১০ মাস বন্ধ ডাচ-বাংলার শিক্ষাবৃত্তি, সঙ্কটে ১৫ হাজার শিক্ষার্থী
যেকোনো সমাজ বা জনগোষ্ঠিকে এগিয়ে নিতে হলে প্রয়োজন অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন। সমাজের সকল মানুষকে একটি প্রত্যাশিত ছন্দে এগিয়ে নিতে হলে সক্ষম ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হয়। সেই লক্ষ্যে প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্তের দরিদ্র, অসচ্ছল, মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করে দেশের বেসরকারি ব্যাংকসহ নানান আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক (করপোরেট সোস্যাল রেসপনসিবিলিটি- সিএসআর) কার্যক্রমের অধীনে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন পর্যায়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করে। তাদের মধ্যে বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বিবেচনায় অনন্য ডাচ বাংলা ব্যাংক ফাউন্ডেশন (ডিবিবিএফ)।
অসচ্ছল-মেধাবী শিক্ষার্থীদের ‘স্বপ্ন পূরণের সেতুবন্ধন’ ডাচ-বাংলা ব্যাংক তার শিক্ষাবৃত্তি কর্মসূচির আওতায় দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করে আসছে। ধারাবাহিকভাবে স্বচ্ছতার সাথে এই কার্যক্রম পরিচালনা করায় ইতোমধ্যে সকল মহলের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সিএসআরের অধীনের এই উপবৃত্তিটি। তবে করোনা প্রকোপ শুরুর পর থেকে বন্ধ রয়েছে তাদের এই কার্যক্রম। ফলে বিপাকে পড়েছেন বৃত্তির আওতায় থাকা অন্তত ১৫ হাজার শিক্ষার্থী। সেই সাথে নানা মাধ্যমে সমালোচিত হচ্ছে ব্যাংকটির শিক্ষাবান্ধব এই কার্যক্রম।
তথ্যমতে, এসএসসি পরীক্ষায় মেধার সাক্ষর রাখা শিক্ষার্থীদের মাসিক ভিত্তিতে দুই হাজার টাকা করে ২৪ মাস বৃত্তি দিয়ে থাকে ডাচ বাংলা ব্যাংক। এছাড়া শিক্ষা উপকরণ কেনার জন্য আড়াই হাজার টাকা এবং ড্রেসের জন্য দেয় এক হাজার টাকা। আর অনার্স পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বছরে এককালীন দেয়া হয় ছয় হাজার টাকা। এছাড়া প্রতিমাসে দেয়া হয় আড়াই হাজার টাকা। যা দিয়ে অসচ্ছল কিন্তু মেধাবী শিক্ষার্থীরা তাদের পরবর্তী পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেন। তবে দীর্ঘ সময় ধরে বৃত্তির এই অর্থ না পাওয়ায় আর্থিক সংকটে ভুগছেন তারা।
শিক্ষার্থীদের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকেই বৃত্তির টাকা পাচ্ছেন না তাদের অনেকে। সে হিসেবে প্রায় ১০ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে তাদের শিক্ষাবৃত্তি। তবে প্রতিষ্ঠানের দাবি করোনাকালীন লকডাউনের সময় থেকেই বৃত্তি প্রদান বন্ধ রেখেছেন তারা।
জানা গেছে, অন্যান্য বেসরকারি ব্যাংকের বৃত্তি কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে শিক্ষার্থীদের বৃত্তির টাকা দেয়া বন্ধ রেখেছে ডাচ-বাংলা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের একাধিক ব্যক্তির কথা বললে তারা জানায়, ডাচ-বাংলা ব্যাংক শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য বৃত্তি দেয়। তবে করোনার প্রকোপ শুরুর পর থেকে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তির টাকা দেয়াও বন্ধ রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের দাবি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও শিক্ষা কার্যক্রম থেমে নেই। নিয়মিত ক্লাস-অ্যাসাইনমেন্ট সবই আমাদের করতে হয়। তবে এ ক্ষেত্রে অনলাইনেই আমাদের একাডেমিক কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়টি এখানে আনাটা সমীচীন নয়।
