২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৯:১৮

এক যুগে পা রাখছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়  © অসীম হালদার

কীর্তনখোলা নদীর তীরে কর্ণকাঠিতে গড়ে ওঠা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় আগামীকাল (২২ ফেব্রুয়ারি) ১১ বছর পেরিয়ে ১২ বছরে পা রাখবে। এ উপলক্ষে মঙ্গলবার নানান কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। 

এরই মধ্যে এটি দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম বিদ্যাপীঠে পরিণত হয়েছে। বরিশালবাসীর দীর্ঘদিনের আন্দোলন সংগ্রাম, ত্যাগ, তিতিক্ষার পর ২০১১ সালের এইদিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি প্রস্তর উদ্বোধনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু এই বিদ্যাপীঠের।

নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে এক যুগে পা দিচ্ছে নবীন এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। শিক্ষা, গবেষণা ও দক্ষ মানব গড়ার কারিগর হিসেবে ইতিমধ্যে জাতীয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইতিমধ্যে স্বাক্ষর রেখে চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। 

ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ৩ জানুয়ারি বরিশালের বেল’স পার্কের বিশাল জনসভায় ঘোষণা দেন, ঢাকার বাইরে পরবর্তী যে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হবে সেটি হবে বরিশালে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু ও পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ থমকে যায়। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালের ২৩ নভেম্বর শুক্রবার বরিশাল সার্কিট হাউজে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদের সভায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গ্রহীত হয়। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তার মৃত্যুতে এ উদ্যোগ আরেকবার থমকে যায়।
 
১৯৯৩ সালে বিএনপি সরকার পৃথক বরিশাল বিভাগ প্রতিষ্ঠা করলে, নতুন বিভাগে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। বিএম কলেজ অডিটোরিয়ামে এক অনুষ্ঠানে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস বিএম কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তরের ঘোষণা দেন। এর প্রেক্ষিতে, বিএম কলেজের উচ্চমাধ্যমিক কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। কিন্তু বরাবরই বাস্তবায়নের অভাবে বরিশালের মানুষের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। 

পরবর্তীতে নব্বইয়ের দশকের শেষে আওয়ামীলীগ সরকার বাংলাদেশের বৃহত্তর জেলা সদরগুলোতে ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ২০০০ সালে “বরিশাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়” প্রতিষ্ঠার প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। ২০০১ সালের ১৫ জুলাই বরিশাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণীত হয়। এতে বলা হয়, বৃহত্তর বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা ইউনিয়নে বরিশাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (Barisal Science and Technology University) নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। 

২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে, বরিশাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। পূর্বে অনুমোদিত প্রকল্পের অধীনে পটুয়াখালীতে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়, কিন্তু বরিশালের প্রকল্পটি বাতিল করে পরবর্তীতে একটি পূর্ণাঙ্গ সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। 

এসময় আবারো ব্রজমোহন কলেজকে  বিশ্ববিদ্যালয় করার তোড়জোড় শুরু হয়। তবে, বরিশালবাসীর একাংশের দাবি ছিল স্বতন্ত্র পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের, বিএম কলেজের ঐতিহ্য নষ্ট করে নয়। এসময় বিএনপি-জামাত জোট সরকার স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাব অনুমোদন করে। তৎকালীন বিএনপি নেতা মজিবর রহমান সরোয়ার, এমপি ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়ার মন্ত্রীসভায় গৃহীত প্রকল্পের স্মরণে “শহীদ জিয়াউর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়” নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন। তৎকালীন  প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এ প্রস্তাব অনুমোদন করেন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০০৬ সালের “শহীদ জিয়াউর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় আইন” প্রণয়ন করে। একই বছর বিএনপি সরকার বরিশাল শহরের সন্নিকটে কড়াপুরে নবগ্রাম রোডের পাশে ডেফুলিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য স্থান নির্ধারণ করে ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। কিন্তু ক্ষমতার পট পরিবর্তনের কারণে সেই প্রচেষ্টা আর এগোয়নি।

পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আবারও বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি জোরালো হয়। ২৯ নভেম্বর ২০০৮ সালে তৎকালীন ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিন সরকার বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব একনেকে পাস করে, কিন্তু একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি।

