০২ জুলাই ২০২২, ১৩:২৭

জবি ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিতের পেছনে টেন্ডার ও চাঁদাবাজি! 

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়   © লোগো

কমিটি হওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি স্থগিত করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। গতকাল শুক্রবার এ কমিটি স্থগিত করা হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ কমিটি স্থগিতের কোনো কারণ উল্লেখ না করলেও টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ছাত্রলীগ নেত্রীকে কু-প্রস্তাব, কমিটির পদধারী নেতাকর্মীদের কোনঠাসা করে রাখাসহ অনেক কারণ সামনে এসেছে। 

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটির পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের দ্বিতীয় তলা টিন সেড বিল্ডিং, ডরমেটরি ভবন মেরামত, মনোবিজ্ঞান ভবনের ছাদ মেরামতসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও দপ্তরের সংস্কার, ইলেকট্রনিক্স পণ্য ক্রয়, ল্যাবরেটরি, বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতা, ক্যালেন্ডার ডায়েরী তৈরির প্রায় দেড় কোটি টাকার টেন্ডার হয়। সব কয়টি টেন্ডার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহিম ফরাজি ও এস এম আকতার হোসেনের নির্দেশিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে দেয়। এসব টেন্ডারের বাজেট থেকে ১৫ শতাংশ এ দুই ছাত্র নেতার পকেটে গেছে। 

তবে শীর্ষ এ দুই নেতার পুরনো ঢাকার ক্যাম্পাসের টেন্ডারবাজি ছাপিয়ে আলোচনায় উঠেছে কেরাণীগঞ্জের নতুন ক্যাম্পাসের টেন্ডার। নতুন ক্যাম্পাস নির্মাণে সীমানা প্রাচীরের ৩৩ কোটি ও মাস্টারপ্লানের ৫ কোটি টাকার টেন্ডার পায় সরকারের স্থানীয় এক প্রতিমন্ত্রী আর উপজেলা চেয়ারম্যানের পছন্দের কোম্পানী কিংডম বিল্ডার্স আর আরবানা লিমিটেড। কিন্তু শাখা ছাত্রলীগের ফরাজি-আকতার কমিটির পরে নতুন ক্যাম্পাসের ২৭ কোটি টাকায় লেক নির্মাণ ও ইঞ্জিনিয়ারিং ও প্লানিং দপ্তরের ৬২ কোটি টাকার টেন্ডারে বাগড়া দেন এ শীর্ষ নেতারা। এ ঘটনায় স্থানীয় এ প্রতিমন্ত্রী শাখা ছাত্রলীগের প্রতি মনক্ষুন্ণ হন। 

এছাড়াও শাখা ছাত্রলীগ নেত্রীকে কুপ্রস্তাবের অভিযোগ উঠেছে। কমিটি স্থগিতের পর পরই শাখা ছাত্রলীগের নারী যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফৌজিয়া আক্তার প্রিয়ন্তি সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেনের বিরুদ্ধে নানান সময়ে কুপ্রস্তাব ও আবদার মেটাতে চাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। 

জবি ছাত্রলীগের এই নারী যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফৌজিয়া আক্তার প্রিয়ন্তি বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির পর থেকে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম  আকতারের রাজনীতি করি। কিন্তু সাধারণ সম্পাদকের হওয়ার পরে আকতারের চরিত্র বদলে যায়। নানান সময়ে সে আমাকে তার নানান চাহিদা ও আবদার পূরণ করতে কুপ্রস্তাব দেয়। তারজন্য কুপ্রস্তাবের কারণেই আমি রাজনীতির মাঠ থেকে সরে আসতে বাধ্য হই। আকতার বিভিন্ন সময় বলত তার কথা না শুনলে ছাত্রী হলের কমিটিতেও কেউ পদ পাবে না! 

এ নেত্রী জানান, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এমন কি অনুসারী মেয়েদেরকেও বলে দিয়েছেন আমাকে যদি কেউ সালাম দিলে পদ পাবে না। জগন্নাথের একমাত্র ছাত্রী হলে ৩০০ এর অধিক ছাত্রলীগের মেয়েরা উঠলেও আমাকে উঠতে দেয় নি আকতার। পরবর্তীতে আমার ছোট বোনদের একদিন দেখতে গেলে আকতার হলের প্রভোস্টকে ফোন দিয়ে আমাকে হল থেকে বের হতে বাধ্য করে। এদিকে আজকে এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করলে আকতার আমাকে ফোন দিয়ে হুমকি দিচ্ছে।

