের জন্য রয়েছে অনেক সুযোগ-সুবিধা। স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামের পুরো টিউশন ফি মওকুফের পাশাপাশি প্রতিমাসে থাকছে দশ হাজার সুইডিশ ক্রোনার। রয়েছে এককালীন পনেরো হাজার ক্রোনারের ভ্রমণ অনুদান এবং স্বাস্থ্য বীমাসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণের সুযোগ। এ বৃত্তির জন্য আবেদন করার সময় যেসব অত্যাবশ্যকীয় কাগজপত্র আপলোড করতে হয়, তা হলো- এসআই ইনস্টিটিউটের নির্দিষ্ট ফরম্যাটে মোটিভেশন লেটার, তিন হাজার কর্মঘন্টা কাজের অভিজ্ঞতা ও নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা সনদ, দুইটি রেফারেন্স লেটার, পাসপোর্টের স্ক্যান কপি এবং ইউরোপাস ফরম্যাটে সিভি।
এসআই স্কলারশিপ ছাড়াও সুইডেনের প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় নন-ইউরোপীয়ান ছাত্র-ছাত্রীদের আলাদাভাবে বৃত্তি দিয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ বৃত্তি মূলত ২৫-১০০% টিউশন ফি বহন করে থাকে। এছাড়া প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন এবং স্টুডেন্ট নেশন্স বিভিন্ন শিক্ষাবৃত্তি ও আর্থিক অনুদান দিয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি পেলে বিশাল অংকের টিউশন ফি দেয়া লাগবে না, যা একটা বড় প্রাপ্তি। যেহেতু টিউশন ফির চাপ নাই, সেক্ষেত্রে শুরুতেই থাকা-খাওয়া বাবদ কয়েক মাসের টাকা সাথে করে নিয়ে আসলে পরবর্তীতে একটা খন্ডকালীন কাজ জোগাড় করে মাসিক খরচ চালিয়ে নেয়া সম্ভব। তবে কাজের ক্ষেত্রে সুইডিশ ভাষা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
কারো যদি নিজের বা পরিবারের টাকা থাকে, টিউশন ফি এবং মাসিক খরচ নিয়ে কোন চিন্তা করা না লাগে; তাহলে অর্থ ব্যয় করে সুইডেনে পড়তে আসার সিদ্ধান্ত ভুল হবে না। সুইডেন খুব উন্নত দেশ, নিরাপদ দেশ এবং আধুনিক এদের শিক্ষাব্যবস্থা। আর সুইডিশ ডিগ্রির রয়েছে অত্যন্ত সুনাম ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা। যারা এ বছর বিভিন্ন সুইডিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করার কথা ভাবছেন, সবার জন্য রইলো শুভ কামনা।
সুইডেনের উচ্চশিক্ষা,শিক্ষাবৃত্তি, ভিসা ও বিভিন্ন ব্যবহারিক তথ্য জানতে নিচের ওয়েব লিংকগুলো অনুসরণ করুন-
১) ভর্তি (https://www.universityadmissions.se/intl/start)
২) এসআই স্কলারশিপ (https://si.se/en/apply/scholarships/)
৩) ভিসা/রেসিডেন্স পারমিট (https://www.migrationsverket.se/)
৪) বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের ফেসবুক গ্রুপ-Bangladeshi Incoming Students in Sweden (BISS)
লেখক: লুন্ড ইউনিভার্সিটি, সুইডেন