জিপিএ-৫ কমে অর্ধেক, পাসের নিম্নমুখী হারের নেপথ্যে পাঁচ কারণ
চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমান প্রকাশিত ফলাফলে কমেছে পাশের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এবার দেশের ১১টি শিক্ষাবোর্ডে গড় পাসের হার ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এর আগে গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় গড় পাসের হার ছিল ৮৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ। সেই হিসেবে দেশে এবার পাসের হার কমেছে ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ। পাশের হারের পাশাপাশি এবার কমেছে জিপিএ-৫ এর সংখ্যাও। এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৯২ হাজার ৫৯৫ জন শিক্ষার্থী, গত বছর যা ছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২। এবারের ফলাফলে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে যশোর বোর্ড, তাদের পাশের হার মাত্র মাত্র ৬৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এছাড়াও এ বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ফেল করেছেন তিন লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী।
দেশে ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে কিছু পরিবর্তন আনা হয় শিক্ষাখাতে। ফলে পরীক্ষা পদ্ধতি ও প্রশ্নপত্রের পরিবর্তনের পাশাপাশি কমানো হয়েছিল বিষয় সংখ্যাও। ফলে সহজে পাস ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তির পথ সুগম হয় শিক্ষার্থীদের জন্য। এরপর করোনা সংকট কাটিয়ে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে দেশের শিক্ষাখাত। এবার করোনা সংকটের পর এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা গ্রহণ করা হয় পূর্ণ নম্বরের প্রশ্নপত্র ও পূর্ণ সময়ে। ফলে প্রচলিত ধারায় তুলনামূলক কঠিন মূল্যায়নের মুখে পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের। তবে এবারের পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে আইসিটি বিষয়ে ১০০ নম্বরের পরিবর্তে পরীক্ষা গ্রহণ করা হয় ৭৫ নম্বরে।
এবার সব বিষয়ে এবং পূর্ণ নম্বরে পরীক্ষা হওয়ায় পাসের হার এবং জিপিএ-৫ এর সংখ্যা কমেছে। যখন বিষয় কম, কম সময়ে পরীক্ষা হয়েছে তখন সবার প্রস্তুতি অনেক ভালো থাকে। এবারের পাশের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হার করোনা পূর্ববর্তী সময়ের সঙ্গে তুলনা করতে হবে। সে সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে আগের চেয়ে ফলাফল আসলে একটু ভালো হয়েছে—শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।
মোটাদাগে এবারে পরীক্ষায় পূর্ণাঙ্গ সিলেবাস ও পূর্ণ মানের পরীক্ষা, প্রস্তুতির জন্য শিক্ষার্থীদের জন্য আপাতত কম সময়, ইংরেজি বিষয়ের পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল এবং একক কোনো বোর্ড হিসেবে যশোর বোর্ডের ফলাফল বিপর্যয়ে পিছিয়েছে এবারের ফলাফলের ধারাকে। শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা বোর্ড সংশ্লিষ্টদের দাবি, এসব কারণে পিছিয়েছে তাদের সামগ্রিক ফলাফল। তারা আশা করছেন, করোনাসহ বিভিন্ন কারণে শিক্ষাখাতে সৃষ্ট ক্ষত কাটিয়ে উঠতে সময় লাগলেও সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে সামনের দিনগুলোতে গুণগত শিক্ষা অর্জন সম্ভব বলেও মত তাদের।
এবারের ফলাফলে বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ফল বিপর্যয় ঘটেছে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের। পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে মানবিকের ফল। তারা পিছিয়ে আছে প্রায় প্রতিটি বোর্ডেই। সব বোর্ড মিলে মানবিক বিভাগের মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ২ দশমিক ২৯ শতাংশ ছাত্রছাত্রী এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে। বিপরীতে বিজ্ঞান বিভাগের ২১ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। গড় পাসের হারেও মানবিক বিভাগ সবচেয়ে পিছিয়ে। জাতীয়ভাবে এবার পাসের হার ৭৫ দশমিক ৯০ শতাংশ হলেও মানবিক বিভাগে পাসের হার মাত্র ৭০ দশমিক ২২ শতাংশ।