জবি ছাত্রলীগের একাধিক পদধারী নেতা জানান, বর্তমান কমিটির সভাপতি ইব্রাহীম ফিরাজী ও সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন কমিটি হওয়ার পরই ক্যাম্পাসে টেন্ডারবাজীসহ আশেপাশের এলাকায় চাঁদাবাজি শুরু করেন। এছাড়াও বর্তমান কমিটির পদধারী নেতাদেরকে কোনঠাসা করে রাখতে জুনিয়রদের সামনে অপমান অপদস্ত করতে থাকেন। সভাপতি সম্পাদক ক্যাম্পাসে আসলে ইঞ্জিনিয়ারিং দপ্তর আর প্রশাসনিক দপ্তরে যাওয়া আসা ছাড়া আর কোন কার্যক্রম চোখে পড়েনা।

এছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতার বিরুদ্ধে কয়েকটি গুরুতর অভিযোগে কমিটি স্থগিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ছাত্রলীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। তারা বলেন, ‘ইব্রাহীম ও আকতারকে সভাপতি-সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণার পর থেকেই পুরান ঢাকায় লুকিয়ে তারা বেপরোয়া চাঁদাবাজি শুরু করেছে। পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সিসিটিভির ফুটেজ তো সবার কাছেই আছে। 

ফুটেজে দেখা যায়, জবি ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির সভাপতির কর্মী সাইদুল ইসলাম সাঈদ ও সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসাইনের কর্মী মো: মাসুদ রানা পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ঢুকেছেন। 

জবি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রিফাত সাঈদ বলেন, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে চাঁদাবাজির পর তাকে এ প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগে মালিক ফোন দেয়। কিন্তু পরে সিসিটিভি ফুটেজে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী সাঈদুল ইসলাম সাঈদ মাসুদ রানার চাঁদাবাজী করতে দেখা যায়। এ নিয়ে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে বিচার দিলেও তারা কোন ব্যবস্থা নেয়নি।

গত ১১ মার্চ নবীন শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ দলে ভিড়ানোকে কেন্দ্র করে দফায় দফায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক গ্রুপ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। মালিটোলা পার্ক, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও টিএসসি এলাকার এ ঘটনায় প্রায় ১০ জন আহত হয়। 

গত ৬ মার্চ আড়াই লাখ টাকা চাঁদা না দেয়ায়  সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে এফ আর হিমাচল পরিবহনের একটি বাস পুরান ঢাকার তাঁতিবাজার এলাকা থেকে এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকের সামনে আটকে রাখে আকতার হোসাইনের অনুসারী ও দর্শন বিভাগের ২০১৬-২০১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান। জানা যায়, ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকা থেকে চলা বাস থেকে মাসিক কয়েকলক্ষ টাকা মাশোয়ারা দিতে হয় জবি ছাত্রলীগকে।

২০১৪ সালের হল আন্দোলনের সময় সমবায় ব্যাংকের মালিকানা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের জমিটি দখল করে শিক্ষার্থীরা জায়গাটিকে ‘টিএসসি’ হিসেবে দাবি করে আসছে। ছাত্রলীগ নেতা কর্তৃক জায়গাটি কয়েকবার বেদখল হলেও সর্বশেষ ২০১৭ সালের শুরুতে আবারো দখলমুক্ত করে শিক্ষার্থীরা। এরপর স্বাভাবিকভাবে চললেও বর্তমানে স্থগিত হওয়া ছাত্রলীগ কমিটি এটি সংস্কার করে নতুন করে চালু করে। মাসিক দুই লাখ চাঁদা তোলার অভিযোগ আছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।

গত জুনে ইসলামপুরে আগে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এক বিচারে গিয়ে সিদ্ধান্ত না মানায় এক ব্যবসায়ীকে নাকি তুলে আনার অভিযোগ আছে শাখা ছাত্রলীগের এ দুই শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে। ৫০ লাখ টাকা চাঁদা না দেয়ায় সদরঘাটের গ্রেটওয়ালের এক ব্যবসায়ীর ছেলেকে তুলে আনার অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে। এছাড়া আওয়ামী লীগ এক নেতার ছেলেকে বাড়িতে গিয়ে মারধর করার অভিযোগ ফরাজি আর আকতারের বিরুদ্ধে। এসব ঘটনায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে মৌখিক অভিযোগ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক ইন্দ্রনীল দেব শর্মা বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের প্রতি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নির্দেশনা ছিল কিন্তু দীর্ঘদিনেও তারা সেটি পালন করেনি। এছাড়াও তাদের নামে একাধিক অভিযোগ আসে কেন্দ্রে। এ প্রেক্ষিতে শাখা ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্তগিত করা হয়েছে। 

এ বিষয়ে জানতে জবি ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহিম ফরাজি ও সাধারণ সম্পাদক এস এস আকতারকে একাধিকবার ফোন দিলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি। এছাড়াও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্যের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তাদের পাওয়া যায়নি।