ইতিহাসের নানা বাঁক পেড়িয়ে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের আমলে বরিশাল বিশ্ববিদ্যায় প্রতিষ্ঠার কাজ পুনরায় শুরু হয়। ঐ বছর ২৮ মার্চ একনেক সভায় পুনরায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৯৫ কোটি টাকা। ৯ অক্টোবর তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বরিশাল সফরে এসে মৌখিকভাবে সদর উপজেলার চরকাউয়া ইউনিয়নের কর্ণকাঠি গ্রামে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য স্থান পরিদর্শন ও নির্ধারণ করেন। কর্নকাঠিতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন নির্ধারণ এবং জমি অধিগ্রহণে তৎকালীন সিটি মেয়র শওকত হোসেন হিরণ উদ্যোগী ভূমিকা রাখেন ও “শহীদ জিয়াউর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়” এর পরিবর্তে “বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়” নামকরণের প্রস্তাব করেন। 

২০১০ সালের ১৬ জুন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় সংশোধিত  আইন পাস হয়, ও পরবর্তী সময়ে প্রাথমিকভাবে বরিশাল জিলা স্কুলের পরিত্যক্ত কলেজ ভবনে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস স্থাপনের জন্য বরিশাল শহরের সন্নিকটে কীর্তনখোলা নদীর পূর্ব তীরে নির্মাণাধীন দপদপিয়া সেতুর কাছে কর্ণকাঠী গ্রামের ৫০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়।

অবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বরিশাল সফরে এসে দেশের ৩৩তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে “বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়” এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। 

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়-এর প্রকল্প পরিচালক প্রফেসর ড. মো. হারুনর রশীদ খানকে ৪ বছরের জন্য ভাইস-চ্যান্সেলর (ভিসি) পদে নিয়োগ প্রদান করা হয়। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ও ভর্তি শুরু হতে লেগে যায় আরও এক বছর। ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি  শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি ৪টি অনুষদের ৬টি বিভাগের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ম বর্ষ স্নাতক (সম্মান) ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ৬টি বিভাগে ৪০০ শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু হয় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের । 

অপরূপ সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি
প্রভাতের রক্তিম সূর্যকে ছুঁয়ে ধরতে, কীর্তনখোলা নদীর অপরূপ স্নিগ্ধতা কাটিয়ে, সারি সারি স্বাপ্নিক লাল বাসগুলো পিঁপড়ে গতিতে দপদপিয়া ব্রিজ পাড়ি দিলেই দেখা মেলে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের। কীর্তনখোলা ও খয়রাবাদ নদীর মোহনায় গড়ে ওঠা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরূপ সৌন্দর্য্যে যে কোন মানুষকে মায়ার বাঁধনে এক মুহূর্তেই মোহিত করে ফেলে। চোখ মেললেই দেখা মেলে অনন্য এক স্থাপনার। যেখানে হাজারো স্বাপ্নিক চোখের  মেলা। ৫০ একরের মায়াবী এই ক্যাম্পাসের  দুটি একাডেমিক ভবন, দুটি প্রশাসনিক ভবন, লাইব্রেরি ভবন, টিএসসি,  ছেলেদের জন্য দুটি আবাসিক হল, মেয়েদের জন্য দুটি হল, উপাচার্যের বাসভবন, শিক্ষক- কর্মকর্তাদের জন্য দুটি ডরমিটরি, দৃষ্টিনন্দন মসজিদ, মন্দিরের নজরকাঁড়া  সৌন্দর্য আপনাকে যেন কোন এক প্রাচীন রাজভূবনে নিয়ে যাবে। ঋতুভেদে প্রকৃতি যেমন নব নব রূপে সজ্জিত হয়, তেমনিভাবে ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যও নব রূপে ফুটে উঠে। শরতে শুভ্র সাদা কাশফুল ছেয়ে যায় ক্যাম্পাস, বসন্তে পলাশ ফুলে রঙ্গিন হয়ে উঠে মুক্তমঞ্চের আঙ্গিনা,শীতে কুয়াশায় চাদর মুড়ি দেয় ক্যাম্পাস। পড়ন্ত বিকেলে ক্যাম্পাসে ডানা মেলে টিয়েপাখি, বন্য কবুতরের দল। শালিকের কিচিরমিচির, ভোলা রোডের নিসর্গ সৌন্দর্য্যে যেকোন মানুষকে  এক মুহূর্তেই ভুলিয়ে দেয় নিঃসঙ্গতা। মুক্তমঞ্চে দলে দলে শিক্ষার্থীদের আড্ডা-গানে মুখরিত হয়ে উঠে, তালতলা, লন্ডন ব্রিজে প্রেমিকের প্রেম নিবেদনে প্রেমময়  হয়ে উঠে ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবোধ। পহেলা বৈশাখ, ব্যাচডে, বিভিন্ন বিভাগ ডে’তে উৎসব আয়োজনে থাকে স্বাতন্ত্র্যবোধ, শিল্পবোধ পরিচয়। র‍্যাগিংমুক্ত, মাদকমুক্ত, ধূমপানমুক্ত এবং পরিবেশবান্ধব সবুজ ক্যাম্পাস হিসেবে সমাদৃত  বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। 

