আগের সংসার গোপন করে রওশনকে বিয়ে, ভুয়া রাবিতে পড়ার তথ্যও!
‘সোহেল-রওশন এর অসাধারণ প্রেমের গল্প’ বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে রীতিমতো ভাইরাল। শারীরিক প্রতিবন্ধী স্ত্রী রওশনকে কাধে নিয়ে তাদের প্রায় ১৫ বছরের ভালোবাসার সংসারের গল্প জয় করে নিয়েছে সাধারণ মানুষের মন। রওশনের প্রতি সোহেল মিয়ার এই অদম্য ভালোবাসার খবর প্রচার হয়েছে প্রায় সকল সংবাদমাধ্যমে। মানুষ দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন তাদের ভালোবাসার।
কিন্তু এটি এই প্রেমের গল্পের এক পিঠ মাত্র। আরেক পিঠে রয়েছে আসল সত্য।
রওশনের সাথে সোহেল মিয়ার এটি দ্বিতীয় বিয়ে, আগেও একটি সংসার ছিল তার। সেই সংসারে রয়েছে তিন সন্তান, প্রথম স্ত্রীর নাম শুরাতন বেগম। শুরাতন বেগম থাকেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার বাঙ্গাবাড়ি ইউনিয়নের সন্তোষপুর গ্রামে। চায়ের দোকান চালিয়ে সংসারের খরচ মেটান ছেলেরা। মেয়ের বিয়ে হয়েছে। তার প্রকৃত নাম হলো বকুল। এমনকি নিজের শিক্ষাকতা যোগ্যতা নিয়েও তিনি মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী বলে নিজেকে দাবি করলেও আসলে তিনি অষ্টম শ্রেণী পাস।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সোহেলের আগেও একটি সংসার ছিল। চাঁপাইনবাবগঞ্জে থাকেন তার প্রথম স্ত্রী ও তিন সন্তান। ১৬ বছর আগে দাম্পত্য কলহের জের ও ঋণের চাপে বাড়িতে কিছু না বলেই তিনি বের হয়ে যান তিনি। আর ফেরেননি।
তারপর ময়মনসিংহের ত্রিশালের শারীরিক প্রতিবন্ধী রওশনকে ভালোবেসে বিয়ে করেন। তখন থেকেই চলাফেরায় অক্ষম স্ত্রীকে প্রায় ১৫ বছর ধরে কোলে-পিঠে তুলে বহন করে আসছেন।
তার প্রথম স্ত্রী জানান, স্বামী নিখোঁজ বলেই এতদিন জানতেন। তাদের বিয়েবিচ্ছেদও হয়নি। সম্প্রতি রওশনের সঙ্গে সংসারের খবর সংবাদমাধ্যমে দেখে তিনি এই বিয়ের কথা জানতে পারেন। প্রথম স্ত্রী আরও জানান, সোহেল নয়, ওর নাম মোখলেশুর রহমান বকুল।
সোহেল নিজেও গণমাধ্যমের কাছে বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি জানান, রওশনের প্রতি ভালোবাসা থেকেই অতীত গোপন করেছেন।
শুরাতন আরো জানান, তাদের বিয়ে হয় ১৯৯২ সালে। বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন বকুল। অভাবের সংসারে ঋণ শোধের চাপও ছিল। এসব কারণে তাদের মধ্যে কলহ চলছিল। ২০০৫ সালে একদিন কাজের খোঁজে ঢাকায় যাওয়ার কথা বলে বের হন বকুল। তার পর থেকে আজ অবধি ফেরেননি। তিনি ধরে নিয়েছিলেন স্বামী হারিয়ে গেছে।
শুরাতনের বড় ছেলে সিহাব উদ্দীন জানান, সম্প্রতি ফেসবুক ও টেলিভিশনে রওশন-সোহেল দম্পতির খবর দেখে তিনি বাবাকে চিনতে পারেন। নিশ্চিত হতে মা, স্বজন ও এলাকাবাসীদেরও সোহেলের ছবি-ভিডিওগুলো দেখান। এরপর সবাই নিশ্চিত হন- এই সোহেলই সেই বকুল।
সিহাব আরো জানান, বাবা যাওয়ার পর থেকে সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছিল। ঢাকায় তাকে খুঁজতে যাওয়ার মতো সামর্থ্য তখন ছিল না তাদের।
তবে এখন আর তারা তাদের বাবাকে ফেরত চান না। এমনকি নিজের স্বামীকেও আর ফেরত চান না শুরাতন বেগম।
তিনি বলেন, ‘ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনেক কষ্টে সংসার চালিয়েছি। তবে এখন আর স্বামীকে ফিরিয়ে নিতে চাই না। সে মিথ্যা কথা বলছে, এটা সবাই জানুক।’
সিহাব আরও জানান, বিভিন্ন খবরে লেখাপড়ার বিষয়ে সোহেল যা দাবি করেছেন, তাও সত্য নয়। সোহেল দাবি করেছেন যে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন। তবে সিহাব জানান, তার বাবা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন।
তবে দ্বিতীয় স্ত্রী রওশন জানান, তিনি স্বামীর অতীত সম্পর্কে কিছুই জানেন না, জানতেও আগ্রহী নন। এই সংসারেই তিনি সুখী। স্বামীর ভালোবাসায় তিনি কৃতজ্ঞ।
অভিযোগ স্বীকার করে সোহেল বলেন, ‘আমার আগের স্ত্রী-সন্তান আছে। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িনি, মেট্রিক পরীক্ষাই দিইনি। অভাবের মধ্যে ছিলাম। তাই বুঝতে পারিনি যে ভুল করতেছি। ওইখান থেকে আসার পর পঙ্গু মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। অভাবের তাড়নায় মিথ্যা বলেছি। আমি সবার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।’
সোহেল দাবি করেন, রওশনকে বিয়ের পর বিষয়টি আগের স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন। একসঙ্গে সবাইকে নিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন। তবে আগের স্ত্রী রাজি না হওয়ায় তিনি আর সেখানে ফিরে যাননি। রওশনকে নিয়ে এই গ্রামেই সংসার পেতেছেন।
এর আগে রওশন-সোহেল দম্পতির ভালোবাসার গল্প ভাইরাল হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের সহায়তা দেয়ার নির্দেশ দেন জেলা প্রশাসককে।