১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭:২২

কম খরচে বা টিউশন ফি ছাড়াই যেসব দেশে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের রয়েছে পড়ার সুযোগ

কম খরচে বা টিউশন ফি ছাড়াই যেসব দেশে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের রয়েছে পড়ার সুযোগ
বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আগ্রহীদের খুঁটিনাটি জেনেই প্রস্তুতি নিতে হবে  © প্রতীকী ছবি

উচ্চমাধ্যমিক শেষ করার পর অনেক শিক্ষার্থীর একটি বড় আশা থাকে ভালো ক্যারিয়ার গড়ার, এ লক্ষ্যে ইচ্ছা থাকে বিদেশে পড়াশোনা করার। তবে অনেকেই জানেন না, কীভাবে বিদেশে উচ্চশিক্ষার পথ তৈরি করা যায়। বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী নিজের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে বিদেশে পড়াশোনার স্বপ্ন পূরণ করতে পারেন না। বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রথমেই যে প্রশ্নটি মনে আসে, তা হলো কোন দেশে কম খরচে পড়াশোনা করা সম্ভব।

নরওয়ে, জার্মানি ও ফ্রান্সের মতো দেশগুলো অনেকের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে, কারণ এসব দেশে শিক্ষার মান ভালো এবং পড়াশোনার খরচ তুলনামূলকভাবে কম। অনেক শিক্ষার্থী বৃত্তি নিয়ে বিদেশে পড়তে যান, তবে যারা কম খরচে বিদেশে পড়তে চান, তাদের জন্য কিছু দেশের প্রতি নজর দেওয়া উচিত—বিশেষ করে এশিয়া ও ইউরোপের কিছু দেশ বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য কম খরচে উচ্চশিক্ষার সুযোগ প্রদান করে। আবার কিছু দেশ রয়েছে, যেখানে টিউশন ফি ছাড়াই পড়াশোনা করা সম্ভব।

জার্মানি

বর্তমানে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষার্থীদের পছন্দের বিবেচনায় সবচেয়ে এগিয়ে রাখা যায় জার্মানিকে। অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী দেশ জার্মানি। যদিও দেশটি মন্দা অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশটি বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য জনপ্রিয় একটি গন্তব্য। দেশটির অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শুধু প্রশাসনিক ফি নেয়, কিন্তু কোনো টিউশন ফি নেয় না। সাধারণত জার্মানিতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর সেমিস্টার প্রতি ৩১৫ থেকে ৫৩০ ডলার খরচ হয়ে থাকে। প্রতি মাসে থাকা-খাওয়ার অর্থাৎ জীবনযাত্রার ব্যয় পড়বে ৯৫০ ডলারের মতো। স্নাতকের পর ১৮ মাসের পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ওয়ার্ক ভিসা মেলে এখানে। এমনকি এখানে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি-ই নেই।

চেক প্রজাতন্ত্র

ইউরোপের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ চেক প্রজাতন্ত্র। দেশটির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা টিউশন ফি ছাড়াই পড়াশোনা করতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু শর্ত মানতে হবে বিদেশি শিক্ষার্থীদের। তাদের চেক ভাষায় কথা বলতে জানতে হবে বা চেক প্রজাতন্ত্রের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিগ্রির জন্য ভর্তি হতে হবে।

নরওয়ে

স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ নরওয়ে। নরওয়ে দিনে দিনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কারণ
এ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য টিউশন ফি মুক্ত রেখেছে। তবে এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত নয় এমন দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের থেকে টিউশন ফি নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা চলছে। কোনো কোনো বিষয়ের খরচ সে ক্ষেত্রে ১৩ হাজার ডলারের মতো লাগতে পারে। এখানে মাসিক জীবনযাত্রার ব্যয় ৭৩৫ থেকে ৯৫০ ডলার পর্যন্ত হতে পারে। 

এ দেশে প্রতি সেমিস্টারে শুধু শিক্ষার্থী ইউনিয়ন ফি দিতে হয়, যা ৩০ থেকে ৬০ ইউরোর  মধ্যে। এর মাধ্যমে পাবলিক পরিবহন, জাদুঘর পরিদর্শন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা ও ক্রীড়াসহ বেশকিছু সুবিধা থাকে। নরওয়েতে জীবনযাত্রার জন্য প্রতি মাসে গড়ে ৮০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ ইউরোর  মতো খরচের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

বড় শহরগুলোয় স্বাভাবিকভাবেই খরচ বেশি। ছোট শহরে ৮০০ থেকে এক হাজার ইউরোর মধ্যেই থাকা-খাওয়া ও চলাফেরার খরচ হয়ে যায়।

সুইডেন

ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বা ইউরোপিয়ান ইকোনমিক এলাকায় মাস্টার্স পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের কোনো টিউশন ফি দিতে হয় না। এ ছাড়া সুইডেনে বিদেশি সব শিক্ষার্থী বিনা ফি-তে পিএইচডি করতে পারেন।

ফ্রান্স

বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্গ বলা যেতে পারে ফ্রান্সকে। শুধু পড়াশোনার জন্যই নয়, বৈশ্বিক অর্থনীতি ও ইউরোপীয় বাজারে তাদের অভিজাত পদচারণা আছে। স্নাতকের পর বিদেশি শিক্ষার্থীরা সেখানে ব্যবসায়িক খাতে আকর্ষণীয় কাজের সুযোগ পেতে পারেন। সুস্বাদু খাবার থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক ল্যান্ডমার্ক, ফ্যাশন, শিল্প-সাহিত্য ও জীবনধারা—প্রায় সবকিছুর আনন্দদায়ক মিশ্রণ পাওয়া যায় ফ্রান্সে। এখানে লাইসেন্স (স্নাতক) স্তরে বছরে খরচ হতে পারে ২ হাজার ৭৭০ ইউরো । মাস্টার লেভেলে বছরে খরচ হতে পারে ৩ হাজার ৭৭০ ইউরো বা ৩ লাখ ৬৩ হাজার ৪০০ টাকা।

জীবনযাত্রার জন্য প্যারিস, নিস, লিয়ন, ন্যান্টেস, বোর্দো বা টুলুজের মতো অভিজাত শহরগুলো বাদ দিয়ে ছোট শহর বেছে নিলে ৬৫০ ইউরোর কমেই থাকা সম্ভব।

অস্ট্রিয়া

ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র অস্ট্রিয়া যে কোনো শিক্ষার্থীর স্বপ্ন পূরণে আকর্ষণীয় স্থান হতে পারে। ইইউ (ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন)/ইইএ (ইউরোপিয়ান ইকোনোমিক এরিয়া) দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের জন্য এ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিউশন ফি একদম ফ্রি। কিন্তু নন-ইউ/ইইএ দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের জন্য এখানকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতি সেমিস্টারে ২০ ইউরো ছাড়াও টিউশন ফি বাবদ গড়ে ৭২৬ ইউরো ধার্য করে।

তবে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য অস্ট্রিয়ার অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি মুক্ত। এ তালিকায় আছে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়, ভিয়েনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ইনসব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়, জোহানেস কেপলার ইউনিভার্সিটি লিঞ্জ, গ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় ও লিওবেন বিশ্ববিদ্যালয়।

অপরূপ এ দেশটিতে জীবনযাত্রার খরচ ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। প্রতি মাসে ৯০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ ইউরোয় ভিয়েনা ও সালজবার্গে আবাসন, খাবার, সামাজিক কর্মসূচি ও গণপরিবহণসহ সব খরচ মেটানো যেতে পারে।

তাইওয়ান

আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযুক্তি, ইতিহাস, রান্না, সংস্কৃতি, ভাষা ও প্রাকৃতিক সম্পদসহ অনেক বিষয়ে অভিজ্ঞতা নেওয়ার সুযোগে ভরপুর এশিয়ার স্বঘোষিত এই দ্বীপদেশটিতে। এখানে বেশি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে পড়ছেন। বহুসাংস্কৃতিক ও ইতিহাসসমৃদ্ধ তাইওয়ান বিদেশি শিক্ষার্থীদের আন্তরিকভাবে স্বাগত জানায়। এখানে সাবলীলভাবে চলাফেরা করা যায়। বেশ কয়েক বছর ধরে তাইওয়ানের উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থা বেশ জনপ্রিয়। তাইওয়ানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পড়ার খরচ প্রতি বছর ৬৭৫ থেকে ১২ হাজার ৭০০ ইউরো। এখানে প্রতি মাসে ন্যূনতম ৬৮০ থেকে ৮৮০ ইউরো খরচ করতে হবে।

তুরস্ক

এশিয়া ও ইউরোপকে স্পর্শ করে গড়ে ওঠা তুরস্ক স্থাপত্য বিস্ময় ও হট এয়ার বেলুন ট্রিপের জন্য বিখ্যাত। এখানকার যে বিষয়টি বিদেশি শিক্ষার্থীদের নজর কাড়ে তা হলো দেশটির মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা। দেশটি ইউরোপীয় উচ্চশিক্ষা অঞ্চলের অংশ যা 'বোলোগনা প্রক্রিয়া' হিসেবে পরিচিত। এ কারণে তুরস্কের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ডিপ্লোমা বা অন্যান্য ডিগ্রি ইউরোপে স্বীকৃত। তুরস্কের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাশ্রয়ী। একজন শিক্ষার্থীকে সাধারণত প্রতি শিক্ষাবর্ষে ১০০ থেকে ৪ হাজার ইউরোর মতো খরচ করতে হয়।

অন্যান্য দেশের তুলনায় সাশ্রয়ী তুরস্কে একজন বিদেশি শিক্ষার্থী প্রতি মাসে ৪০০ থেকে ৬৫০ ইউরো খরচ করে থাকতে পারেন।

আর্জেন্টিনা

আর্জেন্টিনায় বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য নানা ধরনের বৃত্তির ব্যবস্থা আছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার খরচ নেই। বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি ৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার ডলার। অপর দিকে মাসিক জীবনযাত্রার খরচ ৩৫০ ডলারের আশপাশে। বিদেশি শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করে কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেন।

পোল্যান্ড

সাড়ে ৪০০-র বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেশ পোল্যান্ড ইউরোপের দ্বিতীয় প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়কে ধারণ করে আছে। এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি পরীক্ষা না থাকায় বিদেশি শিক্ষার্থীরা এখানে অনেক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। আন্ডারগ্রাজুয়েশনের জন্য অন্তত প্রয়োজন হবে মাধ্যমিক শিক্ষার প্রশংসাপত্র, আর্থিক কার্যকারিতার প্রশংসাপত্র ও ইংরেজি বা পোলিশ ভাষায় দক্ষতা।

প্রথম, দ্বিতীয় ও দীর্ঘ-চক্র অধ্যয়নের জন্য টিউশন ফি ২ হাজার ৩৬৮ ইউরো। পোল্যান্ড স্থিতিশীল অর্থনীতির ইউরোপীয় দেশ। বাইরের শিক্ষার্থীদের জীবনযাত্রার খরচ এখানে প্রতি মাসে ৩৫০ থেকে ৫৫০ ইউরো। শহর ভেদে এই বাজেটের তারতম্য ঘটে থাকে।

মালয়েশিয়া

২০২১ সালে মালয়েশিয়ার সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পিএইচডি প্রোগ্রামের জন্য মোট ১১ হাজার ১৬১ বিদেশি শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন। দেশের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পাবলিক প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি মালায়া ২০২২ সালে এশিয়ার শীর্ষ ৫০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পেয়েছে।

এখানকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রিতে সাধারণত প্রতি বছর খরচ হয় ২ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার ইউরো। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিতে প্রতিবছর ৫০০ থেকে ৪ হাজার ইউরো লেগে যায়। জীবনযাত্রার খরচের জন্য প্রতি মাসে ৪৫০ থেকে ৮০০ ইউরো প্রয়োজন হয়।