গবেষণায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শিক্ষা ও গবেষণায় সোনালি স্বাক্ষর রেখে চলেছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গবেষণায় এক নিবেদিত প্রাণ। প্রত্যেক বছরই জাতীয় ও আন্তজার্তিক জার্নালে অসংখ্য গবেষণাকর্ম প্রকাশ করে যাচ্ছে এখানকার শিক্ষক- শিক্ষার্থীরা৷

অ্যালপার ডগার (এডি) সায়েন্টিফিক ইনডেক্স-২০২১ এর বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী ও গবেষকদের তালিকায় এ বছর মর্যাদাপূর্ণ স্থান লাভ করেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও গবেষক ড. মো. খোরশেদ আলম। এডি সাইন্টিফিক ইনডেক্স নামে আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা সংস্থা সারা বিশ্বের ৭ লাখেরও বেশি বিজ্ঞানীর ও গবেষকের সাইটেশন এবং অন্যান্য ইনডেক্সের ভিত্তিতে এই তালিকা প্রকাশ করেছে।

এই র‌্যাংকিং করার ক্ষেত্রে বিশ্বের ৭ লাখ ৮ হাজার ৪৮০ জন, এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৬২ জন, বাংলাদেশের ১৭৯১ জন গবেষকের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে চলতি বছরসহ গত ৫ বছরের সাইটেশন আমলে নেওয়া হয়। এর মধ্যে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক ড. মো. খোরশেদ আলম তার প্রকাশিত আর্টিকেল, সাইটেশন এবং অন্যান্য ইনডেক্সের বিবেচনায় এ তালিকায় স্থান পেয়েছে। ড. খোরশেদ আলম একজন নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে পরিচিত।

ড. মো. খোরশেদ আলম জাপানের তোহোকু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১১ পিএইচডি সম্পন্ন করে জাপানের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়, টোকিও এর কোগাকুইন বিশ্ববিদ্যালয় ও জাপানের ওকাজাকির আইএমএস থেকে ৩ টি পোস্টডক্টরাল গবেষণা সম্পন্ন করেছেন। অটোমোবাইল ক্যাটালিস্ট, এনোড ক্যাটালিস্ট, সোলার সেল, লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারী, হেড ডিস্ক ড্রাইভ ইন্টারফেস, বায়োফিজিক্স ইত্যাদি গবেষণা ক্ষেত্রে তার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গবেষণা খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

২০২১ সালে ম্যাটেরিয়াল সায়েন্সে গবেষণা করার জন্য বিশ্বখ্যাত দি ওয়ার্ল্ড অ্যাক্যাডেমি অফ সায়েন্সেস’র রিসার্চ গ্র্যান্ট পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. রহিমা নাসরিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কাজকে বিশ্বমানে উন্নীত করতে, পর্যাপ্ত রিসার্চ ফেসিলিটি, উন্নত মানের রিসার্চ ল্যাব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে টোয়াজ রিসার্চ গ্র্যান্ট প্রোগ্রাম-২০২১ একটি রিসার্স প্রজেক্ট প্রপোজাল পাঠিয়েছিলেন যা টোয়াজ সিলেকশন কমিটি নির্বাচিত ও প্রশংসিত হয়েছে এবং তিনি ১৪ লাখ টাকার একটি রিসার্চ গ্রান্ট পান।  ফলে ডক্টর রহিমা নাসরিনের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একটি রিসার্চ ল্যাব’র যাত্রা শুরু হবে।২০২১-২২ অর্থ বছরে গবেষণা প্রকল্পের জন্য জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ পেয়েছেন  বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বিভাগের ১০ জন শিক্ষক। ফেলোশিপ পাওয়া শিক্ষকগণ প্রতিটি গবেষণার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে ২ থেকে ৪ লাখ টাকা করে অনুদান  পান। প্রকৌশল ও ফলিত বিজ্ঞান ক্যাটাগরিতে মনোনীতরা হলেন, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ধীমান কুমার রায়, সহকারী অধ্যাপক আবু জাফর মিয়া, সহকারী অধ্যাপক সুখেন গোস্বামী,ও প্রভাষক মো. হাসনাত জামান। পদার্থবিজ্ঞান ক্যাটাগরিতে মনোনীতরা হলেন, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. খোরশেদ আলম, সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহফুজ আলম, প্রভাষক মো. সাইফ ইসতিয়াক ও রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মাসুদ পারভেজ। জীববিজ্ঞান ক্যাটাগরিতে মনোনীতরা হলেন, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. সুব্রত কুমার দাস ও প্রভাষক শাওন মিত্র। এছাড়াও রিচার্সগেট, স্কোপাস, অ্যাকাডেমিয়া, গুগল স্কলারসহ স্বনামধন্য বিশ্ববিখ্যাত সব জার্নালে গবেষণা করে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। 