এছাড়াও শিক্ষার্থীরা খারাপ ফলাফল করেছে ইংরেজি বিষয়ের পরীক্ষায়। ফলে তার প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক ফলাফলে। একই সাথে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি বিষয়ে পিছিয়ে থাকা কিংবা ভালো ফলাফল করতে না পারার ফলে তা কমিয়েছে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। যশোর বোর্ডের শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক পিছিয়ে থাকার পাশাপাশি খারাপ ফলাফল হয়েছে ইংরেজি বিষয়েও, বিষয়টি শিক্ষার্থীদের পাশের হার মাত্র ৭৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এছাড়াও একই বিষয়ে আরও খারাপ অবস্থানে রয়েছে সর্বশেষ প্রতিষ্ঠিত ময়মনসিংহ বোর্ডের শিক্ষার্থীরা, ইংরেজি বিষয়ে তাদের পাশের হার মাত্র ৭৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
ইংরেজি বিষয়ে যশোর এবং ময়মনসিংহ বোর্ড ছাড়াও সামগ্রিকভাবে খারাপ অবস্থান রয়েছে অন্য বোর্ডগুলোতেও। কারিগরি ও মাদ্রাসা বোর্ড বাদে ৮০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পাশের হার। ইংরেজি বিষয়ে ঢাকা বোর্ডে পাশের হার ৮৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ, রাজশাহীতে ৮৩ দশমিক ১৮ শতাংশ, কুমিল্লায় ৮১ দশমিক ৯৮ শতাংশ, চট্টগামে ৮৮ দশমিক ৯১ শতাংশ, বরিশালে ৮৬ দশমিক ০১ শতাংশ, সিলেটে ৮২ দশমিক ১৯ শতাংশ, দশমিক শতাংশ, দিনাজপুরে ৮২ দশমিক ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী পাশ করছে। আর ময়মনসিংহ ও যশোর বোর্ডে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি পাশের হার যথাক্রমে ৭৫ দশমিক ৩৮ এবং ৭৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
যশোর বোর্ডের ইংরেজি বিষয়ের প্রশ্নপত্র কিছুটা কঠিন হয়েছিল। ইংরেজিতে শিক্ষার্থীরা ফেল বেশি করায় কমেছে পাসের হার। একই সঙ্গে ইংরেজিতে খারাপ করায় অনেক শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়নি—অধ্যাপক ড. মো. আহসান হাবিব, চেয়ারম্যান, যশোর বোর্ড।
রবিবারের প্রাপ্ত ফলাফল বলছে, সব শিক্ষাবোর্ড মিলিয়ে পরীক্ষায় মোট পাস করেছেন ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৮৫২ জন পরীক্ষার্থ। শুধু ৯টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডে এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ৭৫ দশমিক ৯ শতাংশ। ৯টি সাধারণ বোর্ডের মধ্যে ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৭৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ, রাজশাহী বোর্ডে ৭৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ, চট্টগ্রাম বোর্ডে ৭৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ, কুমিল্লা বোর্ডে ৭৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ, বরিশাল বোর্ডে ৮০ দশমিক ৬৫ শতাংশ, সিলেট বোর্ডের ৭৩ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, ময়মনসিংহ বোর্ডের ৭০ দশমিক ৪৪ শতাংশ, দিনাজপুর বোর্ডের ৭০ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং যশোর বোর্ডে পাসের হার ৬৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
ফলাফলে যশোর বোর্ডের তলানিতে অবস্থানের কারণ জানতে চাইলে বোর্ডটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আহসান হাবিব জানান, এবার তার বোর্ডের ইংরেজি বিষয়ের প্রশ্নপত্র কিছুটা কঠিন হয়েছিল। ইংরেজিতে শিক্ষার্থীরা ফেল বেশি করায় কমেছে পাসের হার। একই সঙ্গে ইংরেজিতে খারাপ করায় অনেক শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়নি বলেও মনে করেন এই বোর্ড কর্তা।
তবে শিক্ষার্থী-অভিভাবক এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পূর্ণ নম্বরের প্রশ্নপত্র ও পূর্ণ সময়ে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা হওয়ার পাস ও জিপিএ-৫ কমেছে। আর শিক্ষার্থীরা বলছেন, আমাদের ক্লাস শুরু হয়েছিল মার্চে। আর ক্লাস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে গত ২৯ মে। মাত্র ১৫ মাসে দুই বছরের কোর্স শেষ করে তড়িঘড়ি শেষ করে পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও সম্পূর্ণ সিলেবাস ও পরীক্ষার পূর্ণ মানও ফলাফলে প্রভাব ফেলেছে বলে মত শিক্ষার্থীদের।
অন্যদিকে শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, এবার সব বিষয়ে এবং পূর্ণ নম্বরে পরীক্ষা হয়েছে। ফলে গতবারের চেয়ে এবার কমেছে পাসের হার এবং জিপিএ-৫ এর সংখ্যা। তিনি বলেন, যখন বিষয় কম, কম সময়ে পরীক্ষা হয়েছে তখন সবার প্রস্তুতি অনেক ভালো। আর এবার সব বিষয়ে হয়েছে, পূর্ণ সময়ে হয়েছে। জিপিএ-৫ এর ক্ষেত্রে একটা বিস্তর ফারাক হতেই পারে। এটা একেবারেই অস্বাভাবিক নয়।
মোটাদাগে এবারের পরীক্ষায় পূর্ণাঙ্গ সিলেবাস, পূর্ণ মানের পরীক্ষা, প্রস্তুতির জন্য শিক্ষার্থীদের জন্য আপাত কম সময়, ইংরেজি বিষয়ের পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল এবং একক কোনো বোর্ড হিসেবে যশোর বোর্ডের ফলাফল বিপর্যয়ে পিছিয়েছে এবারের ফলাফলের ধারাকে।
এবারের পাশের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হার করোনা পূর্ববর্তী সময়ের সঙ্গে তুলনা করতে হবে জানিয়ে ডা. দীপু মনি বলেন, সে সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে আগের চেয়ে ফলাফল আসলে একটু ভালো হয়েছে।
এর আগে চলতি বছরের ১৭ আগস্ট দেশের আটটি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পিছিয়ে যাওয়া চট্টগ্রাম, মাদ্রাসা ও বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা শুরু হয় ২৭ আগস্ট। এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিতে ফরম পূরণ করেছিলেন ১৩ লাখ ৫৯ হাজার পরীক্ষার্থী। গত ১৭ আগস্ট থেকে এ পরীক্ষা শুরু হয়ে চলে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। বেলা ১১টায় শিক্ষার্থীরা ফল পাবেন বলে জানিয়েছে শিক্ষা বোর্ডগুলো।
চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলে এগিয়ে আছেন ছাত্রীরা। চলতি বছর উত্তীর্ণ ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৮৫২ হাজার পরীক্ষার্থীরা মধ্যে ছাত্রী ৫ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি ও ছাত্র ৫ লাখ ২৮ হাজারের বেশি জন। এইচএসসি ও সমমানে মোট পাসের হার ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। পাসের হারেও এগিয়ে ছাত্রীরা। ছাত্রীদের পাসের হার ৮০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ছাত্রদের পাসের হার ৭৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ছাত্রীদের থেকে বেশি সংখ্যক ছাত্র অংশ নিয়েছিলেন। পরীক্ষায় অংশ নেয়া মোট ১৩ লাখ ৫৭ হাজার ৯১৫ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্র ছিলেন ৬ লাখ ৮৯ হাজার ও ছাত্রী ছিলেন ৬ লাখ ৬৮ হাজার।
শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য কম সময় পেয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে প্রস্তুত হয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পারার ফলে ফলাফলে প্রভাব পড়েছে। তবে বোর্ড এবং মন্ত্রণালয়ের দাবিকে খুব যৌক্তিক বলে মনে করেন না এই শিক্ষাবিদ।
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কমিটি ও শিক্ষা আইন প্রণয়ন কমিটির সদস্য এবং প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, আমাদের প্রচলিত মূল্যায়ণে পরিবর্তন আনতে হবে। সেটি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ হতে পারে এবং এর বাইরে আন্তর্জাতিক মানের ব্যবস্থা যেমন: জিআরই, টোফেল কিংবা আইএলটিএসের মতো জাতীয় কোনে মূল্যায়ন পদ্ধতি হতে পারে। নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে প্রচলিত ধারায় চলমান অভিযোগকে পাশ কাটিয়ে সমাধানে সামনে এগিয়ে যাওয়ার উপায় দেখছেন দুই শিক্ষাবিদই।