অভিযোগ একই, পরিণতি ভিন্ন

মঞ্জুরুল কবির মঞ্জু ও ফারহানা ইয়াসমিন বাতেন
মঞ্জুরুল কবির মঞ্জু ও ফারহানা ইয়াসমিন বাতেন  © ফাইল ছবি

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ জন শিক্ষার্থীর মাথার চুল কাঁচি দিয়ে কেটে দিয়েছেন এক শিক্ষক। এ ঘটনার কিছুদিন পরেই লক্ষ্মীপুরের হামছাদী কাজির দিঘীর পাড় আলিম মাদ্রাসার ছয় শিক্ষার্থীর চুল কেটে দিয়েছেন অন্য এক শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের চুল কেটে দেওয়ার ঘটনাটির তদন্ত হয়েছে। তবে তার অভিযোগের বিষয়ে এখনো কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। অন্যদিকে একই অপরাধে অভিযুক্ত মাদ্রাসা শিক্ষক বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ জন শিক্ষার্থীর চুলে কেটে দেওয়ায় অভিযুক্ত শিক্ষকের নাম ফারহানা ইয়াসমিন বাতেন। তিনি একাধারে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ বিভাগের চেয়ারম্যান, সিন্ডিকেটেরে সদস্য ও প্রক্টর কমিটির সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অন্যদিকে মাদ্রাসার ছয় শিক্ষার্থীর চুল কেটে দেওয়ায় অভিযুক্ত শিক্ষকের নাম মঞ্জুরুল কবির মঞ্জু। তিনি উপজেলার হামছাদী কাজিরদিঘীরপাড় আলিম মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক ছিলেন।

শিক্ষার্থীদের চুল কেটে দেওয়ার মতো একই ধরনের ‘অপরাধে’ মাদ্রাসা শিক্ষককে আটক করা হলেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে কেন আটক করা হয়নি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই প্রশ্ন উঠেছে। প্রশাসনের এমন আচরণে কেউ কেউ দেশে আইনের প্রয়োগ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। আবার অনেকে ক্ষোভ জানিয়ে মাদ্রাসার প্রতি আইনগত বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গিরও অভিযোগ তুলেছেন।

মুহাম্মাদ নিজাম উদ্দিন ফরিদ নামে একজন্য ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘‘মাদ্রাসা ছাত্রের চুল কেটে দেওয়ায় শিক্ষককে আটকের প্রতিবাদ করছি। মাদ্রাসা দ্বীনী প্রতিষ্ঠান। এখানে সুন্নতের চর্চা শেখানো শিক্ষকের দায়িত্ব। বখাটে টাইপের চুল কাটার নির্দেশ দিতে হবে, নিজেরা না কাটলে অবশ্যই কেটে দিতে হবে। কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতের খবর কি প্রশাসন জানে না?’’

তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে এ ধরনের বৈষম্যের কোন সুযোগ নেই। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অভিযোগ এক হলেও বাস্তব পরিস্থিতির কারণে শাস্তির প্রয়োগে ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে।

ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ও আইনজীবী ড. খালেদ এইচ চৌধুরী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এখানে আইনের যে বিষয়টি কাজ করেছে সেটি হলো যেহেতু ভুক্তভোগীর পক্ষ থেকে মামলা হয়েছে; সেক্ষেত্রে পুলিশ অভিযুক্ত মাদ্রাসা শিক্ষককে গ্রেপ্তারের সুযোগ পেয়েছে। অন্যদিকে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যেহেতু থানায় কেউ কোন ধরনের অভিযোগ করেনি। সে কারণে তার বিরুদ্ধে এখনই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার ‍সুযোগ নেই।

আইনজীবী খালেদ চৌধুরী বলেন, এখন যেহেতু এ ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে, সেক্ষেত্রে অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী এখনো তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া এ শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে তার তিনটি পদ থেকে পদত্যাগের মাধ্যমে রূপক অর্থেও শাস্তি পাচ্ছেন।

এর আগে, গত ২৬ সেপ্টেম্বর (রবিবার) পরীক্ষার হলে ঢোকার আগে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ফারহানা ইয়াসমিন জোর করে বিশ্ববিদ্যালয়টির ১৪ জন শিক্ষার্থীর মাথার চুল কাঁচি দিয়ে কেটে দেন। এ ঘটনায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়টি। পরে এ ঘটনা তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান লায়লা ফেরদৌসকে প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়েছে।

দীর্ঘ তদন্তের পর গত বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) অভিযুক্ত শিক্ষক ফারহানা ইয়াসমিন বাতেনের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে গত শুক্রবার (২২ অক্টোবর) তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট বৈঠক আয়োজন করে। তবে এতে কোন ধরনের সিদ্ধান্ত ছাড়াই এ বৈঠক স্থগিত হয়ে যায়।

তিন পদ থেকে ফারহানা ইয়াসমিনের পদত্যাগ

চুল কেটে দেওয়ার ঘটনায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে মুখে তিন পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন ফারহানা ইয়াসমিন বাতেন। তিনি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ বিভাগের চেয়ারম্যানের পদ, সিন্ডিকেটেরে সদস্য ও প্রক্টর কমিটির সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তবে তাঁর স্থায়ী পদত্যাগের দাবিতে এখনও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা।

স্থায়ী বহিষ্কারের অন্দোলনে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা চেষ্টা

চুল কেটে দেওয়ার ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষিকা ফারহানা ইয়াসমিনের স্থায়ী বহিষ্কারের দাবি আমরণ অনশন করছেন শিক্ষার্থীরা। গত শুক্রবার (২২ অক্টোবর) রাত থেকে দ্বিতীয় দফায় অনশুন শুরু করে তারা।

পরে আজ রবিবার (২৪ অক্টোবর) দুপুর সাড়ে ১২টা দিকে অনশন থেকেই বক্তব্য দেওয়ার সময় প্রকাশ্যে বিষপান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন শামীম নামে এক শিক্ষার্থী। তিনি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী। অপরদিকে আবিদ হাসান নামে অপর এক শিক্ষার্থী হাতের রগ কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।

অন্যদিকে গত ০৮ অক্টোবর (বুধবার) লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার হামছাদী কাজির দিঘীর পাড় আলিম মাদ্রাসার দশম শ্রেণির ছয় ছাত্রের চুল কেটে দিয়েছেন মঞ্জুরুল কবির নামে ওই মাদ্রাসার এক শিক্ষক। এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে।

পরে এ ঘটনায় (০৯ অক্টোবর) শুক্রবার রাতে মাদ্রাসা ছাত্র শাহাদাত হোসেনের মা শাহেদা বেগম বাদী হয়ে শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। এরপর ওই মাদ্রাসাশিক্ষককে গ্রেফতার দেখানো হয়। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন।

রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল জলিল রবিবার সন্ধ্যায় দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, অভিযুক্ত মাদ্রাসা শিক্ষক মঞ্জুরুল কবিরের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত চলছে। আদালতের নির্দেশে বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন। শিগগিরই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

আইন প্রয়োগে সমতার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান বলেন, দেশে এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। যে দু’একটা অপরাধের বিচার হয় সেগুলোর ক্ষেত্রেও সিলেক্টিভ জাস্টিজের প্রবণতা দেখা যায়। শক্তিশালীকে রেখে আইন দুর্বলের উপর প্রয়োগ হয়ে থাকে।

তিনি আরও বলেন, ধারাবাহিকভাবে দেশে আইনের অপপ্রয়োগ হয়ে আসছে। বর্তমানে এসে এটি আরও শক্তিশালী হয়েছে এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। আইনের প্রয়োগ সবার জন্য সমান হওয়া উচিৎ। মাদ্রাসা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বলে না, অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি হতে হবে।


সর্বশেষ সংবাদ