শিক্ষার্থীদের গৌরবগাঁথা
নেতৃত্ব, জ্ঞান বিকাশ, উদ্ভাবন-আবিষ্কার, সৃজনশীলতার মাধ্যমে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা  জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গৌরবময় স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেছে।  সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত স্পাইক এশিয়া ফেস্টিভ্যাল অব ক্রিয়েটিভিটিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী গোলাম রব্বানী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে নিয়মিত সাফল্য বয়ে আনছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থীরা কৃষি কাজে ব্যবহার উপযোগী ড্রোন উদ্ভাবন করেছে। অন্ধদের জন্য টকিং গ্লাস আবিষ্কার করেছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।এ  বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজেদের  ব্যবহারের জন্য তৈরি করেছে অ্যাপস, চালু করেছে অনলাইন রেডিও, ওয়েবসাইট বিভিন্ন জিনিস। উচ্চশিক্ষার জন্য চীন, ভারত, তুরস্কসহ ইউরোপের দেশগুলো থেকে সুনামধন্য স্কলারশিপ ছিনিয়ে নিচ্ছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পিছিয়ে নেই চাকরির বাজারেও । বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় বেড় হওয়া দক্ষ গ্রাজুয়েটরা দেশের বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সেক্টরে নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থান ইতিমধ্যে গড়ে তুলেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ আর্মি বিশ্ববিদ্যালয়ে  শিক্ষকতা করছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।  শিক্ষার পাশাপাশিসহ-শিক্ষা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক, সাহিত্যিক  অঙ্গনেও শিক্ষার্থীদের রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। এবছর অমর একুশে বই মেলায় বের হয়েছে একাধিক শিক্ষার্থীর কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। 

সামাজিক সংগঠন
বিশ্ববিদ্যালয় শুধু পুথিগত জ্ঞান চর্চার জায়গা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে মানুষ গড়ার কারিগর, জ্ঞান বিকাশের জায়গা। প্রগতি, নেতৃত্ব, সৃজনশীলতা, মানবিকতা, পরোপকারীতা,যুক্তিতর্কের উৎকৃষ্ট জায়গা। আর এসব নিশ্চিত করতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে  নিরলস কাজ করে যাচ্ছে অনেকগুলো সামাজিক, সাংস্কৃতিক,স্বেচ্ছাসেবী  সংগঠন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংগঠন হচ্ছে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন বাঁধন,বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটি, ৭১'র চেতনা,প্রথম আলো বন্ধুসভা, সমকাল সুহৃদ,উচ্ছ্বাস,  ইচ্ছেফেরি,  বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় আইটি সোসাইটি, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় কুইজ সোসাইটি, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যারিয়ার ক্লাব, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান ক্লাব, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যদল, কীর্তনখোলা ফ্লিম সোসাইটি, বাংলাদেশ  তরুণ কলাম লেখক ফোরাম,বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি ,বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস ক্লাবসহ অসংখ্য সংগঠন৷ 

সমস্যায় জর্জরিত বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠার এক দশক পেড়িয়ে গেলেও নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো শেষ হয়নি প্রথম প্রকল্পের কাজ। ফলে ক্লাসরুম সংকট, আবাসিক সংকট, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অফিস সংকটও চরম। সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের জন্য মানসম্মত পৃথক অডিটোরিয়াম নেই,নেই পর্যাপ্ত  গবেষণাগার।  লাইব্রেবিতে প্রয়োজনীয় বইয়ের সংকটসহ পরিবহন সুবিধা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি।মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর পাশাপাশি সর্বাগ্রে প্রয়োজন দক্ষ, যোগ্য, নিবেদিতপ্রাণ, আদর্শবান শিক্ষক। ‘বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাতে শিক্ষক স্বল্পতা রয়েছে। প্রফেসর আছেন মাত্র একজন, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর পোস্টের সব পোস্টই শূণ্য। নেই উপ-উপাচার্য, স্থায়ী রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ট্রেজারারসহ ৫টি অনুষদের ডিন। কিন্তু ২৪টি বিভাগে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। একজন শিক্ষককে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কোর্স পরিচালনা করতে হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীরা গুণগত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনিভাবে মহামারী আকারে তাদের ওপর জেঁকে বসেছে সেশনজট কালো থাবা। 