ভুক্তভোগী এ শিক্ষার্থীরা বলছেন, করোনার সময় যেখানে সবাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সেখানে ডাচ-বাংলা ব্যাংক তাদের শিক্ষাবৃত্তি বন্ধ রেখেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও তাদের অনলাইনে ক্লাস চলছে। এছাড়া যারা মেসে থাকতেন তাদের ভাড়া ঠিকই দিতে হচ্ছে। অনলাইন ক্লাসের খরচ ও মেস ভাড়ার টাকা তাদের বাসা থেকে নিতে হচ্ছে। এতে তাদের পরিবারের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থায় দ্রুত বৃত্তির অর্থ পুনরায় দেয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. ফুয়াদ হাসান জানান, করোনার প্রকোপ শুরুর পর থেকে আমরা বাড়িতে চলে আসি। তবে আমাদের অনলাইনে ক্লাস ঠিকই হচ্ছে। ক্লাসের জন্য আমাদের ইন্টারনেট ক্রয় করতে হয়। এই টাকা বাসা থেকে নেয়াটা এই পরিস্থিতিতে পরিবারের উপর বাড়তি চাপ। জানুয়ারি মাস থেকে আমরা বৃত্তির অর্থ পাচ্ছি না। ফলে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আব্দুল মজিদ জানান, করোনাভাইরাসের অজুহাত দিয়ে গত জানুয়ারি থেকে শিক্ষাবৃত্তি দেয়া বন্ধ রেখেছে ডাচ বাংলা ব্যাংক। অথচ অন্য ব্যাংকগুলো নিয়মিত বৃত্তির টাকা দিচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও আমাদের অনলাইনে ক্লাস চলছে, মেস/ বাসা ভাড়া দিতে হচ্ছে। এই অবস্থায় বৃত্তির টাকা বন্ধ রাখাটা কোনো ভাবেই উচিৎ না।
এ ব্যাপারে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুলে কাশেম শিরীনকে কয়েক দফায় মোবাইলে ফোন দিলেও তিনি কল রিসিভ করেন নি। পরে প্রতিবেদকের পরিচয় এবং কথা বলার বিষয় জানিয়ে মোবাইলে ম্যাসেজ পাঠালেও তার কোনো সদুত্তর মেলেনি।
পরে ডাচ-বাংলা ব্যাংক ফাউন্ডেশন (ডিবিবিএফ) শিক্ষাবৃত্তির সাথে সংশ্লিষ্ট অনাদি ভূষণ দাশের কাছে জানতে চাইলে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা মেধাবী ও আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের এই শিক্ষা বৃত্তি দিয়ে থাকি। তবে করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাতে এই কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। পরবর্তীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যখন চালু হবে তখন এটি দেয়া হবে। বিষয়টি সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে এই কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, করোনার কারণে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে। যখন খুলে দেয়া হবে, তখন শিক্ষাবর্ষ তো বেড়ে যাবে তাই তখন হয়তো স্কলারশিপের মেয়াদও বেড়ে যাবে। তাই আমরা যদি এখন টাকাটা দিয়ে দিই তাহলে তো আর পরে তাদের দিতে পারব না। শিক্ষাবর্ষ শেষ হওয়ার আগেই তাদের বৃত্তির টাকা দেয়া শেষ হয়ে যাবে। ফলে বাকি শিক্ষাবর্ষ তারা কীভাবে চালাবেন? তখন তো শিক্ষার্থীরা বিপদে পড়ে যাবে। এই চিন্তা থেকেই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এটা বন্ধ রেখেছে। এজন্য শিক্ষার্থীদের ধৈর্য ধরতে বলছেন এই কর্মকর্তা।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, জানুয়ারি থেকে বৃত্তি বন্ধ রয়েছে তথ্যটা সঠিক নয়, যাদের কাগজ-পত্রে সমস্যা ছিল কেবল তাদেরটাই জানুয়ারি মাস থেকে বন্ধ রয়েছে। কাগজপত্র ঠিক হয়ে গেলে তারাও পুরো টাকা পাবেন। আর লকডাউনের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়া শিক্ষার্থীদেরকেও তাদের বৃত্তির সমপরিমাণ টাকা দেয়া হবে। তবে সে ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতে হবে।
অন্যান্য ব্যাংকের সাথে এই প্রতিষ্ঠানের বৃত্তির পরিমাণ এবং এর সিস্টেমের সাথে অন্যদের তুলনা করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের আহ্বান থাকবে শিক্ষার্থীরা যেন কারো প্ররোচণায় না পড়েন।