উপাচার্যের বাণী
অধ্যাপক ড. মো. ছাদেকুল আরেফিন এক বাণীতে বলেছেন, “সাফল্যের ১১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করছে  প্রাণের বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শিক্ষা, গবেষণা ও সহশিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার মাধ্যমে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বতন্ত্র অবস্থান বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। একঝাঁক তরুণ-মেধাবী শিক্ষকমন্ডলী, মেধাবী শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিরলস পরিশ্রমে সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় এগিয়ে চলেছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।”

“স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে তৎকালীন বেলস্ পার্কে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু উদ্যান) অনুষ্ঠিত জনসভায় তাঁর ভাষণে ঢাকার বাহিরে বরিশালে একটি পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষণাকে বাস্তবে পরিনত  করার লক্ষ্যে ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি  গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরিশাল সদর উপজেলার কর্ণকাঠীতে ৫০ একর জমিতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

এর মাধ্যমে বরিশালবাসীর দীর্ঘদিনের যৌক্তিক প্রত্যাশা, দাবি ও লালিত স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন শুরু হয়। পরের বছর ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি বরিশাল নগরীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জিলা স্কুল ক্যাম্পাসের কলেজ ভবনে অস্থায়ী ক্যাম্পাসের কার্যক্রম পরিচালনা এবং শিক্ষার্থী ভর্তির মাধ্যমে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রমের শুভ সূচনা ঘটে। প্রতিষ্ঠাকালীন ০৪টি অনুষদের অধীনে ০৬টি বিভাগের ৪০০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় তার যাত্রা শুরু করে।”

“বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ৬টি অনুষদের অধীনে ২৪টি বিভাগে প্রায় ৯০০০ জন শিক্ষার্থী অধ্যায়নরত রয়েছে। ১৯০ জন শিক্ষক, ১০৫ জন কর্মকর্তা এবং ১৫৬ জন কর্মচারীর সমন্বয়ে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়টি দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরির কারিগর হিসেবে জ্ঞানের আলো বিলিয়ে যাচ্ছে স্ব-মহিমায়। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের প্রতিটি সদস্যের আন্তরিকতা এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক, গবেষণা, সহশিক্ষাসহ বঙ্গবন্ধুর দর্শন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তরুণ প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি খুব ভালোভাবেই করে যাচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে অচিরেই বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষা ও গবেষণার বিস্তার, মুক্তচিন্তার বিকাশ এবং সৃজনশীল কর্মকান্ডের মাধ্যমে প্রযুক্তি নির্ভর একটি কার্যকর গবেষণাধর্মী উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিনত হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে  জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর চিন্তা, চেতনা ও দর্শনকে ছড়িয়ে দিতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন সময়ে নানা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে।”

“মুজিব জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪টি বিভাগ বছরব্যাপী বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ শীর্ষক ওয়েবিনার আয়োজন, বঙ্গবন্ধু অলিম্পিয়াড আয়োজন, কুইজ প্রতিযোগিতা, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক দেয়ালিকা প্রদর্শন, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, বৃক্ষরোপন, স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি, শিক্ষার্থীদের লেখায় ‘তারুণ্যের বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামের স্মরণীকা প্রকাশ, একাডেমিক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬টি অনুষদ থেকে বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করে জার্নাল প্রকাশ, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। দেশ-বিদেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের ভার্চুয়াল অংশগ্রহণ আয়োজনকে করে তোলে গুরুত্ববহ। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি বছর তার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী জমকালোভাবে পালন করে থাকে। যেখানে থাকে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতি।”

উপাচার্য বলেন, করোনা মহামারির কঠিন বাস্তবতার কারণে এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন না থাকলেও বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের ভার্চুয়াল উপস্থিতি আয়োজনে ভিন্ন মাত্রা এনে দেবে।এবারের প্রতিষ্ঠাবর্ষিকীতে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করবেন বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী মহোদয়। যা হোক সকল প্রতিকুলতা পেরিয়ে প্রাণের বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে, জন্মদিনে এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি।